আজ বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

শফি হুজুর এবং একটি থ্রিডি প্রিন্টার

আরিফ রহমান  

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদলে শফি হুজুরের কাছে কিছু প্রশ্ন, শিরোনাম- ‘শফি হুজুরের সাথে দুইখান কথা আছে’-

১) শফি হুজুরের কি পাসপোর্ট আছে?
-যদি থেকে থাকে তাহলে আমার দুইটা কথা আছে...

২) শফি হুজুরের পাসপোর্টের ভেতরে কি পাসপোর্ট সাইজ ছবি আছে?
-যদি থেকে থাকে তাহলে আমার দুইটা কথা আছে...

৩) সেই ছবি কি কোন ক্যামেরা দিয়ে তোলা হইছে?
-যদি তোলা হয়ে থাকে তাহলে আমার দুইটা কথা আছে...

৪) আমি যদি শফি হুজুরের কোন সমাবেশে তার একটা ছবি তুলি সেটা কি হারাম হবে নাকি হালাল হবে?
-যদি হালাল হয়ে থাকে তাহলে আমার দুইটা কথা আছে...

৫) আমি যদি চারদিক থেকে হুজুরের ছবি তুলি সেটা কি হারাম হবে নাকি হালাল হবে?
-যদি হালাল হয়ে থাকে তাহলে আমার দুইটা কথা আছে...

৬) আমি যদি সেই ছবিগুলো কাগজে দিয়ে প্রিন্ট না কইরা প্লাস্টিক ফিলামেন্ট দিয়ে থ্রিডি প্রিন্টারে প্রিন্ট করি- তাহলে সেটা সেটা কি হারাম হবে নাকি হালাল হবে?
-যদি হালাল হয়ে থাকে তাহলে আমার দুইটা কথা আছে...

৭) এবারে যদি গ্রীক দেবীর ভাস্কর্য থ্রিডি প্রিন্টারে প্রিন্ট করি তাহলে সেটা কি হারাম হবে নাকি হালাল হবে?
-যদি হালাল হয়ে থাকে তাহলে আমার দুইটা কথা আছে...

৮) যদি ভাস্কর্যটা থ্রিডি প্রিন্টারের বদলে ইট পাথরে প্রিন্ট করি সেটা হালাল নাকি হারাম?
-যদি হালাল হয়ে থাকে তাইলে আমার কোন কথা নাই...

-আর যদি উপরের কোন প্রশ্নের উত্তর "হারাম" হয়ে থাকে...
-তাহলে ছবি তোলা হারাম হলো না কেন...?

দুই.
পৃথিবী যখন সভ্যতাকে নির্ধারণের মাপকাঠি বিবেচনা করলো শিল্পকলাকে তখন আমাদের দেশ পড়ে রইল একটা ভাস্কর্যকে মূর্তি তকমা দিতে। ২০১৭ সালের স্পেস-টাইমের গুরুত্ব ঘুচে যাওয়া একটা সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা ভিডিও কনফারেন্সে তর্ক করছি ভাস্কর্যটা উচ্ছেদের পক্ষে-বিপক্ষের যুক্তি নিয়ে।

নিরেট ইসলামিক ভাবাদর্শ চর্চা করলে ভাস্কর্যের নিশ্চয়ই আগে আলোচনায় আসার কথা চলচ্চিত্র, তারও আগে আসার কথা ফটোগ্রাফি, তারও আগে আসার কথা পোট্রেট আঁকানো। শাড়ি পরিহিতা মূর্তিটি নাজায়েজ হলে শাড়ি পরিহিতা সুন্দরী সংবাদ পাঠিকাটি কি জায়েজ? বিচারালয়ে ভাস্কর্য যদি বিচারকে প্রভাবিত করে তাহলে একই যুক্তিতে বোরখা বিহীন নারী উকিলটিও তো বিচারকে প্রভাবিত করার কথা। কারণ স্পষ্ট মনে আছে শফি হুজুর বলেছেন নারী দেখলে যদি মুখে লালা না আসে তবে নাকি পুরুষের পুরুষত্বই থাকে না।

হুজুর কথাটি যেভাবেই বলুক কথাটা কিন্তু অনেক বড় কথা। বিচারালয়ে ভাস্কর্য যদি হয়ে থাকে গ্রীসের কোন দেবীর মূর্তি তাহলে সন্ত্রাস বিরোধী রাজু ভাস্কর্যও তো মূর্তি। অপরাজেয় বাংলাও তো মূর্তি। বাংলামোটর পার হয়ে একটু সামনে আগালেই ছেলের লাশ কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নারীর ভাস্কর্যটিও তবে মূর্তি। আমি জানি না শাড়ি পরিহিতা মাতৃরূপি ভাস্কর্যটির স্তনাভাস দেখে হুজুরের মুখে লালা আসে কি না? শফি হুজুরের নজরে না পড়লেও মুফতি ফয়জুল্লাহ মূর্তিটি দেখে থাকবেন। আজকাল টেলিভিশন পাড়ায় ওনার অনেক যাওয়া-আসা।

ব্যাপারটা হচ্ছে কি আপনাদের বোঝাই। একটা সময় ছিল যখন বিএনপি বলেন আর আওয়ামীলীগ বলেন দুই দলের কোন বড়সড় নেতা কোন বিতর্কিত কথা বললে সেটা নিয়ে টেলিভিশন টক-শো হতো। ছোটখাটো পাতি নেতারা সেই অনুষ্ঠান কভার করতে যেতেন। আমার মনে হয় না আমাদের রাজনীতিবিদেরা খুব চিন্তাভাবনা করে কথাবার্তা বলেন। ফলে দেখা যেত- ছোট নেতা যে বড় নেতাকে ডিফেন্ড করে কথা বলছেন সেই বড় নেতা এত কিছু ভেবে চিন্তে বিতর্কিত কথাটি বলেননি। এখন ছোট নেতা মহাশয় যেহেতু পার্টি করেন, পার্টির পরবর্তী কমিটিতে বড় পদের প্রত্যাশা করেন সেহেতু পার্টিকে তার ডিফেন্ড করতেই হবে। আজ যারা হেফাজতকে ডিফেন্ড করছেন তারা প্রত্যেকেই জানেন যে দুনিয়ার তাবৎ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে ভাস্কর্য রয়েছে, একেবারেই নাই বলতে গেলে সিরিয়ার আইএস শাসিত অঞ্চলে।

ফটোগ্রাফির কথা বলছিলাম, বলছিলাম ভিডিওগ্রাফির কথা। ঠিক যেই যেই কারণে মূর্তির বিরোধিতা করা সেই একই যুক্তি ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রেও খাটানো যায়। তবে ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে যাদের সোচ্চার অবস্থান তারাও নিজের ছবিকে প্রোফাইলে ঝুলিয়েই গলা ফাটাচ্ছেন। এই পৃথিবীতে ফটোগ্রাফি সামনে রেখে পূজা করা হয় না? রাধা-কৃষ্ণ, সাইবাবা কিংবা গৌতম বুদ্ধের ছবির সামনেও তো গড় হয়ে প্রণাম করতে দেখা যায়। ধর্মীয় ভাবে ইসলামে মূর্তির বিরোধিতা হয়ে থাকে কারণ ঐতিহাসিক ভাবেই ইসলাম মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে, এটা ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু মানুষের অবয়ব আছে মানেই তার পূজা হবে এমনটা কে বলেছে? মাদাম-তুসোর মোমের মূর্তির উদ্যানে কেউ কখনো পূজো করতে গিয়েছে? অথবা কখনো শুনেছেন অপরাজেয় বাংলার সামনে কেউ মন্ত্র আওড়াতে আওড়াতে প্রসাদের থালা ঘোরাচ্ছে?

যদি তারপরেও মাথা ঝাঁকিয়ে বলেন যে আপনাদের দেশে ভাস্কর্য থাকবে না, তাহলে একই যুক্তিতে ফটোগ্রাফও রাখতে পারবেন না, রাখতে পারবেন না কোন আধুনিক ডিসপ্লে সম্বলিত ডিভাইস। মূর্তি মানেই পূজা হয়ে থাকলে ফটোগ্রাফি মানেও পূজা।

সবশেষে আরেকটা কথা বলি। পৃথিবীতে নতুন এক প্রযুক্তি এসেছে, থ্রিডি প্রিন্টিং। চতুর্দিক থেকে আপনার ছবি তুলে হুবহু আপনার দেহের মত দেখতে একটা ত্রিমাত্রিক মডেল প্রিন্ট করা সম্ভব খুবই স্বল্প খরচে। অনেক উন্নত দেশ ভাবছে নিরাপত্তার স্বার্থে তারা নাগরিকদের ত্রিমাত্রিক মডেল তৈরি করে করে রেখে দেবে, অলরেডি অনেক দেশ ত্রিমাত্রিক ফটোগ্রাফি সংরক্ষণ শুরু করেছে।

ভাবছি সারা পৃথিবী যখন এই প্রযুক্তি গ্রহণ করবে তখন আমাদের দেশের কিছু মানুষ রাজপথে ভাঙচুর করে জানান দেবে তারা এই প্রযুক্তি এই দেশে প্রবেশ করতে দেবে না। এরপর সৌদি শুরু করলে সেই উদ্ভ্রান্তরাই আবার থ্রিডি স্ক্যানিং করতে লাইন ধরবে। আজ আমরা সৌদির ভাস্কর্য গুলো দেখালে তারা বলে সৌদি আরব ইসলামের অথরিটি না। পাসপোর্টের ফোটোগ্রাফ নিয়েও তারাই একসময় আকাশ বাতাস কাঁপাতেন। সৌদি মেনে নেয়ার পর ঠিকই আজ গ্রহণ করেছেন।

লেখার শুরুতে একটা কথা বলছিলাম এই পৃথিবীতে মানব সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে মানুষ ভাস্কর্য গড়ে। ভাস্কর্যের প্রাচুর্য আর সৌন্দর্য এক-একটা দেশের সভ্যতার মাপকাঠির জানান দেয়। আমাদের দেশ আজকাল অনেক উন্নয়ন মাত্রা নিয়ে কথা বলে, দেশে বিদেশে উন্নত দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। আবার সেই দেশেই মাসের পর মাস পত্রিকার লিড নিউজ হয় একটা ভাস্কর্য নিয়ে। পত্রিকার ভেতরে কলামিস্টেরা বিশ্লেষণ করেন ভাস্কর্য আর মূর্তির ভেতরের তফাৎ। মন্ত্রী আমলারা গবেষণা করেন কি দিয়ে কি ঢাকবেন।

আজকের সময়ে দাঁড়িয়েও বারবার জাতীয় কবি দুখু মিয়ার কথাই মনে পড়ে-

'বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখন ব'সে
বিবি তালাকের ফতওয়া খুঁজেছি ফিকাহ হাদিস চ'ষে...'

আরিফ রহমান, লেখক, অনলাইন এক্টিভিষ্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ