টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জহিরুল হক বাপি | ২৮ মে, ২০১৭
ধর্ম ব্যবসায়ীরা খুব ভালো ভাবেই আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মৌলবাদীতা ছড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের দেশের জনগোষ্ঠীর বড় অংশই প্রান্তিক জনগন, খেটে খাওয়া মানুষ। আর এ অঞ্চলের অধিবাসীরা ধার্মিক, সে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান যেই হোক না কেন। এই খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষগুলো ছোট বেলায় মসজিদ, মক্তবে কিছু সুরা মুখস্ত করে, আরবি অক্ষর পড়তে শেখে। কিন্তু অর্থ কিছুই জানে না। শুধু সাধারণ মানুষ না, মাদ্রাসার বেশির ভাগই আরবির অর্থ জানে না। আর তাই আমাদের ধর্ম পালন অন্যের মুখের সিগারেটের ধোঁয়া খাওয়ার মতোই। হুজুরের কাছে বেহেশতের দুয়ার। হুজুর যা বলে, সেটাই ধর্ম। ধর্ম ব্যাবসায়ীরা এ সুযোগ নিয়েছে খোলাখুলি। তাদের যেহেতু মানুষ বিশ্বাস করে, তারা তাদের মতো করে মানুষকে বুঝিয়েছে, বিপথে নিয়ে তাদের ব্যবসা সফল করেছে। বিদেশি পেট্রোডলারের স্রোতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হুজুরেরা ভেসে গেছে ধর্মব্যবসায়ীদের পথেই। এখন ধর্ম, রাজনীতি, সংসার, শিক্ষা সব জায়গায় ধর্মের প্রভাব কিন্তু ধর্মটাই নাই।
একটা উদাহরণ দেই। আমি বহুবার শুনেছি, নামাজের গুনাহের মাফ নাই। যা করি-না করি কিন্তু নামাজ ঠিক রাখতেই হবে। আমার মতো অনেকেই এ বাক্যটি শুনেছেন। এটি প্রচলিত। এর প্রভাব, ক্যারিশমার উদাহরণ চারপাশে ভুরি ভুরি।
২/৩ দিন আগের একটা টিভি রিপোর্টের ঘটনা বলি। ভূমি অফিসের ঘটনা। পায়জামা-পাঞ্জাবী-টুপি-দাড়িওয়ালা বয়স্ক কর্মচারি। কপালে নামাজের চিহ্ন জ্বলজ্বলে। তিনি গোপন ক্যামেরায় ধরা খেলেন ২০০ টাকা ঘুষ নিয়ে। ধরা না খেলে তিনি এ টাকা পকেটে নিয়েই নামাজে দাঁড়াতেন, বাসায় যাওয়ার সময় হয়তো বাজার সদাই করে নিতেন। বাসায় গিয়ে ছেলে-মেয়ে-স্ত্রীকে দাবড় দিতেন নামাজ পড়ার জন্য, সৎ পথে থাকার জন্য। তিনি যেহেতু নামাজ পড়েন নিয়মিত, সুন্নত পালন করেন, তাই তার সব ঠিক আছে। ধর্ম ব্যবসায়ীরা কিছু বাক্য প্রচার করে মানুষকে বিপথে নিয়ে গেছে আরামেই। ঘুষের টাকা, নারী ব্যবসার টাকা, মাদকের টাকা হরহামেশাই মসজিদে ঢুকছে, মাদ্রাসায় ঢুকছে। নাজায়েজ টাকা মসজিদে দান করলেই, মাদ্রাসায় দান করলেই যেন জায়েজ। আর ধর্মীয় ঈমাম, মসজিদ কমিটি, মাদ্রাসা কমিটি যেহেতু এ সকল দানশীল ব্যক্তি, ধার্মিককে (?!) অতীব সম্মান করে, তাই সহজে সাধারণ, সরল মানুষও প্রভাবিত হয়। মুখে মুখে ধর্মের কথা বলে তারা ধার্মিক ভাবতে শুরু করে নিজেকে। এটা তাদের দোষ না। তাদের সরলতার সুযোগ নিয়ে তাদের এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে। তাদের কি এমনি এমনি এমন করা হয়েছে শত কোটি টাকার প্রচার আর বহু বছরের চেষ্টায়? মোটেও না। এর মূল কারণ রাজনীতি, ক্ষমতা, অর্থ।
এ ধর্মীয় রাজনীতির বেড়াজালে এখন আমরা অস্থির 'জাস্টিসিয়া' নিয়ে। ক’টা প্রশ্ন কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে।
আমাদের অবস্থা এখন এত খারাপ যে আমরা সব জায়গায় ইসলামের অবমাননা খুঁজি। আসলে আমরা খুঁজি না, আমাদের খুঁচিয়ে খোঁজানো হয়। আমরা ধর্মব্যবসায়ীদের রোবট। বই মেলার কথা ভাবেন। জাফর ইকবালের একটি শিশুতোষ উপন্যাসের নাম ছিল 'ভূতের বাচ্চা সোলায়মান'। সোলায়মান নামটি ব্যবহারে নাকি ইসলামের অবমাননা হয়েছে। বই 'অফ' করো। অদ্ভূত! এখন কেউ একজন যদি লেখে - তোমারে ভালোবাসি মর্জিনা। তাহলেও তো ইসলাম অবমাননা হবে। যদি হিন্দু নাম ব্যবহার করা হয়, তাহলে হিন্দু ধর্মও তো অবমাননা হয়। ধর্ম কি এতই ঠুনকো যে একটি শিশুতোষ উপন্যাসে একটা নাম ব্যবহার করলেই ধর্মের অবমাননা হবে? যদি তাই হতো, তবে যে কোন ধর্মই বিলীন হয়ে যেত এত বছরে। এ উপসর্গ দেখা দিয়েছে সদ্য।
সাধারণ বিভ্রান্ত মানুষকে আমরা মৌলবাদী বলে গালি দিতেই পারি। এটা কি কোন সমাধান? সাধারণ মানুষগুলোকে সঠিক পথে আনার জন্য, ধর্মব্যবসায়ীদের শিকারের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য কতটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে? তাদের বিভ্রান্ত মগজকে সুস্থ করার জন্য কতটুকু একাডেমিক শিক্ষা, প্রচার, সঠিক ধর্মীয় শিক্ষা প্রচার করা হচ্ছে? হচ্ছে না বা যতটুকু হচ্ছে তা গোনায় পড়ে না।
উপরের এতকথা লিখলাম জাস্টিসিয়ার কারণে। জাস্টিসিয়া কি কোন ঝামেলা তৈরি করার জন্য তৈরি করা হয়েছে? না হলে এ স্পর্শকাতর সময়ে হাইকোর্ট, জাতীয় ঈদগাহের সামনে বসানো হলো কেন? যেখানে সোলায়মান নাম ব্যবহার করার জন্য একটি শিশুতোষ উপন্যাস বিক্রি বন্ধ করে দিতে হয়। জমি তৈরি করার আগে বীজ বুনলে ফসল ভালো হয় না, অনেক সময় জমি নষ্ট হয়। জাস্টিসিয়া বসানোর পর পর এক প্রবাসী বন্ধুর সাথে আলাপকালে সে নিশ্চিন্তে বলেছিল, এটা নিয়ে গ্যাঞ্জাম শুরু হবেই হবে। বন্ধুটি আগে আওয়ামী লীগ, পরে মানুষ। তার কথা শতভাগ ঠিক হয়েছে। লেডি জাস্টিসিয়া বসানো হলো, ধর্ম ব্যবসায়ীরা ইস্যু পেল। সরকার বেকায়দায়। সাধারণ মানুষ ঐ ধর্ম ব্যবসায়ীদের পথে বিভ্রান্ত হয়ে হাঁটছে তো আগে থেকেই।
জাস্টিসিয়া সরানো হলো । সাধারণ মানুষের আরেকটা অংশ ক্ষেপে গেল। সরকার আবারও জনতার রোষানলে। জাস্টিসিয়া নিয়া সরকারের অবস্থা জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি জাস্টিসিয়া বসানোর জন্য বলেছিলেন? কোথায় কোন ভাস্কর্য বসবে এ নিয়ে ভাবার কি তাঁর সময় আছে? কিন্তু দোষ পড়লো তাঁর। উচ্ছেদের পর সরকারি দল থেকে জানানো হলো, জাস্টিসিয়া অপসারণ করা হয়েছে প্রধান বিচারপতির নির্দেশে। এটা তার এখতিয়ার। অন্যদিকে হেফাজত, খেলাফত মজলিস টিভি, পত্রিকা, মিছিলে বারবার ধন্যবাদ দিচ্ছে সরকারকে, প্রধানমন্ত্রীকে। এতে স্বাভাবিকভাবে ক্ষুব্ধ হলো সাধারণ মানুষ। সব দায় প্রধানমন্ত্রীর! সব দায় আওয়ামী লীগের! আওয়ামী লীগ বলছে, এটা প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্ত, হেফাজতিরা বলছে এটা প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত। জনতার রোষানলে সরকার-প্রধানমন্ত্রী। কি সূক্ষ রাজনীতি। সফল দাবার চাল। রাজনীতির এ ফাঁদে ক্ষতিগ্রস্ত হলো বাঙালিয়ানা। সরকারের অবস্থা শ্যাম রাখি না কুল রাখি।
মৌলবাদী রাষ্ট্র হিসাবে চিহ্নিত করার জন্য, বর্তমান সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য জাতীয়, আন্তর্জাতিক চেষ্টার কোন ত্রুটি নাই। সরকার যত বিব্রত হবে তত বেশি অপাংক্তেয় হবে। জাস্টিসিয়া নিয়ে তাই হয়েছে। জাস্টিসিয়া সরানোতে বাঙালিয়ানা নতজানু হলো। সব দিকে জাস্টিসিয়া রাজনীতি সফল।
সরকারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আছে লোভী আর অসৎ মানুষেরা। স্রোতের মত জামাত-শিবির ঢুকছে আওয়ামী লীগে। যে সব মন্ত্রী-এমপি এদের দলে ঢোকাচ্ছে, পদ-পদবী দিচ্ছে, তারা কি এমনি এমনি এসব করছে? নাহ। টাকার গরম বড় গরম। সেই গরমে তারা নরম হয়ে বাঙালিকে, তাদের রাজনৈতিক দলকে চরম বিপদে ফেলছে পরম যত্নে।
জাস্টিসিয়া যেখানে বসানো হয়েছিল, সেখানেই আবার স্থাপন করা উচিত। না হলে পরাজয় বাঙালির। এর সাথে খুঁজে বের করা জরুরি এর পেছনে কারা কারা আছে। এ খেলার গেইম মেকার কারা? না হলে এমন চলতেই থাকবে। সরকার চোরাবালিতে আরও ডুবে যাবে। তাদের ডোবাতে পারলে শুধু জাস্টিসিয়া নয়, কোর্টই এরা সরিয়ে দেবে। সেখানে স্থাপিত হবে শরীয়া বোর্ড।
শেষ করি অভিজ্ঞতা থেকে আশা নিয়ে।
অপারেশন বিগ বার্ড- ২৫ মার্চ রাত, ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার।
অপারেশন ক্র্যাক ডাউন- ২৫ মার্চ রাত, ১৯৭১। বাংলাদেশ গ্রেপ্তার ।
অপারেশন জাস্টিসিয়া- ২৬ মে রাত, ২০১৭ । বাঙালিয়ানা গ্রেপ্তার।
বাঙালি বারবার আক্রান্ত হয়েছে রাতের আঁধারে। কিন্তু এরপর তারা পুরো ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধু আর্ন্তজাতিক সম্মান নিয়ে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরেছেন। বাঙালি নয় মাসে দেশ স্বাধীন করে ফেলেছে। ইতিহাস থেকে আশা করি, বাঙালিয়ানা পুরো মুক্ত হবে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য