অসীম চক্রবর্তী

০৯ অক্টোবর, ২০১৫ ২২:০৩

‘দ্যা মটরসাইকেল ডায়রিস’

বলিভিয়ার ঘন জঙ্গলে সামরিক জান্তার হাতে ধরাপড়া এবং মৃত্যুর প্রায় তিন যুগ পরে ও যিনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম আলোচিত নায়ক ।পৃথিবী জোড়ে সাম্রাজ্যবাদ পতন এবং শোষণ হীন, সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষে যার আজন্ম

বিদ্রোহ । তৎকালীন রাজনৈতিক শোষক দৃষ্টিতে বিতর্কিত কিংবা আজকের সকল সমালোচনার ঊর্ধ্বে মহানায়ক চে অর্নেস্থা গেভারা আজ যতটা না দৃশ্যমান টি শার্টে তার থেকে বেশি অমর হয়ে আছেন কোটি মানুষের হৃদয়ে ।সাম্রাজ্যবাদের পতন আর বিশ্ব জোড়া শ্রেণী হীন সমাজের বিস্তার কিংবা বিদ্রোহের কাহিনী নয় ।ওয়াল্টার সালেস পরিচালিত দা মোটর সাইকেল ডায়রিস ছবি তে স্থান পেয়েছে কিংবদন্তি চে'র ছাত্র জীবনের একটি ঐতিহাসিক সময়ের । এইখানে পরিচালক চে গুয়াভারা'র বর্ণাঢ্য জীবনী থেকে অতি লোভনীয় এবং তারুণ্য দীপ্ত লাতিন আমেরিকা মহাভ্রমন অংশটি স্থান পেয়েছে ।

চে'র পরবর্তী বিপ্লবী জীবনের সাথে এই ভ্রমণের মিল না থাকলে ও অনেকে মনেকরেন যে এই ভ্রমণই নাকি তাকে উজ্জীবিত করেছিল বিপ্লবের পথে ।ছবির গল্পটা চে' র ট্রাভেল নোট থেকে সংগ্রহ করে , পরবর্তীতে এটা দা মোটর সাইকেল ডায়রিস নামে প্রকাশিত হয় , আর পরিচালক অতি সুচারু রূপে দান করেছেন তার ভিসুয়াল রূপ ।


৪ঠা জানুয়ারি ১৯৫২ এক রৌদ্রজ্জল সকালে চার মাসে আট হাজার কিলোমিটার ভ্রমণের মিশনে যাত্রা বুএনস আইরেস থেকে শুরু করলেন চিকিত্সা বিজ্ঞানে অধ্যয়নরত তেইশ বছরের টগবগে যুবক চে অর্নেস্থা গে ভারা । সঙ্গী একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়ো কেমিস্ট্রি থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী বন্ধুবর আলবার্ট গ্রানাদো, তার স্প্লাটারিং নর্টন ফাইভ হানড্রেড মটরবাইক ।গন্তব্য ছিল চে'র বুয়েনস আইরেসের উচ্চ মধ্যবিত্ত বাড়ি থেকে আন্দেস , চিলি হয়ে প্রতি নগর জনপদ পাড়ি দিয়ে মহাবন আমাজন জয় করে মাচ্চু পিচ্চু ছয় হাজার কিলোমিটার দূরবর্তী সাও পাওলো হয়ে ভেনেজুয়েলা ।পাকা ভ্রমনবীদের মত প্রস্তুতি ছাড়া "যেখানে রাত সেখানে কাত" ধরনের মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে খোলা মাঠ , দিগন্ত জোড়া আকাশ, অন্তহীন কালো রঙের পিচ রাস্তা আর এক বুক উত্সাহ উদ্দীপনা কে সঙ্গী করে চে আর গ্রানাদো যাত্রা শুরু করলেন । যা অতি মণমুগ্ধকর রূপে উঠে এসেছে এরিক গুটিয়ের কেমেরায় । পরে অবশ্য ওয়াল্টার সালেস ঠিক একই ধরনের অনন্য সাধারণ ভিসুয়াল তার বহুল আলোচিত ব্রাজিলিয়ান ড্রামা বিহ্যান্ড দা সান এ ও ব্যবহার করেছিলেন ।

এই ছবিতে চে' কে প্রথম যৌবনের একটি সম্ভ্রান্ত উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের যুবক হিসাবে দেখা গেছে । যাত্রার কিছুক্ষণ পূর্বে চে'র পিতা তাকে একটা কোনে ডেকে নেন, কোনো অতরিক্ত টাকা কিংবা ট্রাভেলার চেক নয় বরং পিত্র স্নেহে জড়িয়ে ধরা এবং বিপদ মোকাবেলা করার জন্য একটি হ্যান্ডগানই তার স্বাক্ষ্য বহন করে ।ধীরে ধীরে আদর্শ, সভ্যতার প্রতি দায় আর নীতির যার উত্সরণ ঘটছিল ।অবশ্য পরবর্তী জীবনে "প্রথম পিস্তল স্পর্শের কিংবা নিজের কাছে রাখার অনুভুতি শীর্ষক এক প্রশ্নের জবাবে চে বলেছিলেন আমাদের ওই পিস্তল টি ব্যবহার করতে হয়নি । এতটা ই উত্তেজিত ছিলাম যে আমরা ওটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম এবং একটা আত্মবিশ্বাস ছিল যে এমন কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতেহবে না যেখানে পিস্থল ব্যবহার করতে হবে । দা মোটর সাইকেল ডায়রিস ছবিতে চে গুয়েভারা চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন আকর্ষনীয় এবং টগবগে তরুণ অভিনেতা গাএল গার্সিয়া বের্নাল । ২০০২ সালে ফিদেল ক্যাস্ত্রো কে নিয়ে নির্মিত একটি টিভি সিরিয়াল এ দুর্দান্ত এবং অভিনয়ের মাধ্যমে শক্তিমান তরুণ অভিনেতা হিসাবে যিনি জয় করেছিলেন অগুনতি দর্শকের হৃদয় । আরও এক শক্তিমান অভিনেতা রড্রিগ দি লা সেরনা অভিনয় করেন গ্রানাদো চরিত্রে ।যিনি ছিলেন এই পুরো মটর সাইকেল ভ্রমনের আয়োজক এবং প্রেরণা দাতা । চে'র প্রিয় বান্ধবী' চিচিনার চরিত্রে অভিনয় করেন অসাধারণ সুন্দরী মিয়া মেস্তরে ।যার সাথে যাত্রা পথে চে একটি রাত কাটিয়েছিলেন তার পিতার সুসজ্জিত বাসবভনে ।

সারা দুনিয়া যাকে চে বলে ডাকে তার "ফুসের" নামে একটি ডাক নাম ও যে আছে তা অনেকের অজানা । কিন্তু এই ছবিতে চে নাম খুব কম এ উচ্চারিত হয়েছে চে'র সেই ডাক নামের তুলনায় ।

অনেক মজাদার বুননে ধীরে ধীরে গড়িয়েছে এই ছবির যবনিকা । বিভিন্ন সময়ে তাদের মোকাবেলা করতে হয়েছে অনেক ধনের চ্যালেঞ্জ । যেমন একটু আশ্রয় কিংবা মটর সাইকেল সরানোর জন্য তাদের অনেক কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে । কখনো পরিচয় গোপন কিংবা অন্য পরিচয় ধারণ । একবার তো দুই সুন্দরীর দিকে নজর দেওয়ার জন্য তাদের হিংস্র স্বামীর হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে হয়ছিল ।

অন্যদিকে এই ভ্রমন তাদের দিয়েছিল নিপীড়িত, হত দরিদ্র, নিগৃহীত কৃষকদের মৌলিক অধিকারহীন জীবনকে অতি কাছে থেকে অবলোকন করা । যারা উচ্চ শ্রেনীর মানুষদের মৌলিক অধিকার উপভোগের জন্য কাজকরে নিজের মৌলিক অধিকার বিসর্জন দিয়ে । তার পরে ও জীবন থেমে থাকে না । চিমনির ধুয়া যেমন ক্লান্ত হীন ধক ধক করে জ্বলে চলে একই গতিতে নিউটনের গতির সূত্রের সফলতা প্রমানে । ঠিক তেমনি জীবন ও চলে জীবনের গতিতে । হয়ত কষ্টের বুঝা সেখানে অনেক বেশি কিন্তু, সেই কষ্টে এক ফোটা আনন্দ ছঁয়ে যায় তাদের বৈসম্য হীন ভাবে ।

পরিচালক ওয়াল্টার সালেস অতি দক্ষ হাতে ধারণ করেছেন আর্জেন্টাইন হত দরিদ্র মজুর দের জীবন , যারা এই ছবির কাহিনী কাল থেকে বিগত পঞ্চাশ বছরে ও কোনো পরিবর্তনের মুখ দেখে নি। ছবির একদম শেষের দিকে অনেকটা ফটো সাংবাদিকের মত তিনি আসল ভাবনায় ফিরে আসেন কতগুলো সেপিয়া- এবং সাদা কালো অরিজিনাল পোটট্রেট এর মাধ্যমে । এর মধ্যে কিছু ছবি বহন করে চে'র তারুন্য দীপ্ত ভ্রমণের এবং কিছু ছবিতে ফুটে উঠেছে দুঃখময় দারিদ্র । যাহা নাড়িয়ে দিয়েছিল চে অর্নেস্থা গেভারা নামের এর উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের টগবগে এক তরুনের কোমল হৃদয় ।এইখানে আরও দেখা যায় যে তরুণ চে গেভারা অনেক সংগ্রাম করেছিলেন এবং মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন কঠিন এজমা রোগের সাথে, তার পরে ও তিনি দমে যান নি । পরিচালক এর ভাষায় এটা চে'র জীবনের ধৈর্য শক্তির এক বিরাট প্রমান বহন করে তার ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি । এবং এই ধৈর্য , লক্ষ্য আর ব্যক্তিত্ব তার বিপ্লবী জীবনের অনেক বড় মন্ত্র ।যদিও বিপ্লবী চে সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত ছিল পরিচালক ওয়াল্টার সালেস এর দা মোটর সাইকেল ডায়রিস ছবিতে ।

চে ছিলেন স্টালিনের আদর্শে উজ্জীবিত একজন বিজ্ঞ, অদূরদর্শী দলনেতা। যিনি মৃত্যু নিশ্চিত করতে বিঘ্ন সৃষ্টিকারীদের অস্ত্র হীন অবস্থায় যুদ্ধে পাঠাতে ও দ্বিধা করতে না। তিনি বিশ্বাস করতেন সু বিচার নিশ্চিত আর দোষীদের যথাযথ শাস্তি প্রদানে । সাম্রাজ্যবাদের অবসান আর বৈষম্য হীন পৃথিবী গড়তে চে ছুটে বেড়িয়েছেন লাতিন আমেরিকা থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ।কখনো নেতৃত্ব দিয়েছেন, কখনো অস্ত্র  ধরেছেন একজন সাধারণ সৈনিক হিসাবে । তিনি হয়ত ফিদেল ক্যাস্ট্রো 'র মত দীর্ঘ জীবন ভোগ করেননি , কিন্তু তার দুঃসাহসিক অভিযান , তারুণ্য , অদম্য সাহস আর মহা সমুদ্রের মত ব্যক্তিত্ব ই হলো চে নামের মিথ যাহা পরিচালক ওয়াল্টার সালেস সার্থক এবং সাফল্যের সাথে সেলুলয়েড এর ফিতায় বন্দী করেছেন । বলিভিয়ার জঙ্গলে চে নামক এক নশ্বর শারীরিক ইতিহাসের সমাপ্ত হলে ও তার অবিনশ্বর আদর্শ ব্যক্তিত্ব আর সাহসী পদক্ষেপ বেঁচে থাকবে অমর হয়ে কখনো ঝলঝলে লাল পোস্টারে , টি সার্টে, টুপিতে আর সর্বোপরি অগুনতি মানুষের হৃদয়ে ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত