ডেস্ক রিপোর্ট

১৯ ফেব্রুয়ারি , ২০১৫ ২২:৩৮

আইসিটি বিষয়ে রবার্টসনের রিপোর্ট নিয়ে আইসিআরএফ-এর বিবৃতি

বাংলাদেশে চলমান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে জিওফ্রী রবার্টসন কিউসি’র ১২৬ পাতার রিপোর্ট এবং বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে আইসিআরএফ। প্রতিক্রিয়া হুবহু তুলে ধরা হলো:

গত ১৭-ই ফেব্রুয়ারী ২০১৫ তারিখে ব্রিটিশ ও অস্ট্রেলিয়ান আইনজীবি জনাব জিওফ্রী রবার্টসন বাংলাদেশের চলমান আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচার প্রক্রিয়া, পদ্ধতি, আইন ও বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে ১২৬ পাতার একটি তথাকথিত রিপোর্ট প্রকাশ করেন।

এই রিপোর্টকে তিনি স্বাধীন, নির্মোহ এবং ট্রাইবুনালের জন্য অবশ্য পালনীয় বলেও উল্লেখ করেন তার রিপোর্টে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস রিসার্চ ফাউন্ডেশন [আই সি আর এফ] জনাব রবার্টসনের এই রিপোর্ট পুরো পড়েছে এবং এই পাঠ প্রতিক্রিয়ার অংশ হিসেবে এই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করছে। যদিও ICRF জনাব রবার্টসনের এই রিপোর্টের পরিপূর্ণ উত্তর সংক্ষিপ্ত সময়ের ভেতর প্রকাশ করবার ইচ্ছে রাখে।

একটি তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে ICRF বলতে চায় যে এই রিপোর্টের মত এমন বায়াসড, এক পক্ষীয় এবং ভুল ইতিহাসে ভরা রিপোর্ট, বিশেষ করে এই আলোচ্য ট্রাইবুনালের উপর, ICRF এর আগে কখনো প্রত্যক্ষ করেনি। জনাব রবার্টসন একটি সার্বভৌম দেশের, সার্বভৌম আদালতকে আদেশ সূচক নির্দেশও দিয়েছেন শুধুমাত্র তার লিখিত একটি বইকে এই ট্রাইবুনাল তার প্রথম মামলার কিছু ক্ষেত্রে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছে বলে।

এই প্রেক্ষিতে তিনি তার নিজের অবস্থান এবং সেই অবস্থানের যুক্তিকে কতটা হাস্যকর করেছেন তার বক্তব্যের মাধ্যমে সেটি বিষ্ময়করভাবে ফুটে উঠেছে তার প্রকাশিত তথাকথিত রিপোর্টেই। তিনি তার রিপোর্টে বলেন-
“It was repeatedly cited as authoritative by the Supreme Court of Bangladesh in the first case decided by the Tribunal. For that reason alone, Mr Robertson’s opinion must be taken seriously by the government and the legal establishment of Bangladesh”,

জনাব রবার্টসনের একটি বই থেকে ইন্টারন্যশনাল ক্রাইমস ট্রাইবুনাল কয়েকবার সাইট করেছে বলেই তার বক্তব্যকে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভাবে গ্রহন করতে হবে, এই জাতীয় বক্তব্য অত্যন্ত বালখিল্য ও শিশুসুলভ আচরণ। ICRF মনে করে এটি একটি সার্বভৌম দেশ ও আদালতের প্রতি অত্যন্ত অবমাননাকর আচরণ এবং একই সাথে হাস্যকর দাবীও বটে। জনাব রবার্টসন যে রিপোর্টকে স্বাধীন বলে দাবী করেছেন সেই তিনিই এই রিপোর্টে বলেছেন-
“I was approached in March 2014 by Toby Cadman, one of the English barristers who had been advising the defence (necessarily, from abroad) and asked to review all the cases concluded so far and to provide an independent opinion on their fairness and on the Tribunal’s proceedings and conduct”.

উল্লেখ্য যে এই উল্লেখিত টবি ক্যাডম্যান বর্তমানে চলা ট্রাইবুনালের অভিযুক্ত পক্ষের একজন আইনজীবি ও পরামর্শক। আইনী পরামর্শের পাশাপাশি সারা বিশ্বব্যাপী এই আলোচ্য ট্রাইবুনালের বিরুদ্ধে তার অত্যন্ত দৃষ্টিকটু ও ব্যার্থ ক্যাম্পেইন আমরা অনেক বছর ধরেই দেখছি। তেমন একজন মানুষের অনুরোধে ও তার ব্যাক্তিগত আগ্রহে এমন একটি রিপোর্টের ভেতরের সারমর্ম কি হতে পারে সেটি আসলে এই তথাকথিত হাস্যকর রিপোর্ট প্রতিটি লাইনে লাইনেই প্রমাণিত হয়েছে। জনাব রবার্টসনের এই স্বীকারোক্তির পর একজন বুদ্ধিমান ব্যাক্তি-ই বুঝতে পারবেন যে এটি আসলে কোন প্রেক্ষিতের রিপোর্ট এবং কতটাই বা স্বাধীন ও নির্মোহ।

সবচাইতে ভয়াবহতম ব্যাপার হচ্ছে জনাব রবার্টসন এই রিপোর্ট লিখতে গিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে একটি “সিভিল ওয়ার” হিসেবে উল্লেখ করেছেন যেটি বাংলাদেশের মহান ইতিহাসের একটি ন্যাক্কারজনক বিকৃতি। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে একটি স্বাধীন দেশ এবং বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে যে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জয়ী হয়েছিলো সেটি পাকিস্তানী দখলদার আর্মির বিরুদ্ধে এবং এই যুদ্ধ হয়েছিলো একটি স্বাধীন দেশে আক্রমনকারী পাকিস্তানী বাহিনীর কাপুরোষিত হামলার প্রেক্ষিতেই। সুতরাং এই মহান মুক্তিযুদ্ধকে সিভিল ওয়ার হিসেবে গণ্যকরার মানে হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতি তীব্র অসম্মান। ICRF তাদের অবজার্ভেশনে মনে করে জনাব রবার্টসন বাংলাদেশের ইতিহাসের ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞ একজন ব্যাক্তি এবং এই অজ্ঞতার ফলেই তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন বিকৃত বক্তব্য দিয়েছেন। এটি মুক্তিযুদ্ধে নিহত ৩০ লক্ষ বা তারো বেশী শহীদ এবং নির্যাতিত চারলক্ষ কিংবা তারও বেশী নারী-শিশুদের প্রতি প্রচন্ড অবমাননা। ICRFএই মিথ্যে ইতিহাসের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত একটি সম্পূর্ভাবে দেশীয় আদালত যেখানে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সংগঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার হচ্ছে। পৃথিবীর অন্যান্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের উদাহরণ এবং সেটিকে সম্পৃক্ত করে জনাব রবার্টসনের বক্তব্য সু-স্পস্টভাবে প্রমাণ করে যে তিনি ইচ্ছেকৃত ভাবে এই ধরনের তুলনামূলক একটি আলোচনাতে নিজেকে যুক্ত করেছেন। জাতিসংঘ ও সংশ্লিষ্ঠ রাষ্ট্রের সমন্বিত উদ্যোগে এডহক ভিত্তিতে গঠিত এই জাতীয় অন্যান্য ট্রাইবুনালের সাথে বাংলাদেশের ট্রাইবুনালের এই বেসিক পার্থক্যই জনাব রবার্টসন বুঝতে সম্পূর্ণ ব্যার্থ হয়েছেন। এছাড়াও রেট্রোস্পেকটিভ আইনী ধারনার মত সেটেলড ইস্যু নিয়েও অহেতুক বক্তব্য দিয়ে তিনি তাঁর রিপোর্টকে তীব্র প্রশ্নবিদ্ধ ও সন্দেহযুক্ত করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিচারপতিরাও অংশ নিয়েছেন এবং এটা ন্যাশনাল স্পিরিটের অংশ এবং বিচারপতিরা যেহেতু বিজয়ী পক্ষের সুতরাং তাদের মাধ্যমে এই বিচার ফেয়ার হবেনা বলেও হাস্যকর মন্তব্য করেছেন জনাব রবার্টসন। তিনি এই সূত্রে বার বার মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন মাননীয় বিচারপতি জনাব নাসিম এইসব অপরাধীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের গত কয়েক দশকের আন্দলোনের সাথে যুক্ত থেকেছেন সে কথা। জনাব রবার্টসন হয়ত জানেন না যে এই ইস্যুতে এরই মধ্যে ডিফেন্স পিটিশান দাখিল করেছিলো এবং এই ব্যাপারে ইতিমধ্যেই ট্রাইবুনাল-১ বছর তিনেক আগেই তাদের অবজার্ভেন দিয়ে ব্যাপারটিকে নিষ্পত্তি করেছেন। একটি সেটেলড ইস্যু নিয়ে আবারও প্রশ্ন তোলা অবান্তর এবং সন্দেহজনক। এই প্রেক্ষিতে লর্ড রীটের উদ্বৃতি উল্লেখ করা যেতে পারে যিনি এই প্রেক্ষিতে বলেন-“একজন চুরিতে অভিযুক্ত ব্যাক্তি আদালতে এসে কখনোই দাবী করতে পারবেনা যে আরেকজন চোর বিচারপতির আসনে বসে তার বিচার করুক”, সুতরাং জনাব রবার্টসনের দাবীও একইরকম ভাবে অন্তঃসারশূন্য এবং তাঁর এই বিষয়ে না জানবার ও না বুঝবার কারনেই হয়েছে বলে আই সি আর এফ মনে করে।

বাংলাদেশের বিচার বিভাগ অনেক পুরোনো ও এস্টাবলিশড একটি প্রতিষ্ঠান। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী ৪৩ বছরে বাংলাদেশের বিচারবিভাগ তাঁর যোগ্যতা ও মেধায় আইনী চিন্তা ও ধারনাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছেন। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের অসংখ্য রায় পৃথিবীর অনেক দেশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। বাংলাদেশের বিচার বিভাগের মত স্বাধীন, যোগ্যতাময় একটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে জনাব রবার্টসনের ধৃষ্ঠতাপূর্ণ বক্তব্য এবং বাংলাদেশের ইতিহাস, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে জনাব রবার্টসনের বক্তব্য অত্যন্ত মানহানিকর, অসংলগ্ন, বিকৃত ও আপত্তিকর।

জনাব রবার্টসন তার তথাকথিত রিপোর্টে উইকিলিকস এর মত অনৈতিক সূত্রকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছেন এবং স্কাইপি ইস্যুর মত এমন একটি অপ্রমাণিত ইস্যুর কথা উল্লেখ করে তার রিপোর্টকে প্রশ্নবিদ্ধ ও এথিকাল দৃষ্টিকোন থেকে সম্পূর্ণ ভব্যতার সীমা অতিক্রম করেছেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আইনের অধ্যাপক জনাব ডক্টর আহমেদ জিয়াউদ্দিন ও বাংলাদেশের সূপ্রীম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগের সম্মানিত বিচারপতি জনাব নিজামুল হক নাসিমের নাম নিয়ে তথাকথিত একটি স্কাইপি কনভার্সেশনের কথা উল্লেখ করে জনাব রবার্টসন অত্যন্ত আপত্তিকর বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি যেই সুষ্ঠূ বিচারের দাবী করতেই তার ১২৬ পাতার বিশাল রচনা সৃষ্টি করেছেন সেই রচনাতেই তিনি একটি আদালতে অপ্রমাণিত ও সাব-জুডিস ম্যাটার নিয়ে কথা বলেছেন যা ভব্যতার সাধারণ নর্ম ও নৈতিক চিন্তারপরিপন্থী ও তার পূর্বে বলা বক্তব্যের স্ববিরোধীতা। আমরা জনাব রবার্টসনের এই ধরনের উদ্ধৃতি, বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাই ও অতিসত্বর এই ধরনের আপত্তিকর ও অপ্রমানিত বক্তব্য প্রত্যাহারের অনুরোধ জানাচ্ছি। আশা করব বাংলাদেশের ইতিহাস, আদালত ব্যাবস্থা ও রাজনীতি নিয়ে নানাবিধ ধৃষ্টতামূলক বক্তব্যের প্রেক্ষিতে জনাব রবার্টসন বাংলাদশের জনগণ ও সরকারের কাছে অবিলম্বে ক্ষমা চাইবেন।

একই সাথে International Crimes Research Foundation [ICRF] আশা করে যে গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এই তথাকথিত রিপোর্ট ও ইতিহাস বিকৃতির ব্যাপারে ওয়াকিবহাল রয়েছে এবং এই ব্যাপারে শিঘ্রী প্রয়োজনীয় আইনী ব্যবস্থা নেবেন।

 

 

 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত