প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ | ১৭ আগস্ট, ২০১৭
বাংলা নাটককে যিনি প্রচলিত ধারা থেকে বের করে এনে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংমিশ্রণে নবরূপে ও ভিন্নমাত্রায় প্রাণবন্ত করেছিলেন তিনি সেলিম আল দীন। তার অভিসন্দর্ভ ‘মধ্যযুগের বাঙলানাট্য’ পাঠ করলে নাটক সম্বন্ধে চিরাচরিত নিয়ম ভেঙে যায়। পাঁচালীরীতিতে লেখা তার নাটক বাংলায় নতুন না হলেও উপস্থাপন রীতি প্রসেনিয়াম নাটকে প্রথম। তার কোন নাটকের মঞ্চ কেমন হবে তা আগে কখনোই বুঝা যেত না। এই প্রথা ভাঙতে তাকে বহু বাধা অতিক্রম করে আসতে হয়েছে।
নীরিক্ষাধর্মী কাজের ক্ষেত্রে আলোচনা কিংবা সমালোচনা থাকে, তার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ছিলো না। প্রজ্ঞা, চিন্তার প্রগ্রসরতা তাকে সেই পথ পেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছে। তাছাড়া নাটক ছাড়া ভিন্ন কোন চিন্তা না থাকার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে।
তিনি ছিলেন আবহমান বাংলানাট্যের এক প্রবাদপ্রতিম দ্রষ্টা। তিনি শুধু নাট্য স্রষ্টাই নন, দ্রষ্টা। এ কারণে তিনি দ্রষ্টা যে, তিনি বাংলা হাজার বছরের সংস্কৃতির মাঝে ঘুমিয়ে থাকা নাট্যরীতির সম্বন্ধ সমূহের আবিষ্কারক। এ ধরনের এক মৌলিক, স্থায়ী ও আপাতবিচ্ছিন্ন এক যোগসূত্রের মর্মস্থল তিনি আমাদের দেখানোর জন্য উদ্যমী ছিলেন। অয়ন গঙ্গোপাধ্যায় ‘সেলিম আল দীনের নাটক’ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন, “বাংলা নাটকের উৎপত্তি ও বিবর্তন সম্পর্কে বলতে গিয়ে সেলিম ব্যবহার করেন ‘ভারতবর্ষ’ ও ’ইংরেজ শাসনামল’ এই দুই শব্দবন্ধ।
লক্ষ্য করার মতো বিষয় হলো এই দুই শব্দবন্ধ এক বিশেষ ঐতিহাসিক সত্যের দিকেই আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে চাইছে। অন্য একটি পৃথক জাতি-রাষ্ট্রের ইতিহাসের কথাই যেন বলতে চাইছে। বলতে চাইছে ’৪৭ নয় স্বাধীনতা, দেশবিভাগও; সংস্কৃতিও কি দেশবিভাগে বিভক্ত? সেলিম লিখছেন বাংলায়, তার লেখা নাটকগুলোতে বাংলা নাটকের প্রতি দায়বদ্ধতাই পরিলক্ষিত হয়। তাহলে, একদিকে থাকছে বিভক্ত দু’টি আলাদা জাতি-রাষ্ট্রের তথাকথিত উত্তর-ঔপনিবেশিক ইতিহাস। অন্যদিকে থাকছে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের প্রশ্ন, স্মৃতির প্রশ্ন, স্মৃতির ক্ষেত্রটিকে জাগিয়ে তোলার প্রশ্ন। ভুলে যাওয়া এবং এখনও অপস্রিয়মাণ মান ওই সব লোকজ নাট্যরীতিগুলোকে ফিরিয়ে আনতে চাইছেন নাট্যকার সেলিম আল দীন।
বস্তুত বাঙালির হাজার বছরের নাট্য ইতিহাসের ছিন্নসূত্রকে তিনি তার সৃজনশীলতার আঁভগার্দের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করার নিরন্তর প্রয়াসে লিপ্ত থেকেছিলেন।
১৯৭২ সাল। স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে সেলিম আল দীন ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’ নাটকটি লিখেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হল থেকে নাটকটি মঞ্চস্থ করা হয়। নাসিরুদ্দিন ইউসুফ এই নাটকের নির্দেশক ছিলেন। অ্যাবসার্ড থিয়েটারের চিন্তাচেতনা থেকেই এ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। বলাবাহুল্য, সেই যে শুরু তারপর সেলিম আল দীন ও নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের ইতিহাসে দু’জনের যুগলমিলনে এক অবিচ্ছেদ্য নাট্য নামের সূচনা হয়। সুদীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে তারা দু’জন সৃষ্টিশীলতার এক অপরূপ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। একজন অবিরাম রচনা করেছেন, অপরজন বিশাল বিরতিহীন নির্দেশনা দিয়েছেন।
১৯৭৩ সালে তাদেরই অভেদজ্ঞানের ক্যানভাসরূপে ঢাকা থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয়। মঞ্চস্থ হয় জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন, বিদায় মোনালিসা কিংবা সংবাদ কার্টুন। কিন্তু তখনও বাকি ছিল চেতনার পরিশোধন ও পরিশীলন।
১৯৭৬ সালে মঞ্চস্থ হয় ‘মুনতাসির ফ্যান্টাসি’ এরপর ‘শকুন্তলা।’ আগেরটি পাশ্চাত্য স্যাটায়ার ধর্মী নাট্যরীতি। ভুঁইফোঁড় বিত্তবান শহুরে মানুষের ফাঁপা ইনসিপিড জীবন বোধের উপর তৈরি। যা ঠিক ‘প্রহসন’ও নয়। ‘শকুন্তলায়’ সেলিম মিথকে ভেঙে এক অনাবরণ ন্যারেটিভ স্টাইল সঞ্চারিত করেছেন। বস্তুত সেলিম তার কাঙ্ক্ষিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এক ধরনের বাঁক নেয়ার প্রয়াসে লিপ্ত থেকে ছিলেন।
প্রসঙ্গত, উইলিয়াম জোনস অনূদিত কালিদাসের ‘শকুন্তলা’ বাংলার রূপান্তরিত হয় ‘শকুন্তলার’ মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বিনোদিনী দাসী। বাংলা মঞ্চ নাটকের সেই কিংবদন্তিতুল্য নারী অভিনেত্রী ‘নটি বিনোদিনী।’ সেই বিনোদিনী দাসীর স্মৃতিতেই সেলিম উৎসর্গ করেছিলেন তার ‘শকুন্তলা’-কে। সেলিম আল দীন সম্ভবত এই প্রথম অদৃশ্যকে দেখার, শ্রুতকে শোনার, সেই ‘স্রষ্টার’ ভূমিকায় বাঁক নিলেন। ‘শকুন্তলাই’ বস্তুত তার প্রথম টার্নিং পয়েন্ট। এই নাটক আমাদের কখনও কালিদাসের প্রাচীনতম অমরাবতীর নাটকটিকে মনে করায় না। তিনি এটাকে একটি বঞ্চনার গল্পে রূপান্তরিত করেন। স্বর্গীয় এক চক্রান্তের শিকার শকুন্তলা যখন বুঝতে পারে তার জন্মের বৃত্তান্ত, তখনি সে কুপিত হয় নিজের এই দেহটির পরে। কিন্তু নিঃসীম ব্যর্থতায় সে অনুভব করে কী ভয়াবহ নিঃসঙ্গ এক রিক্ততা।
‘ষড়যন্ত্র’ ও ‘শকুন্তলা’-এই দুই খণ্ডে তিনি নাটকটিকে ভাগ করেছেন। পুরাণের গল্পের অংশটিকে অপরিবর্তিত রেখেছেন। সমগ্র ঘটনায় ধরা পড়ে এক অবহেলিত নারীরই চিরায়ত বঞ্চনার কথা।
নাট্যকার সেলিম আল দীন পরীক্ষার এই পুলসেরাত পার হওয়ার পথে আর কখনও পিছনে ফিরে তাকাননি। সাহসী হয়েছিলেন দুর্মরভাবে আপন আত্মার অনারবরণ উন্মোচনে। এরপর বাঙালি শিল্প চেতনার রসে বশে নির্মাণ করলেন এক বিশালকায় নাট্য ক্যানভাস। ‘কীর্তনখোলা’ বহতা স্রোতে ঐতিহ্যসন্ধানী সূত্রগুলো হাতড়ে বেড়িয়েছেন। এ নাটকেও লক্ষ্য করা যায় নারী নির্যাতনের এক ভিন্নধর্মী লক্ষণ। গ্রামীণ এক যাত্রাদলের কর্তা সুবল ঘোষ ইচ্ছে পোষণ করেন যে, তার দলের মেয়েরা এলাকার মাতব্বরদের রাত্রিকালীন বিনোদনে স্বেচ্ছায় অংশ নিক। যাত্রাদলের নিরাপত্তার স্বার্থে তার এই আপোসকামিতায় মেয়েরা প্রতিবাদী হয়। এভাবেই নাটকে একদিকে কীর্তনখোলার জনমানুষের জীবন, শিল্প, যৌনতা ও নৈতিকতাকে প্রকাশ করেন।
হাজার বছরের প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের ক্রম ধারায় নাট্যচর্চা বহমান ছিলো। এই নাট্যরীতি ক্রম বিবর্তনের পথ ধরে এগিয়েছিলো। এতে শুধু যে নাট্যরীতির পরিবর্তন ঘটেছিল তা নয়, বরং তা ভাষারও সংস্কার সাধন করেছিল।
প্রথা ভাঙার এ সাহস ও যোগ্যতা সেলিম আল দীন অর্জন করেছিলেন। মান্দি সম্প্রদায় তার ‘বনপাংশুল’ নাটকের উপজীব্য। নাটকের অনেক বক্তব্য এখনও অনেকের কানে অনুরণনিত হয়।
১৮ আগস্ট। আবহমান বাংলানাট্যের প্রবাদপ্রতিম দ্রষ্টা সেলিম আল দীন-এর জন্মদিন। ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট ফেনী জেলার অন্তর্গত সোনাগাজী থানার সেনের খালি গ্রামে তিনি জন্মেছিলেন তিনি। নাট্যাচার্যের জন্মদিনে আমাদের গভীর শ্রদ্ধা এবং অফুরান ভালোবাসা।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য