প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
আরশাদ খান | ২৯ এপ্রিল, ২০১৭
একটি জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় মেলে সাধারণত তার কৃষ্টি কালচার, বাসস্থান, শিক্ষা-দীক্ষা, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় থেকে। ভাষার প্রভাব যেমনি রয়েছে একটি পূর্ণ মানস গঠনে তেমনি জাতি হিসেবে জাতির-সংস্কৃতির মানদণ্ডের অন্যতম নিয়ামক হলো মাতৃভাষা। জাতি চরিত্রের আখ্যান যেমনি ভাষানির্ভর ঠিক তেমনি তার অস্তিত্ব এবং বিকাশও কিন্তু ভাষাকেন্দ্রিক। এইযে বৈশ্বিক অগ্রগতি তা তো মাতৃভাষায় বিষয়বস্তু বুঝা ও জাতিতে জাতিতে ভাবের সঠিক বিশ্বায়ন বৈকি। উন্নত,উন্নয়নশীল কিংবা সবেমাত্র জাতিরাষ্ট্র যে পরিচয়ই হোক না কেন ভাষার একটি অন্যরকম আবেদন সমগ্র সমাজব্যবস্থায় সর্বদা ক্রিয়াশীল।
জাতি হিসেবে আমরা বাঙালি, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা আর আমাদের সংস্কৃতি তা তো নিজস্ব ভিতের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত ও ক্রমবিকাশমান।ভ কোন ভাষার বিকাশ কিন্তু তার যথার্থ ব্যবহার, অনুচর্যা, পরিচর্যা এবং গুণমাত্রিক পরিপালনের ওপর নির্ভরশীল। ভাষা, উপভাষা, পরিভাষা কিংবা গোষ্ঠী বিশেষের স্বল্প পরিমন্ডলীয় ভঙুর ভাষারও একটি অলেপনীয়, অমোচনীয় ও অনস্বিকার্য আবেদন রয়েছে। ভাষা জ্ঞান যে জাতির যত বেশি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সে জাতির তত বেশি।
আমাদের বাংলা ভাষার একটি আলাদা মাত্রা আছে। ভাষার অধিকার অর্জনে অবিস্মরণীয় জীবন উৎসর্গের পরীক্ষায় আমাদের অবতীর্ণ হতে হয়। প্রবল মাতৃপ্রেম ও মাতৃভক্তির আদর্শের কাছে নতজানু হতে হয় বাংলা-বিদ্বেষী, অর্থলোভী ঘাতকদের। রক্তস্নাত ১৯৫২ সেই আদর্শকে তার গর্ভে ধারণ করে ক্ষতবিক্ষত হদয় নিয়ে খুঁড়ে খুঁড়ে সময়ের বুক চিঁরে চলছে মলিনতায় মোড়ানো ক্ষয়িঞ্চু আবেগের বোঝা নিয়ে। হারিয়ে ফেলছে তার মায়াময়ী আবেদন। ১৯৫২ পরপর অবশ্য শেকল ছেঁড়া ভাষার গাঁথুনি শক্ত হতে থাকে যার স্বরূপ উপস্থিতি বিভিন্ন কালজয়ী সাহিত্য, রচনা, কবিতা, প্রবন্ধ, ছোট গল্প,উপন্যাস ইত্যাদিতে পরিলক্ষিত হয়। বিকশিত হতে থাকে সাহিত্যের দর্শন।পরবর্তীতে আপন রঙ ও ঢঙ কালক্রমে ফিকে হতে বসে ভাষার স্বকীয়তা। আগ্রাসন- অন্যভাবে বললে অন্য সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতির বিস্তার পেয়ে বসে রকেটগতি।
বাংলাভাষা বাণিজ্যিক ও বৈশ্বিক ভাষার আগুনে পুড়তে থাকে যা আজ অঙারে পরিণত হতে চলেছে। মাননীয় হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট নিজেরাই যখন দু’নীতি চর্চা করে (বাংলায় রায় লেখার কথা থাকলেও তা ইংরেজিতে লেখা) তখন তো মানুষের মুখে বহুনীতি ও ভুলনীতিই চর্চিত হবে। সরকারি গেজেটে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে সংক্ষেপে বি.বাড়িয়া বলা ও লেখা যাবে না- মর্মে জারিকৃত নির্দেশ আমরা কি মেনে চলি?
বাংলিশ (বাংলা ও ইংরেজি ভাষার মিশ্রণ) ভাষার ব্যবহারে বিস্তৃতি ও ব্যাপকতা আসাই তো তখন খুবই স্বাভাবিক। এর থেকে বড় কথা হলো ভাষার প্রমিত ব্যবহার থেকে সরে আসা। আড্ডায়, স্কুল-কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাজারে, হোটেল-রেস্টুরেন্টে যে ভাষায় আজকালের স্মার্ট মোবাইল প্রজন্ম কথা বলে তা কি শ্রুতিমধুর। তথাকথিত এলিট শ্রেণীর ইংরেজি প্রীতি আর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে জাতীয় সংগীত না গাওয়া কিংবা মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থায় তার পাশাপাশি বাংলাকে আঁতুড়ঘরে নিক্ষেপ ইত্যাদি বাংলাকে না ভালোবাসারই নিদর্শন মাত্র। যা কোনভাবেই কাম্য নয়।
১৯৯৯ সনের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের এক রেজ্যুলেসনে ইউনেস্কো কর্তৃক গৃহীত মহান ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত তো বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি মাইলফলক। ২০০০ সন থেকে তা নিয়মিত পালন, এমনকি ২০০৮ কে ‘আন্তর্জাতিক ভাষাবর্ষ’ হিসেবে ঘোষণার স্বীকৃতি-সবই তো বাংলা ভাষাকেই ঘিরে।
এই ভাষার প্রতি আমাদের জাতীয়তাবোধ যদি কমে যায় তবে পৃথিবীতে সপ্তম বৃহত্তম ভাষা হিসেবে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষার স্বীকৃতির দাবিদার হিসেবে কি আমরা যৌক্তিক ও যথার্থ? বিভিন্ন নৃ-তাত্বিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠির ভাষার ব্যবহার হারিয়ে গেলেও নির্বিকার আমরা যা বহুভাষিক ভাষা ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও বিস্তারণে জাতিসংঘের নেয়া পদক্ষেপের বিপরীত। এমনকি ১৯৫২ এর মুলমন্ত্রের পরিপন্থি। বহু সাংস্কৃতিক ও বহুভাষিক মাত্রা একটি দেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকেই প্রতিফলিত করে।
দেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির অগ্রগতি কি শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষায় কথোপকথন ও পত্র চালাচালির উপর নির্ভর করে? তাহলে চীন, জাপান, কোরিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স কি অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক সূচকে পিছিয়ে পড়ছে? তাদের অর্থনীতি কি থমকে দাঁড়িয়েছে? আমাদের দেশ থেকেই তো অজস্র শিক্ষানুরাগী ওসব দেশে গিয়ে অনেক সময় তাদের ভাষা শিখছে উচ্চ শিক্ষা নেয়ার জন্য।
বাংলাদেশ যতই উন্নত হোক না কেন কোনো এক দিন কি বিদেশীরা আমাদের দেশে এসে কি তাদের IELTS এর পরিবর্তে IBLTS (International Bangla Language Testing System) এ অংশগ্রহণ করার সম্ভাবনা আছে? যদি না-ই থাকে তাহলে গড্ডলিকা প্রবাহে আমরা নিঃস্বার্থভাবে গা ভাসিয়ে দিচ্ছি কেন। কেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা প্রদানের মৌলিক মাধ্যম হিসেবে বাংলাকে ব্যবহার করা হচ্ছে না। বাংলা একাডেমি কি ভূমিকা পালন করছে বাংলা ভাষার সম্প্রসারণে। কেন অন্য ভাষার উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকে বাংলায় রূপান্তর করা যাচ্ছে না।
বাংলাকে নিয়ে একদিকে স্বীকৃতি আদায়, অন্যদিকে স্বকীয়তার বিদায়- এটি দ্বিচারিতার অনন্য উদাহরণ বৈকি। বিশ্বদরবারে ভাষার স্বীকৃতি তখনই পরিপূর্ণ হবে যখন নাকি প্রথমে আমাদের মুখে মুখে মাতৃভাষার পরিমিত ব্যবহার স্বতঃস্ফূর্ত হবে। এক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকাই অগ্রগণ্য। নিজ ভাষার স্থলে যখন অন্য ভাষার প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যায় তখন তা স্বকীয়তার সৌকর্যে দৃশ্যমান ম্রিয়মানতা ভাষা শহীদদের বুকে অসম্মানের আঘাতের পদচিহ্নই এঁকে দেয় মাত্র। কোন জাতির কোন নতুন প্রজন্মই তা থেকে ভাল কিছু শিক্ষা পায় না।
ভয়ের বিষয় হলো আমরা সতর্ক নই। আধুনিকতার মোড়কে ইংরেজি চর্চার লেবেল লাগানো সময় উপযোগি, কিন্তু নিজ ভাষার লেবেল খুলে নয়। ভাষার মার্জিত, রুচিশীল, পরিমিত ও পরিশীলিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাকরণ মেনে ভাষার উৎকর্ষ সাধনে প্রাগ্রসর হতে হবে। ভাষার প্রতি মমত্ববোধের তীক্ষ্ণ প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরী। প্রচলন করতে হবে সর্বক্ষেত্রে এর ব্যবহার।
ইংরেজি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার পরেই টানতে হবে-আগে নয়।
জাতিসংঘের স্বীকৃতিকে ধারণ এবং বহন করতে হলে বিশ্বায়ন মেনেই বাংলা ভাষাকে রক্ষার জন্যে সব মহল থেকে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেয়া অতি জরুরী। আঞ্চলিক ভাষার জায়গাটিতে অনেক কাজ করতে হবে। ভাষা লালন পালনের ভূমিকা পরিবার থেকে প্রসূত হলে তা হবে আদর্শিক ও টেকসই। মনে রাখতে হবে মায়ের মুখের ভাষা প্রথমে সন্তানের ঠোঁটের ভাষায়, পরে মনের ভাষায় পরিণত হয়। আর মনের ভাষাই ব্যক্তি-মননে সৃষ্টিশীলতা ও সৃজনশীলতার বীজ বপন করে। যেখান থেকে সূচিত হয় সামগ্রিক মানবিক কল্যাণ।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য