প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
শারমিন শামস্ | ০৩ মে, ২০১৭
হযরত আলী তাঁর শিশুকন্যাকে নিয়ে ট্রেনের তলে ঝাঁপ দিয়েছেন। অভিমানে, ক্ষোভে। অথচ এই দেশে বিচার বলে কিছু নেই, বিশেষত দরিদ্র ক্ষমতাহীনের জন্য বিচারের আশা বলেও কিছু নেই। এইসব কিছু জানবার পরও দরিদ্র ক্ষমতাহীন হযরত আলী কেন বিচারের আশা করেছিলেন? তাও আবার ধর্ষণের বিচার? এই দেশে ধর্ষণের বিচার হয়? এই দেশে ধর্ষক ধরা পড়ে? ধরা পড়লেও তার সাজা হয়? না তো। নাকের ডগায় ঘুরে বেড়ায় খুনি, ধর্ষক, নিপীড়ক। বিচারপ্রার্থীর বাড়িতে গিয়ে মামলা তুলে নেবার হুমকি দেয়।
ওহ হ্যাঁ, যদি আদৌ মামলাটা করতে পারেন হযরত আলীরা। হযরত আলীর মামলাই তো নেয়নি থানা। সেই ক্ষোভে হযরত আলী ঝাঁপ দিয়েছেন ট্রেনের তলে। সাথে ধর্ষিতা মেয়েটাকেও নিয়ে গেছেন। ও বেঁচে থেকে করবেটা কি এই দেশে? এই দেশে আছেটা কি? কতগুলো কামুক পুরুষ একটা শিশুকে ধর্ষণ করে ফেলে রেখে গেল। শিশুর বাপ তার বিচার চাইলেন, আর থানা বলল, এক হাজার টাকায় আপোষ করে নাও! তো হযরত আলীর মেয়ে এই অশ্লীল ভূখণ্ডে বড় হয়ে করবেটা কি? ও বড় হতে হতে আরো কয়েকবার ধর্ষণ হতো ওর। বেশ হয়েছে। হযরত, আপনি ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এখন দেখেন, আপনার মেয়ের ধর্ষক ধরা পড়েছে। অবশ্য এতে আমি আনন্দে উৎফুল্ল নই। কয়েকদিনের মধ্যেই এই ধর্ষক লোকটা জামিনে বেরিয়ে আসবে বলেই আমার ধারণা। তার আদৌ বিচার হবে কি না, কিংবা হলেও তা নিতান্ত লঘু দণ্ড হলেও আমি একেবারেই বিস্মিত হব না।
শিশু ধর্ষণের জন্য এই দেশটি রীতিমত একটি আদর্শ স্থানে পরিণত হচ্ছে। শিশুদের কব্জা করে ধর্ষণ করা সহজ বলেই ধর্ষক পুরুষদের কাছে শিশু একটি আদর্শ শিকার। আর ওই যে বললাম, দরিদ্রতা, ক্ষমতাহীনতা। দরিদ্র পরিবারের শিশুরা তো নিরাপত্তাহীন এদিক ওদিক চলে ফিরে খেলে বেড়ায়। তাদের ধরে শিকার বানানো এতই সহজ, যে আজকাল পুরুষেরা আর বেশি ঝামেলায় যাবার পক্ষপাতি নন। আল্লায় দিলে ষোল কোটি জনসংখ্যার দেশে শিশুর তো অভাব নাই। ফলে শিকার সহজলভ্য।
আজ দুপুরে যখন ব্রেকিং নিউজ পেলাম হযরত আলীর কন্যার ধর্ষক ধরা পড়েছে, হাই তুললাম। ধর্ষক ধরা পড়লে কী হয়? কিছুই হয় না। পুলিশ বিভাগ সামান্য নাম কিনতে পারেন। তারা গ্রেপ্তারে সক্ষম। কে জানে, হয়তো পর্দার আড়ালে ওপাশের রুমে গিয়ে তারাই বলে এসেছেন ধর্ষককে, 'এবার কটা দিনের জন্য একটু আয়, পরে ব্যবস্থা হচ্ছে'। ধর্ষকের সাথে নিয়মিত যোগসাজশ তাদের ছিল বলেই পুলিশ প্রথমে মামলা নেয়নি। এখন এই ধর্ষক গ্রেপ্তার করার জন্য দু'দুটো তাজা প্রাণকে ট্রেনের নিচে মাথা দিতে হল। অবশ্য মাথা দেবার সময় বাপ-বেটি কেউ এই আশা করে মাথা দেননি যে, এতে এত কিছু হবে। তারা জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ এবং এই বঙ্গদেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি ঘেন্নায় রি রি করে ট্রেনের তলে ঝাঁপ দিয়েছেন। এখন এই যে আমি হযরত আলীর কথা লিখছি, এই যে আমি তার শিশু মেয়েটির কথা লিখছি, আমারও ঘেন্নায় রি রি করছে সর্বাঙ্গ। ঠিক কার প্রতি এটি অবশ্য বুঝতে পারছি না। বোধহয় নিজের প্রতিই।
পূর্ণিমাকে যখন গণধর্ষণ করা হল, আমি নিজেকে ঘেন্না করতে শুরু করলাম। তনুকে যখন ধর্ষণ করা হল, আমি নিজেকে ঘেন্না করলাম। আদিবাসী মেয়েটাকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে রাজধানীর পথে পথে ঘুরে ধর্ষণ করলো, নিজের প্রতি ঘেন্নায় আমার সারা শরীর রি রি করতে লাগলো। একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা প্রতিদিন ভেসে আসে টেলিভিশনের পর্দায়, খবরের কাগজে। আমরা হিসাব রেখে রেখে আর কূল পাই না। আমাদের নারী নেত্রীরা হয়রান, পেরেশান। এত এত ধর্ষণের পিছে আর কত সময় নষ্ট করবেন! ধর্ষণ প্রতি একেকটা সেমিনার বা মানববন্ধনের জন্য যে পরিমাণ মেকআপ আর নতুন শাড়ি-ব্লাউজের যোগান লাগে, তা বেশ সময়সাপেক্ষ।
তবে ব্যাপারটা খারাপ না। আজকাল এতগুলো টিভি, সেগুলোতে যদি পঁচিশ সেকেন্ড করেও দেখায়, পুষিয়ে-টুসিয়ে যায় আর কি! যাই হোক, তারপরও, প্রতিদিন দশটি ধর্ষণের ঘটনা কাভার দেয়া সমস্যাই বটে। অবশ্য তারা শহরকেন্দ্রিক ঘটনাগুলো শর্ট লিস্টেড করে ফেলছেন আজকাল। এতে মানববন্ধন, সেমিনারের বিষয়গুলো বেশ সাইজ করা সহজ হয়। এর পরও আরো কত কি আছে।
যাই হোক, এতকিছুর পর, সবচেয়ে ভাগ্যবান ওই হযরত আলী আর তার শিশু কন্যাটিই। এইসব ভাঁড়ামো আর তাদের দেখতে হল না। এই গ্রেপ্তার, মানববন্ধন, লেকচার, টকশো, এমনকি আমার এই লেখাও।
হযরত আলী আর কন্যা আয়েশা আজ ধরাছোঁয়ার বাইরে, সুদূরে। এই দেশে ধর্ষণের বিচার তারা চেয়েছিলেন বলে এখন হয়তো ওপারে সৃষ্টিকর্তার সাথে বসে খুব হাসছেন। কি যে আহাম্মক ছিলাম হে ঈশ্বর! বিচার চাইছিলাম, মামলা করতে গেছিলাম। হায়রে! এই বিশ্বজগতে একখানা দ্যাশ বটে বানাইছেন আপনে, যেইখানে ধর্ষিতাই সবচেয়ে বড় দাগী আসামী!
তো সৃষ্টিকর্তাও হয়তো মুখ মুচরে একচোট হেসে নিচ্ছেন। আর বলো না হে হযরত! তুমিও ঘাউড়া একখান বটে। দিলা তো ট্রেনের নিচে ঝাঁপটা। এখন আজাইরা কটা দিনের পেরেশানি ওই পুলিশ-টুলিশ, আইনজীবী, আসামি, কোর্ট-কাচারির। তারপর যে লাউ সেই তো কদু। তুমি খালি কটা দিন ফেসবুকে গরম স্ট্যাটাস প্রসব করাইলা বটে।
বাপের সাথে ঈশ্বরের কথোপকথন শুনে আট বছরের মেয়েটাও হয়তো হাসে। হয়তো জীবনের ওইপারে ডানা মেলে দিয়ে তার খুব ভালো লাগছে এখন। শুধু মৃত্যুর মুহূর্তটুকুই যা কষ্টের ছিল। যখন বাপের ধাক্কায় রেললাইনের নিচে চলে গিয়েছিল শরীরটা আর দানবের মত ছুটে এসেছিল ট্রেন। আর মুহূর্তে অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় ডুবে গিয়েছিল চারপাশ! আর এক ঝলক মনে পড়ে গিয়েছিল মায়ের বেদনাক্লান্ত মুখটা!
আমরা আর হযরত আলী ও তার ধর্ষিতা শিশুকন্যার কথা না ভাবি! আমাদের সামনে আরো বহু কিছু আছে ভাববার। এরকম একটা বীভৎস আত্মাহুতির খবরেও আমরা সেইভাবে নড়েচড়ে বসতে পারি না। সংবাদ মাধ্যমেও এই সংবাদের মূল্য দিনকে দিন ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়। একটি হতদরিদ্র পরিবারের খবরে আর কতটা গ্ল্যামার থাকে, যতটা থাকে শাকিব খান-অপু বিশ্বাসের পারস্পরিক নোংরামি আর ব্যক্তিগত প্রতারণার গল্পে!
তাই আমরা ভুলে যাই। ভুলে যাওয়াই ভালো। একটি রাষ্ট্রের ধর্ষণ আকাঙ্ক্ষা যখন সব ধরণের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, আর রাষ্ট্র তার কামুক পুরুষাঙ্গটি উঁচিয়ে বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায় সর্বত্র, তখন নীরবে ফেসবুকিংই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক!
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য