প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
আজমিনা আফরিন তোড়া | ০২ আগস্ট, ২০১৭
ক’দিন আগে সকালে উঠে খবর পেলাম আমার এক বন্ধু মারা গেছে। কতই আর বয়স হবে তার, তেইশ কিংবা চব্বিশ? দারুণ মেধাবী ছিল ও। সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। বাবা মা চকচকে স্বপ্ন চোখে সবাইকে বলে বেড়াতেন, “তৌহিদ টা বরাবরই অংকে ভাল। তাই কি না ইঞ্জিনিয়ারিং সাবজেক্ট পেয়েও গণিত বিভাগেই ভর্তি হল শেষমেশ। দোয়া করবেন ওর জন্য। দ্রুতই বের হবে ও। এই তো শেষ প্রায়, এখন চতুর্থ বর্ষ চলছে”।
তৌহিদের আর শেষ হল না চতুর্থ বর্ষে পড়া। চিরকালের জন্য চতুর্থ বর্ষের ছাত্র হয়েই মারা গেল হার্ট অ্যাটাকে এ।
সবাই তৌহিদের মৃত্যু স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিচ্ছে। দু’চারজন ফোন দিয়ে আহা উহু করছে। অনেকের ধারণা এটা সুইসাইড কেস কি না, তাই ফোন করে নিশ্চিত হতে শোনে নিচ্ছে আসল ঘটনা। আসল ঘটনা হার্ট অ্যাটাকে শোনে সবাই হৃষ্টচিত্তে ভাবছে যাক, আত্মহত্যা অন্তত করেনি।
সবাই যেই মৃত্যুকে স্বাভাবিক ঘটনা বলে চালিয়ে দিচ্ছেন সেই মৃত্যুকে আমি কিন্তু স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারি না। তৌহিদ কে হত্যা করা হয়েছে, এমন হাজার হাজার তৌহিদ হত্যা হচ্ছে আমাদেরই চোখের সামনে প্রতিনিয়ত। আমরা কেউ তার খবর রাখছি না, কারণ তারা আত্মহত্যা করছে না। হয় তাদের স্বাভাবিক ভাবে মৃত্যু হচ্ছে, নয়ত তারা নাম মাত্র শরীরের খোলস নিয়ে বেঁচে থাকছে আমাদেরই মত তথাকথিত স্বাভাবিক মানুষের ভিড়ে।
ছেলেটার দেহঘড়ি (হৃদপিণ্ড) দীর্ঘদিন দিন ধরেই আক্রান্ত, তা তার বা তার পরিবারের কারোই অজানা ছিল না। অথচ কোন বিশেষ কারণে তা নিয়ে ব্যাপক অসচেতনতা তৌহিদের। জানি, নিন্দুকেরা বলবে তাতে কার কি দোষ! যার ব্যথা সে না ব্যথিত হলে কার কি আসে যায়। কিন্তু সত্যিই কি তাই? আমাদের কি কিছুই আসে যায় না? তৌহিদের মত মেধাবীরা জীবনের প্রতি আশা হারিয়ে কি বেপরোয়া জীবন কাটাচ্ছে তা সবার জানার কথা না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের জগতের মানুষদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় গুলো এক একটা স্বপ্নের নাম। যারা ভর্তি যুদ্ধে হাজার কষ্টে এ পথ মাড়াতে পারে না, তারা থেকে শুরু করে যে রিকশাওয়ালা ভার্সিটি গেটে রিক্সা চালায় তার চোখেও বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে স্বপ্ন খেলা করে। সেও মাস শেষে জমানো সামান্য পুঁজি দিয়ে সন্তানকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর স্বপ্ন দেখে। অথচ সেই সাধারণ কিংবা অসাধারণ মানুষগুলো জানে না, বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার কিছু দিনের মধ্যেই কি করুণ ভাবে ছাত্রছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে দেখা স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে যায়!
প্রথম হতাশাটা আসে নিজের বিভাগ নিয়ে। দেশের বেশীরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই অভিজ্ঞ শিক্ষকের বড়ই অভাব। যারাও বা দেশের টানে মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকেন, চান ছাত্রদের দ্বারা ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের। সবকিছুর পর দেখা যায় যেই পড়াশোনার জন্য আসা এতদূর, সেই ক্লাস পরীক্ষা সময় মত হয় না। সেখানেও দেখা যায় শিক্ষকদের সর্বোচ্চ স্বেচ্ছাচারিতা, তারা চাইলে ক্লাস পরীক্ষা নেবেন, না চাইলে একজন ছাত্রকে আটকে রাখবেন বছরের পর বছর। নিজেদের মাঝের দলাদলির জন্য নিম্নবিত্ত ছাত্রদেরও পড়তে হবে সেশনজটে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়ার চাপে প্রকাশ হবে না পরীক্ষার ফলাফল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের যেখানে দিন রাত গবেষণা নিয়ে পড়ে থাকার কথা সেখানে একজন ছাত্র যখন দেখে সকালে ঘুম থেকে উঠে তার কোন কাজ নেই, না আছে ক্লাসে যাবার তাড়া, অথবা তাড়া থাকলেও ক্লাসে সে শত মনোযোগ দিয়েও কোন পড়াই মাথায় ঢোকাতে পারে না, যেখানে নেই নিজেকে কোন সৃজনশীল কাজে যুক্ত করবার সুযোগ সেখানে কেন একটা ছেলে দিন রাত গাঁজার নেশায় বুদ হয়ে থাকবে না?
এই দায় তার , না যারা তাকে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার কথা দিয়ে এতদূর নিয়ে এল তাদের?
আমার এক বন্ধু, কেউ বিশ্বাস করবে কি না জানি না, একবার উদ্যোগ নিলো টেলিস্কোপ বানাবে। দেশি জিনিসপত্র দিয়ে দেশী কায়দায় আন্তর্জাতিক মানের টেলিস্কোপ। সব হিসাব নিকাশ , মাপ যোগ শেষে লেন্স কিনে এনে বিশেষ পদ্ধতিতে ঘষে মাপ মত গ্রাফটিং করে যখন প্রায় অর্ধেক কাজ শেষ তখন কেবল মাত্র সহযোগিতার অভাবে তার কাজ আশার মুখ দেখতে পারল না। শত দরজায় কড়া নেড়েও কেবল হতাশার বাণী ছাড়া তার ঝুলি আর কিছুতে ভরেনি। গণিত বিভাগের এক সহপাঠী, একবার দেখলাম বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের কাছে ধারণা দিতে। কারণ জিজ্ঞেস করে জানলাম সে নিজ উদ্যোগে একটা গবেষণাপত্র তৈরি করে ফেলেছে কিন্তু কিভাবে প্রকাশ করতে হবে তা জানা নেই। শিক্ষকদের সাহায্য চাইছে অথচ কোন বিভাগের কোন শিক্ষক ই রাজি হচ্ছেন না সহযোগিতা করতে। শেষমেশ তার নিজের বিভাগের এক শিক্ষিকা রাজি হলেন ঠিকই, কিন্তু শর্ত দিলেন যাতে গবেষণা পত্রের মূল গবেষক হিসেবে সেই শিক্ষিকার নাম দেয়া হয়, সাথে সান্ত্বনা হিসেবে বন্ধুর নামটি যাবে সহযোগী গবেষক হিসেবে। শেষমেশ ঐ বন্ধু কি করেছিলো জানা নেই।
সমস্যা আসলে শুধু আমাদের শিক্ষকদের না। ঘুণে ধরা আমাদের পুরো রাষ্ট্র কাঠামো, দেশের ভেতর আর এক স্বাধীন সার্বভৌম দেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি স্তরে স্তরে। এখানে হলগুলোতে ফ্যান দেয়া হয় না, ছাদের গেট বন্ধ রাখা হয় ছাত্রছাত্রীরা যাতে আত্মহত্যা করার সুযোগ না পায়। অথচ সেই আত্মহত্যার পথ থেকে ছাত্রছাত্রীদের সরিয়ে আনার জন্য নেই কোন উদ্যোগ, নেই কোন কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা। একবার একটা ছেলে সাঁতার না জানায় হলের পুকুরে ডুবে মারা গেল। অথচ প্রশাসন না ব্যবস্থা করল একটা স্থায়ী সুইমিং পুলের, না ওই খাদে ভরা ঝুঁকিপূর্ণ পুকুরকে সাঁতার না জানা জনসাধারণের জন্য নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করল! কারোই যেন কোথাও কোন দায়বদ্ধতা নেই। মুখে বলেন প্রাণের ছাত্রছাত্রী, কিন্তু সেই ছাত্রছাত্রীদের প্রাণের মায়া বাড়াবার, জীবনকে ভালবাসতে শেখাবার ন্যুনতম প্রচেষ্টা গত ৫ বছরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রশাসন বা শিক্ষকদের কারো মাঝ থেকে অন্তত আমার চোখে পড়েনি। এই নীতি নিয়ে বাবা মার সমতুল্য বা লোকাল গার্ডিয়ান বলে নিজেকে দাবী করাটা ঠিক মানায় না। এর চেয়ে বরং আমাদের প্রাইমারির শিক্ষকরা আমাদের ঢের বেশী সাহায্য করেছেন জীবন গড়তে, বাস্তবমুখী শিক্ষায়।
আজ ৫ বছরের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে পেছনে ফিরে ভাবি সেই প্রথম দিনের বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন বরণ আয়োজনের কথা।সেদিনকার সামনের সারিতে বসা প্রতিটা মুখ কত কত স্বপ্নের বীজ রোপণ করেছিলেন প্রায় ১৩০০ ছাত্রছাত্রীর মনে। আজ বড় ইচ্ছে হয় তাদের কাছে জবাবদিহিতা চাইতে, কোথায় গেল আমাদের সেই স্বপ্ন, কোথায় গেল আপনাদের মুখের বড় বড় বুলি! কিন্তু অক্ষম লজ্জায় আমার কুঁকড়ে যেতে ইচ্ছে করে...
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য