আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

যৌন বিশুদ্ধতাই যৌন মৌলবাদীতা

কাজল দাস  

'লিঙ্গ ও যোনি ঈশ্বরও নয়, শয়তানও নয়। রতিক্রিয়া পবিত্রও নয়, নারকীয়ও নয়; এটি এক আনন্দদায়ক, উপকারী ও অপরিহার্য ক্রিয়া' হলেও বর্তমান সময়ে যৌনতা নিয়ে আমরা মূলত একটি রক্তপাতহীন যুদ্ধের মধ্য আছি। আমাদের সমাজে একজন নারীর সম্মান বা মর্যাদা তার মহৎ হৃদয় কিংবা সুনিপুন দক্ষতা বা দীপ্ত বুদ্ধিমত্তায় থাকে না, সেটি থাকে তার যোনিতে। কিছুমাত্রায় পুরুষের লিঙ্গেও অবস্থিত। এজন্য সমাজে নারীর কুমারীত্ব বা শালীনতা রক্ষার জন্য বিভিন্ন বিধান চালু আছে। তেমনি পুরুষকেও নারীর সাথে মিলিত হবার ক্ষেত্রে অনেক ধরণের প্রভেদের দেয়াল তোলা হয়েছে। নৈতিক বিধানের এই প্রভেদ যৌনতাকে দিন দিন এতো বিশুদ্ধতায় নিয়ে গেছে যে আমরা ভুলে গেছি যৌনতা একটি শারীরিক ক্রিয়া মাত্র। এই যৌন বিশুদ্ধতা এক ধরণের যৌন মৌলবাদীতা। সমাজে এই যৌন মৌলবাদীতা তৈরি হবার একটি দীর্ঘ ও নির্মম ইতিহাস রয়েছে। এই নির্মমতা পুরুষের চেয়ে নারীর উপরেই বেশি হয়েছে।

যৌন সম্পর্ক নারী-পুরুষের মধ্যকার সবচেয়ে প্রাচীন সম্পর্ক। মানুষ জীবিকা নির্বাহের বাইরে অন্য যে অন্যন্য ক্রিয়াটি আজ পর্যন্ত বহন করে সাথে নিয়ে এসেছে, সেটি হল একমাত্র যৌন ক্রিয়া। ২ লক্ষ বছর আগের হোমো সেপিয়েন্সদের মধ্যে এই যৌন সম্পর্ক শুরু হলেও আধুনিক মানুষের প্রাচীন পূর্বসুরী অস্ট্রালোপিথেকাসদের দেখা মিলেছে ২৫ লক্ষ বছর আগে। তারও প্রায় ৬০ লক্ষ বছর আগে দেখা মিলেছিল আজকের মানুষের আদিম মাতামহীদের, যাদের একটি অংশ বিবর্তনের পথ ধরে আজকের আধুনিক মানুষে পরিণত হয়েছে। যৌন সম্পর্ক ছিল তাদের মধ্যেও। তবে আজকের সভ্য মানুষের যৌন ক্রিয়ার ইতিহাস খুব অল্প সময়ের। আমরা যদি কৃষিযুগকে সভ্যতার ভিত্তি ধরি, তাহলে মানব সভ্যতার বয়স ১২-১৫ হাজার বছরের বেশি নয়। তার মধ্যে আমাদের হাতে লিখিত বা ইতিহাস রয়েছে মাত্র ৫ হাজার বছরের। আমাদের আজকের যৌন চিন্তার ভিত্তি তৈরি হয়েছে এই সময়েই। আজকের দিনের যৌনতার চিন্তা মূলত এই সময়ের তৈরি।

তবে এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে যৌনতার নির্মম সময় হচ্ছে মধ্যযুগ। আমরা আজকের সময়ে এসে যে যৌনচিন্তা বহন করে চলছি সেটি মধ্যযুগে তৈরি হয়েছে। নারীর সতীত্বের ধারণা, যৌনতার ক্ষেত্রে শালীনতার ধারণা, কৌমার্যের ধারণা, মনোগামী ও বহুগামী যৌনতার দ্বন্দ্ব সবই এই সময়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর আগের সমাজে এসব দেখা যায় নি। নানা কারণেই সমাজে যৌন বিশুদ্ধতা তৈরি হয়েছে ট্যাবুর মাধ্যমে। এখানে আমরা শালীনতা, বিয়ে ও কৌমার্যের ধারণা দিয়ে সেটা আলোচনা করতে পারি।

সমাজে যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য যত ধরণের প্রথা তৈরি করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম একটি প্রথা হল শালীনতা (modesty)। এই শালীনতা যৌন নৈতিকতা তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। শালীনতা মূলত শরীর প্রদর্শণ ও যৌন সংসর্গীয় আলোচনার উপর এক ধরণের রক্ষনশীল মনোভাব। যার ফলে ব্যক্তি নিজের যৌনাঙ্গ অনাবৃত রাখার জন্য পীড়ন অনুভব করে, এমনকি নিজের যৌন সুখকে প্রকাশ করতেও লজ্জা বোধ করে। এই মনোভাব সভ্যতার যুগের এক পৃথক মনোভাব। পূর্বেকার সমাজে মানুষ এই ধরণের প্রয়োজন অনুভব করেনি। এটি নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে সমানভাবে কার্যকরী হলেও সমাজভেদে এটি পুরুষের চেয়ে নারীর উপরেই বেশি মাত্রায় বিদ্যমান। এই শালীনতা কার্যকর মূলত যৌন অঙ্গ প্রদর্শণী ও যৌন সুখ লাভের আলোচনার উপর। আদিম সমাজে একটা সময় ছিল যখন নারী বা পুরুষের যৌন অঙ্গকে পূজা করা হতো। নারীর যোনিকে উর্বরতার সাথে চিহ্নিত করে তাকে উর্বরতার প্রতীক হিসেবে বন্দনা করা হয়েছে। পুরুষের লিঙ্গকে যৌন সুখ লাভের জন্য কামনা করে অর্ঘ্য দেয়া হয়েছে (ভারতীয় দেবতা শিবের বন্দনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য)। নারীর স্তনকে পবিত্র আধার হিসেবে দেখা হয়েছে। প্রাচীন সমাজে নারী পুরুষের যৌনাঙ্গকে মহিমান্বিত করা হয়েছে, তার মূর্তি নির্মাণ করে শ্রদ্ধা করা হয়েছে।

কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র এখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। যৌনাঙ্গকে এখন লুকিয়ে রাখা হয়, তাকে নিয়ে আলোচনা নিষিদ্ধ, এমনকি যৌনাঙ্গ কেউ প্রদর্শন করলে তাকে শুধু অশ্লীল বলে পরিত্রাণ দেয়া হয় না, এটাকে অপরাধ গণ্য করে শাস্তি দেয়া হয়। এমনকি সমাজচ্যুতও হতে হয় অনেককে। এই অপরাধটি আদিম সমাজে দেখা যায়নি, এমনিক আদিবাসী সমাজেও এই রকম শালীনতার বিস্তৃতি কম লক্ষ্য করা যায়। আদিম সমাজের লিঙ্গ ও যোনিকে ধর্ম ও উপাসনার স্তর থেকে নামিয়ে আধুনিক সমাজে নিষিধাজ্ঞা আরোপ করা, অবদমিত রাখাটা মানব সভ্যতার যৌন যাত্রার এক নির্মম ট্রাজেডি।

প্রাচীন সমাজে শালীনতা না থাকলেও সভ্যতার যুগে এটি হবার কারণ হল, সামাজিক প্রথার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা। যুদাইজম ও খ্রিশ্চিয়ানিটির ভেতরেই শালীনতা জন্ম হয়েছে বেশি। এটি পরবর্তীতে 'পর্দা' নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইসলামী সমাজে। হিন্দু সমাজেও এই শালীনতার প্রচলন রয়েছে। মানুষের স্বাভাবিক লজ্জ্বাবোধ আর শালীনতা কখনো এক জিনিস নয়। লজ্জা আদিম সমাজের মানুষের ক্ষেত্রে দেখা পাওয়া গেলেও শালীনতা ছিল না। শালীনতা এসেছে প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় নৈতিকতা হতে। সমাজে শালীনতা বোধ জন্ম দেয়ার জন্য দায়ী অন্যতম প্রথা হল বিয়ে। যে নারী ও পুরুষ বিয়ের আগে শালীনতা নিয়ে লজ্জ্বায় থাকেন, যৌনতাকে অবদমিত করে রাখেন, সেই নববধূ বা নতুন বরই আবার বিয়ের রাতে অপরিচিত অন্য কারো কাছে নিজেকে উন্মোচিত করে দিচ্ছেন। শালীনতা যৌনতাকে লজ্জাজনক ও অপবিত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেছে কিন্তু কোন প্রকার বাছ-বিচার ছাড়াই সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি প্রথা ও পরিবেশে সন্তান উৎপাদনের জন্য ধর্মের মাধ্যমে বিবাহ দিয়ে যৌনতার আয়োজন করছে। শালীনতা এই ধরণের যৌন সুখকে অপবিত্র মনে করে না! সর্বক্ষেত্রেই আরোপিত হয়ে থাকা শালীনতা বিয়ে বা প্রেমের ক্ষেত্রেও অবরুদ্ধ থাকার কথা, কিন্তু ব্যক্তি কখনো সেটিকে কখনো চূড়ান্ত বিচারে গন্য করে না, সে তাকে ভেঙে আসতে চায়। ব্যক্তির এই বের হয়ে আসাকে নীতিবাগীশরা অন্তরঙ্গতা দিয়ে বিচার করলেও এটিই আসলে মানুষের স্বাভাবিকতা। ধর্ম ও নৈতিকতার চতুরতা দিয়ে নীতিবাগীশরা এটি আটকে রাখতে চাইলেও যৌনতা সবসময় উপেক্ষা করেছে সকল প্রতিবন্ধকতাকে।

সেজন্য ফরাসী যৌন তাত্ত্বিক গিয়োম বলেন, 'শালীনতা হল অবদমনের প্রতীক। যৌনতার দূর্গে খোদিত এই প্রতীক সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে এই দূর্গ অবদমনের দ্বারা বিজিত ও অধিকৃত। আর এতেই সব কিছুর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। শৈশবের বছরগুলোতে এই পতাকা উত্তোলিত হয়নি। কেননা তখনো তার যৌনতা ছিল মুক্ত, নিষেধের কাঁচি দিয়ে ডানাছাটা নয়। শালীনতা যদি মানুষের সহজাতগুণ না হয়, তবে তার কারণ এই যে, অবদমনের প্রতীক এই শালীনতা। সেই অবদমনইতো আসলে মানব প্রকৃতির বিরূদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা '। আমরা সমাজে যৌনতা নিয়ে যা যা প্রত্যক্ষ করি এর সব কিছুতেই অবদমনের ভূমিকা রয়েছে।

শালীনতাকে সমাজে নারীর জন্য একটি উচ্চমূল্যবোধ সম্পন্ন গুণ হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। এর অন্যতম কারণ নারীর সতীত্বের মূল্য। কুমারী নারীকে বা অক্ষত যোনির নারীকে দিয়ে নিরাপদ উত্তরাধিকার তৈরির ধারণা নারীর শালীনতাকে তার একটি গুণ হিসেবে দেখে। শালীনতার প্রথা ভঙ্গ করা নারীরা সেজন্য যুগে যুগে যৌন দিক থেকে সমাজের কাছে খুবই নিকৃষ্ট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বিয়ের ক্ষেত্রে ধর্ম সমাজে কুমারী নারীর যে মূল্য তৈরি করেছে, তাকে ঘিরেই শালীনতা দেখা দিয়েছে আধুনিক কালের সমাজে এসে। শালীনতা বলতে নারীর জন্য যা যা পালনীয় বোঝায়, পুরুষের জন্য সকল সময়ে তা এক নয়। শালীনতা রক্ষার জন্য নারীকেই পর্দা দ্বারা অবরুদ্ধ থাকতে হয়, বিয়ের পূর্বে যৌন ক্রিয়া থেকে বিরত থাকতে হয়, বিয়ের পরেও স্বামীর বাইরে যৌন ক্রিয়া থেকে বিরত থাকতে হয়। নারীকে দিয়ে বৈধ সন্তান উৎপাদন ও পুরুষের একান্ত ভোগের জন্য সমাজে এভাবে শালীনতার মূল্য দেখা দিয়েছে। বিয়ে প্রথা যেভাবে সমাজে যৌনতাকে রূপায়িত করেছে, শালীনতাবোধ তার ভেতরেই সমাজে দেখা। প্রকৃতপক্ষে এই ধরণের শালীনতা আসলে সমাজে এক ধরণের ধর্ষকামের মনোভাব তৈরি করেছে। কারণ পুরুষতন্ত্র নারীকে শালীনতা সম্পর্কে এক শিক্ষা দেয়, কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত আরেকটি শিক্ষা দিয়ে তার সাথে আপন প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে। যে শালীনতা সে নিজে তৈরি করেছে, সেটাকেই সে পদদলিত করে নারীকে যৌন নিপীড়ন করে যাচ্ছে ক্রমাগত।

কৌমার্য (Chastity) যৌন ধারণার জন্য আরেকটি অন্যতম বিষয়। এটা এক ধরণের যৌন শুদ্ধতা বা শুচিতা। নারীর ক্ষেত্রে এটি কুমারীত্ব আর পুরুষের ক্ষেত্রে কৌমার্য। মূলত ধর্ম বিকাশের পরে সমাজে কৌমার্যের ধারণা এসেছে। আদিম সমাজে কৌমার্যের ধারণা ছিল না। আমরা দেখেছি যে তাদের ক্ষেত্রে ট্যাবুর অনুপ্রবেশ ঘটেছে, কিন্তু যৌন সম্পর্ক থেকে কোন মাত্রাতেই কাউকে বিরত রাখার প্রশ্ন দেখা দেয়নি। ট্যাবু হচ্ছে বহির্গোত্রে যৌন সম্পর্ক স্থাপন, কিন্তু কৌমার্য হল যৌনতাকে বিসর্জন। কৌমার্য বিষয়ের অতি পরিচিত একটি উদাহরণ হল কুমারী মাতা মেরীর গর্ভে প্রভু যীশুর জন্ম। ধর্ম নারীকে যেভাবে কুমারী প্রমাণ করে সন্তান জন্ম দিয়েছে, এতে করে কৌমার্যের বিষয়টি সমাজে কত মহিমান্বিত তা অনুমান করা যায়। এই ধরণের কুমারী নারীর গর্ভে জন্ম দেয়ার অনেক উদাহরণ প্রাচীন ভারতীয় পুরাণেও রয়েছে। এশিয়ার বিভিন্ন লোক পুরাণেও এর দেখা মিলে। গ্রীক দেবীদের অনেকেই ছিলেন কুমারী মা। ইশ্বরের আশির্বাদে তারা সন্তান জন্ম দিয়েছেন। কৌমার্য সমাজে এতোটাই মহিমান্বিত যে, নারীকে অক্ষত যোনি রেখেও সে সন্তান উৎপাদন করতে চায়।

কৌমার্য বা শুচিতার উৎপত্তির কারণ কি ছিল সেটা আজকের দিনেও সমাজে স্পষ্ট হয়ে উঠে ধর্ম পালনের সাথে যৌন সম্পর্কের বিধি-নিষেধের যোগ দেখলে। প্রতিটি ধর্মেই বিশেষ কোন দিনে নারী ও পুরুষকে যৌন ক্রিয়া থেকে বিরত রাখার বিধান চালু আছে। মধ্যযুগে যখন পাদ্রীদের দ্বারা বিবাহিত যৌন মিলনের পঞ্জিকা দেয়া হতো, সেখানে বছরের ৪০ ভাগ দিনকে তারা যৌন সুখ গ্রহণ করা থেকে নিষিদ্ধ রেখেছিল। হিন্দু ধর্মে নারীদের ক্ষেত্রে একাধিক ব্রতের ধারণায় যৌনতা থেকে নিবৃত থাকার বিধান আছে। ইসলামে রমজান মাসে রোজা পালনরত অবস্থায় যৌন ক্রিয়া নিষিদ্ধ, আবার নারীরা যদি ঋতুবতী হয়ে থাকেন তাহলে তার ক্ষেত্রেও রোজা নিষিদ্ধ। অর্থাৎ রোজা পালন ও যৌন সুখ লাভ আলাদা রাখতে হবে। গীর্জার পাদ্রি, পুরোহিত, যাজক, হিন্দু সন্ন্যাস ও বৈরাগ্যবাদীরা, বৌদ্ধভিক্ষুগণ এদের সবার ক্ষেত্রে কৌমার্য পালন বাধ্যতামূলক। এভাবে কৌমার্যের ধারণা সমাজে প্রতিষ্টিত হয়েছে মূলত যৌন সুখ থেকে নারী-পুরুষকে বঞ্চিত রাখার মাধ্যমে। যৌন ক্রিয়া ও যৌন সুখ মানুষের একান্ত ক্রিয়া হওয়ায় এটি তার মধ্যে প্রবৃত্তিগতভাবে বিদ্যমান। যে কোন সময়েই মানুষ এই প্রবৃত্তি নিবৃতকরণের জন্য সাড়া দিতে পারে। ধর্ম বিকাশের যুগে নানা প্রকারের অধিবিদ্যাগত দর্শনের দ্বারা মানুষের চিন্তাকে ধীরে ধীরে যখন কুক্ষিগত করা হয়েছে, তখন ধর্মপ্রচারকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল তাকে যৌন চিন্তার জায়গা থেকে ক্রমাগত বিরত রাখা। কিন্তু মানুষের প্রবৃত্তি সতত অনুশাসনের প্রতিবন্ধকতার উপরে নির্ভরশীল নয়। সেজন্য বারে বারে তার মধ্যে এটি দেখা দেয়। সে তখন সকল অনুশাসনের মতো ধর্মীয় নৈতিকতাকেও উপেক্ষা করে। একইভাবে ধর্মও তার পেছনে ছুটে; ধর্মও চায় তার অনুসারীরা সংযমী হয়ে উঠুক। যৌন সুখ লাভে কৃচ্ছতা সাধন করুক। অর্থাৎ, ধর্ম পালনের প্রতি একাগ্রচিত্ততাকে যৌন প্রবৃত্তির উপরে প্রতিষ্ঠার একটি জবরদস্তিমূলক কাঠামো ধর্মীয় বিধান সমাজ চালু রেখেছে।

কৌমার্যের মূল কথাই হল সন্তান উৎপাদন ব্যতিত যৌন-ইন্দ্রিয়ের চর্চাকে জাগ্রত না করা। সম্ভব হলে ধর্ম এটিকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতে বলে। যৌন সুখ গ্রহণের সাথে ধর্মের এই সংঘাত তৈরি হবার প্রধান কারণ হল মানুষের চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু যৌন সুখ থেকে সরিয়ে ধর্ম পালনের দিকে নিয়ে আসা। এই কাজটি করার জন্য ধর্ম প্রথমে নারীর উপরে অবরোধ চাপায়। তার রজস্রাবকে অপবিত্র হিসেবে চিহ্নিত করে, জন্মদানকে অশৌচ হিসেবে গন্য করে, নারীর যৌন সুখ গ্রহণের ক্ষমতা পুরুষের থেকে বেশি থাকায় সেটার জন্য তাকে ডাকিনী হিসেবে আখ্যায়িত করে। এভাবে ধর্ম যৌন প্রতিবন্ধতা তৈরি করে মানুষের স্বাভাবিক যৌন সুখের মনোযোগকে সংযমের দিকে নিয়ে যায়। ধার্মিকেরা এটি করার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম বিষয় হল- যৌন সুখ গ্রহণের ক্ষেত্রে নিজেদের অক্ষমতা, ধর্মীয় পাপবোধের ধারণার বিকাশ ও নিজেদের মধ্যে গোপন রাখা এক ধরণের অসৎ প্রবৃত্তি সমাজের উপরে চাপিয় দেয়া।

ধর্ম শুধু কৌমার্যের ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করেনি, তারা এটাকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য বিভিন্ন প্রতিরোধের ব্যবস্থাও করে রেখেছে। তার বড় একটি উদাহরণ নারীর জন্য চেস্টিটি বেল্ট বা যোনি বন্ধনী। মধ্যযুগে নারীকে সতীত্ব রক্ষার জন্য এটি পরানো হত। বিবাহিত নারীর ক্ষেত্রে এটি বেশি করা হলেও কুমারী মেয়েদের সুরক্ষার জন্য এটা দেয়া হতো। লোহা দিয়ে যোনি বন্ধনী এমনভাবে তৈরি করা হতো, যেন যোনিপথ আবদ্ধ থাকে এবং পেছনের দিকটি খোলা রাখা হয় মলমূত্র ত্যাগের জন্য। এই রকম একটি কঠিন বেল্ট নারীকে মাসের পর মাস পরে থাকতো হতো শুধু কৌমার্য ধরে রাখার জন্য। বিশেষ করে যখন এদের স্বামীরা বাণিজ্যের জন্য গৃহের বাইরে অবস্থান করতো, তখন অন্য কোন পুরুষের সাথে যৌন মিলন থেকে বিরত রাখার জন্য এভাবে আবদ্ধ রাখা হতো।

নারীর সতীত্বের আর একটি ধারণা হল তার সতীপর্দা (hymen) এর পরীক্ষা নেয়া। বহুযুগ আগ থেকেই সমাজে এর গুরুত্বে অপরিসীম। পুরুষের কৌমার্যকে প্রমাণিত করার কিছু নেই, কিন্তু নারীকে তার যোনিপর্দা অচ্ছেদ রেখে সেটা প্রমাণ করতে হয়েছে বারবার। নারীর শারীরিক গঠনের কারণে যেহেতু তার যোনিপর্দা তৈরি হয়, সেজন্য পুরুষতন্ত্র একমাত্র তার অক্ষত যোনিকেই সতী বা কুমারী হিসেবে ধরে নিয়েছে। পুরুষের কাছে কুমারী নারী মানে অধিকার অর্জন। পুরুষ যদি কোন নারীর সতীপর্দা ছিন্ন করতে পারে, তবে সেটাকে তার এক অবিসংবাদিত বিজয় অর্জন বলে মনে করে। একজন অক্ষত নারীকে অধিকার ও ভোগ করাকে সেজন্য পুরুষতন্ত্র মর্যাদা হিসেবে ধরে। সেজন্য কুমারীত্বের মূল্য সমাজে অনেক বেশি। এটি তার শারীরিক ও নৈতিক থাকার একমাত্র মানদন্ড। এমনকি কুমারী নারীরা দেবতাদেরও প্রিয়, দেবতারা তাদের ভোগের জন্য কুমারী মেয়েকের বলিদানকেই বেশি পছন্দ করেন।

যৌনতার আরেকটি বড় ট্যাবু হল বিয়ে (Marriage) ছাড়া যৌন সম্পর্ককে বাধাপ্রাপ্ত করা। নৃতাত্ত্বিক ও সমাজ তাত্ত্বিক ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে আজকের দিনের মনোগামি বিয়ের মাধ্যমে যৌন সম্পর্কের ধারণা ৫ হাজার বছর আগের বেশি নয়। সেক্ষেত্রে যদি আধুনিক মানবপ্রজাতির ইতিহাস ২ লক্ষ বছরের হয় তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, বিয়ে করে যৌন ক্রিয়া করার ইতিহাস যৌন ইতিহাসের মাত্র ২.৫ ভাগ ইতিহাস। এর বাইরের পুরোটা সময় মানুষ বিয়ে ছাড়াই যৌন ক্রিয়া করেছে। সেজন্য বিয়ে ছাড়া যৌন ক্রিয়া না করার জন্য আমরা যে আচ্ছন্নতা অনুভব করি, সেটি আসলে কয়েক হাজার বছরের পুরনো নিষেধাজ্ঞাকেই আমরা বহন করি। আধুনিক মানুষের যৌন ক্রিয়ার ক্ষেত্রে বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্পর্ক না করার বিধি আরোপ করা আদতে হাজার বছরের পুরনো প্রথাকে মেনে চলারই সমান। সন্তান উৎপাদনের জন্য দুইজন নারী-পুরুষ সুনির্দিষ্ট কিছু সামাজিক নীতমালা বা বাধ্যবাধকতা পালন করতে পারেন, কিন্তু যৌন ক্রিয়ায় মিলিত হবার জন্য কোন নৈতিক বিধান বা ট্যাবু পালন করা পশ্চাৎপদতা। এর কারণ যৌনাঙ্গের কাজ শুধু যৌন মিলনের ফলে সন্তান উৎপাদন করা নয়; অধিকন্তু এর কাজ হল ইন্দ্রিয় অনুভূতিকে সচল রাখা ও তাকে পরিতৃপ্ত করে নানা প্রকার স্নায়ুগ্রস্থ রোগ থেকে শরীর ও মনের সুরক্ষা দেয়া।

শালীনতা, নারী ও পুরুষের কৌমার্য ও বিয়ের ধারণা থেকে আমরা প্রত্যক্ষ করি যে সমাজে যৌন ক্রিয়া একটি জবরদস্তিমূলক কাঠামো দ্বারা নির্ধারিত হয়। এই কাঠামো আমাদের ওপর একধরণের নৈতিকরা আরোপ করে। কিন্তু যৌন সুখ বা যৌন ক্রিয়া নৈতিক কোন কার্যাবলী নয়, এটি শরীরবৃত্তীয় কাজ। যৌনতার ক্ষেত্রে আমরা দুই পক্ষের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার প্রতি সচেতন হতে পারি, বয়সের প্রতি সচেতন হতে পারি, স্বাস্থ্য ও কামনার প্রতি সংবেদনশীল হতে পারি কিন্তু এটির মানদন্ড কখনোই নৈতিকতা দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে না। শরীরের ভেতরের রেচন ক্রিয়া বা শ্বসন ক্রিয়া যেমন কোন প্রকার নৈতিকতার উপরে ভিত্তি করে ক্রিয়াশীল নয়, তেমনি যৌন ক্রিয়ার মাধ্যমে গিয়ে যৌন সুখ গ্রহণের বিষয়টিও নৈতিকতার উপর নির্ভরশীল নয়। যৌন ক্রিয়া মূলত একটি ইহজাগতিক উপাদান। শরীরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। খাদ্য গ্রহণের মতো এটি একটি জৈবিক প্রক্রিয়া। আবার হাত, পা বা মুখের মতো যৌনাঙ্গও একটি শারীরিক উপাদান। অন্যান্য অঙ্গের মতো যৌনাঙ্গও উন্মুক্ত রাখা বা না রাখার সাথে বিশেষ কোন নৈতিক বিধান আরোপিত হওয়া অপ্রয়োজনীয়। নৈতিক বিধানের দোহাই দিয়ে সেটার উপরে অবরোধ চাপিয়ে যৌন সুখ থেকে বঞ্চিত রাখা মূলত আদিম সমাজের ট্যাবুর একটি সম্প্রসারণ। এক কথায়, যৌনতার ক্ষেত্রে নৈতিকতা আরোপ মানেই হল ক্রমাগত অবদমন তৈরি করা। এই অবদমিত চিন্তা ব্যক্তির মনের ভেতরে ক্রিয়া করে এবং এই অবদমন নির্গমনের রাস্তা যদি খুঁজে না পায়, তাহলে যে কোন পথেই সে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। সমাজে যৌনতা সংক্রান্ত সকল অপরাধের দায় এর উপরেই বর্তায়।

আমাদের আজকের দিনে এই অবদমন এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, যৌনতা রীতিমত একটি উগ্রপন্থি ধারণা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমরা এই বিষয়টি প্রত্যক্ষ করি সমকামী নারী পুরুষের ক্ষেত্রে, বিয়ে ছাড়া কেউ যৌন সম্পর্ক স্থাপণ করলে, ভিন্ন ধর্মের নারী বা পুরুষ যৌন সম্পর্ক বা বিয়ে করলে, বয়সের দিক থেকে সিনিয়র কোন নারী বা পুরুষ যৌন সম্পর্কের দিকে গেলে। এমনকি আমাদের আইনি বিধান ও ধর্মীয় বিধান যখন এসব সম্পর্কের বিচার করতে আসে, তখন তারা ব্যক্তির উপরে এমনভাবে আক্রমণ করে যেন কোন গর্হিত কাজ করা হয়েছে। যৌন সম্পর্কের যতগুলো দিক আছে, এর কোনটিই কাউকে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি না করলে বা তৃতীয় কোন পক্ষের উপর আঘাত না হওয়া পর্যন্ত কারো যৌনতার উপরে অবরোধ চাপিয়ে দেয়া যৌন মৌলবাদীতা।

যৌন সুখ মানুষের মৌলিক আনন্দ, এটি সুরক্ষিত থাকা উচিত। সকল দাবীর মতো নারী পুরুষের যৌন সম্পর্ককে যৌনমৌলবাদীতা থেকে রক্ষা করার আলোচনা-সমালোচনা সমাজে প্রসারিত হোক।

কাজল দাস, অনলাইন এক্টিভিস্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ