সিলেটটুডে ডেস্ক

১৯ এপ্রিল, ২০১৫ ০০:৩২

বৃটেনে ভালো নেই বাংলাদেশীরা, মজুরী পাচ্ছেন সবচেয়ে কম

স্বপ্নের দেশ যুক্তরাজ্য। জীবনমান উন্নয়নে স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বহু বাংলাদেশী পাড়ি জমিয়েছেন দেশটিতে। কিন্তু স্বপ্ন আর বাস্তবতার মধ্যে যে বিস্তর ফারাক, তা এখন অনেকটাই দৃশ্যমান। ব্রিটেনে দীর্ঘদিন ধরে নিম্ন মজুরি পেয়ে আসছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতরা, যাদের বড় একটা অংশের বাস দারিদ্র্যসীমার নিচে।

সম্প্রতি দেশটির গবেষণা সংস্থা জোসেপ রওনট্রি ফাউন্ডেশনের (জেআরএফ) এক গবেষণায় এমনটাই উঠে এসেছে।

১৯৯৩ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তথ্য পর্যবেক্ষণ করে ‘মনিটরিং পভার্টি অ্যান্ড সোস্যাল এক্সক্লুশন-২০১৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে জেআরএফ। গবেষণায় বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতসহ ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে বসবাসরত অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর দারিদ্র্যের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

গবেষণায় দেখানো হয়েছে, ব্রিটেনে শ্রমের বিনিময়ে সবচেয়ে কম মজুরি পান বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতরা। দেশটিতে বসবাসকারী বাংলাদেশী নারীদের ৩০ শতাংশ সেখানকার জীবনমানের মানদণ্ডের তুলনায় কম মজুরি পাচ্ছে।

এ তালিকায় বাংলাদেশের পাশে রয়েছে পাকিস্তান। জীবনমানের চেয়ে কম মজুরি পাওয়ার দিক থেকে বাংলাদেশী পুরুষরা অন্যসব জাতিগোষ্ঠীর চেয়ে এগিয়ে। দেশটিতে প্রায় ৫৫ শতাংশ বাংলাদেশী পুরুষ নিম্ন মজুরি পেয়ে আসছেন। এ তালিকায় বাংলাদেশের পরই রয়েছে পাকিস্তান। দেশটি থেকে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমানো ৩২ শতাংশ পুরুষ নিম্ন মজুরির শিকার। চীন, আফ্রিকা, ভারত, ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ ও এশিয়ার অন্যান্য দেশের বংশোদ্ভূতরাও রয়েছে একই তালিকায়।

জেআরএফের গবেষণায় দেখানো হয়, ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত দেশটিতে থাকা বাংলাদেশী জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার বেশি। সেখানে প্রায় ৪২ শতাংশ বাংলাদেশী শিশু দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। আর এ তালিকায় বাংলাদেশের পরে রয়েছে পাকিস্তান।

বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত শিশুদের মধ্যে ৩৪ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিনামূল্যে খাবার পায় না। তবে ৪১ শতাংশ শিশু এ খাবার সংগ্রহ করে থাকে। একই সময়ের তথ্য-উপাত্তের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতদের মধ্যে দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে ৮ শতাংশ মানুষ। অন্যদিকে ১৩ শতাংশ পাকিস্তানি ও ১৪ শতাংশ আফ্রিকান বংশোদ্ভূত ব্রিটেনবাসী দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে। আর ভারতীয়দের ক্ষেত্রে এ হার ৬ শতাংশ।

এদিকে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে ব্রিটেনে নতুন করে ৩ শতাংশ বাংলাদেশী বেকার হয়ে পড়েছে। ২০০৮ সালে সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশীদের মধ্যে বেকারত্বেরে হার ছিল ১০ শতাংশ। কিন্তু ২০১৩ সালে এ হার ১৩ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশী শ্রমিকদের অদক্ষতার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।

ব্রিটেনে বসবাসরত বাংলাদেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেখানে যেসব বাংলাদেশী নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পেরেছেন, তারা খুব ভালো রয়েছেন। তাদের আয় ব্রিটিশদের চেয়েও বেশি। তবে ব্রিটেনে এখনো জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সংগ্রাম করা বাংলাদেশীদের সংখ্যাই বেশি। যারা নব্বইয়ের দশকে ব্রিটেনে পাড়ি দিয়েছেন, তাদের অভিবাসন প্রক্রিয়া সহজে হয়ে  গেছে। তবে এদের বেশির ভাগই দেশটির নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণী। কিছু রয়েছে যারা বিনিয়োগ দেখিয়ে অভিবাসন করেছেন, সেসব বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ধনীদের কাতারে রয়েছেন।

কিন্তু নব্বইয়ের দশকে যারা দেশটিতে পাড়ি জমিয়েছেন, তারাই মূলত বিপাকে রয়েছেন। কারণ ব্রিটেনের অভিবাসন আইন অনুযায়ী, কেউ কমপক্ষে ১০ বছর সেখানে বসবাস করতে পারলে নাগরিকত্ব লাভের সুযোগ পাবে।  ফলে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বিশাল অঙ্কের অর্থ দেশটির শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করে নাগরিকত্ব লাভ করেছেন।

দেখা গেছে, এ অর্থ জোগান দিতে দেশ থেকে জমি বিক্রি, বন্ধক রাখা অথবা ঋণ নিতে হয়েছে। এখন এ ঋণ শোধ করতে গিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করতে হচ্ছে অনেককে।

ব্রিটেনে বসবাসরত বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আইনজীবী ব্যারিস্টার এম ইশতিয়াক হাসান বলেন, বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত একশ্রেণীর মানুষ ব্রিটেনে খুব ধনী। তবে বেশির ভাগ মানুষকেই সেখানে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হচ্ছে। আর দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকার অন্যতম কারণ হলো, অনেকে সরকারের কাছ থেকে মাসিক ভাতার জন্য কৌশলী হয়ে পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়াচ্ছেন।

দক্ষ না হওয়ায় চাকরির বাজারে তারা পর্যাপ্ত মজুরি পাচ্ছেন না। সেই সঙ্গে প্রতিনিয়ত পরিবারের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আয় কিন্তু বাড়ছে না। আর রাজনৈতিক আশ্রয়ে যারা রয়েছেন, তারা দক্ষতার অভাবে কাজের ক্ষেত্রে ঠিক তেমন কোনো সুবিধা পান না। সব মিলিয়েই সেখানে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতদের অনেককেই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করতে হচ্ছে।

পরিস্থিতির পরিবর্তনে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশী দক্ষকর্মীদের ইউরোপের অন্য দেশগুলোয় চাকরির বাজারে উন্মোচন করে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে চাকরির বাজারে এখনো দক্ষ মানুষকে রাখার ক্ষেত্র তৈরি হয়নি। ফলে নিজেদের জীবনমান উন্নয়নে তারা যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমাচ্ছেন। কিন্তু সেখানকার বাংলাদেশীরা এখনো চাকরির বাজার ধরতে অভিবাসনের দিকে তেমন একটা মনোযোগী নয়। ফলে ব্রিটেনে দক্ষ মানুষকেও বেকার থাকতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে ইউরোপের অন্যান্য বাজারে তারা চাকরি খুঁজে দেখতে পারেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত