শাহ নুর জালাল

১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ০০:২৯

পুত্রের স্মৃতিতে পিতা

বাড়ির কাছে উজানধল বাজার। চাল আনতে সেখানে গেছেন তিনি। ফিরে এলে চুলো জ্বালাবেন— এ অপেক্ষায় বসে রইলেন গিন্নি। সামান্য সময়ের ব্যাপার এ বাজারসদাই। অথচ ঘণ্টা পেরিয়ে দিন যায়, সপ্তাহ পেরোয়। অবশেষে ১৮ দিন পর খবর পাওয়া গেল তিনি আছেন হবিগঞ্জে। এক ভক্তের বাড়িতে গান করছেন। এমনই খেয়ালি মানুষ ছিলেন বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম। আজ তাঁর ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন তাঁর একমাত্র ছেলে শাহ নূর জালাল

বাবা যখন মারা যান, তখন আমার বয়স ৪৫ বছর। মা মারা যাওয়ার পর বাবার সঙ্গেই সবসময় থাকতাম। বাউলরা যেমন হয়, বাবা তেমনই একজন আপনভোলা মানুষ ছিলেন। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন না। শুধু বাউল নন, তিনি ছিলেন অনেক বেশি প্রতিভার অধিকারী একজন মানুষ। কেবল বাউল হিসেবে গণ্য করলে ওনাকে ছোট করা হয়। বাবা ছিলেন সাধক। আমি দেখেছি, ওনার মধ্যে আধ্যাত্মিক বিষয় ছিল। বাবার মুখেই শুনেছি, উনার মুর্শিদের নির্দেশে সাধনা করতে গিয়ে একবার ১১ মাস তিনি এক ফোঁটা পানিও খাননি, ৪০ দিন চিল্লা করেছেন। এরপর উনি নিজের একটি গানে বলেছিলেন, ‘আহা মরমি কবি, আমি তুলে ধরি দেশের দুঃখ-দুর্দশার ছবি/ বিপন্ন মানুষের দাবি করিম চায় শান্তি বিধান/ মন মজালে ওরে বাউলা গান।’

গানের মাধ্যমে বিভিন্ন মঞ্চে সাধারণ মানুষের কথা বলতেন বাবা। মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেকে তাদের রাজনৈতিক সভায় ডাকতেন বাবাকে, সেখানে তিনি গণমানুষের গান গাইতেন। বাংলাদেশে শিল্পীদের মধ্যে শাহ আবদুল করিম আর দূরবীন শাহই প্রথম বিলাতে গান শোনাতে যান। এরপর তিনি লিখলেন, ‘স্বচক্ষে দেখিলাম যাহা বিলাতে/ তারা সবাই বাস করে ভালোবাসার জগতে।’

সবসময় দেশ ও মানুষের গান গাইতেন বাবা। মিডিয়ার লোকজন যখন তার চাওয়া-পাওয়া নিয়ে জানতে চাইতেন, বাবা বলতেন, ‘ব্যক্তিগত কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই আমার। যখন দেখি সাধারণ মানুষ শান্তি পায়, আমি স্বর্গে চলে যাই, আর যখন তারা কষ্ট পায়, আমিও কষ্ট পাই।’ কোনো স্বীকৃতি নয়, মানুষের ভালোবাসাকেই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি মনে করতেন তিনি।

বাবার ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’ গানটি স্কুলের পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও হয়তো তার সৃষ্টি অনেক কাজে লাগবে। তবে তার কাজগুলো সংগ্রহ আর রক্ষা করা প্রয়োজন। আর কাজটা একা আমি করে উঠতে পারব না।

শাহ আবদুল করিমের গান শুধু মনোরঞ্জনের জন্য নয়। তার গান অনেক পথনির্দেশনাও দিয়ে যায়। প্রতিটি গানের আলাদা ভাব রয়েছে। রয়েছে সাধারণ মানুষের কথা। তাকে তো গণমানুষের বাউল বলা হয়। কারণ সমাজের সব স্তরের মানুষ তার গানের কথা বোঝে।

তার কাজকে রক্ষা করা প্রয়োজন। যারা তার বাড়িতে এসেছেন, দেখেছেন তার আর্থিক অবস্থা। একটি গানে উনি লিখেছেন, ‘সংসার বড় হইলো/ খোরাকির টান পড়ে গেলো/ জমি-জমা যা ছিল সব ফ্যালাইসি বেইচ্যা/ কষ্ট করে আছি এখন বাইচ্যা।’

বাবা এমন এক পরিবারে জন্ম নিয়েছেন, নিজের আত্মস্মৃতিতে বলেছেন, ‘দুঃখে আমার জীবন গড়া/ তবু দুঃখরে ডরাই/ মনের দুঃখ কার কাছে জানাই/ গরীব কুলে জন্ম আমার, আজো মনে পড়ে/ ছোট বেলায় বাস করিতাম ছোট কুঁড়েঘরে/ দিন কাটিতো অর্ধাহারে রুমে কোন ঔষুধ নাই/ একসঙ্গে জন্ম যাদের ১৩২২ বাংলায়/ আনন্দে জেলে পাড়ায় স্কুলে পড়িতে যায়/ আমার মনের দুর্বলতা একা থাকা ভালো পাই/ পিতা মাতার ছেলে সন্তান একমাত্র ছিলাম/ জীবন বাঁচাবার তাগিদে প্রথম চাকরিতে গেলাম/ মাঠে থাকি গরু রাখি ঈদের দিনও ছুটি নাই/ সবসময় গান গাইতাম মনের এই স্বভাব ছিল/ আমাকে নয় গানকে তখন অনেকে বাসতো ভালো/ রাগ রাগিনী ভালো ছিল রচনা করিয়া গাই/ গ্রামের মুরব্বি আর মোল্লা সাহেবের মতে/ ধর্মীয় আক্রমণ এলো ঈদের দিন জামাতে/ দোষী হই মোল্লাজির মতে ছোট কালেও মুক্তি নাই/ নিষেধ বাধা না মানিয়া কুলের বাহির হইলাম/ একতারা সঙ্গে করে ঘরবাড়ি ছেড়ে দিলাম/ ঘর ছাড়া বাউল সাজিলা সকলের এই করিম ভাই।

শাহ আবদুল করিম সেই অবস্থান থেকে আজকের এই জায়গায় এসেছেন। আজ তার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আমরা বাড়িতে ছোট করে আয়োজন করেছি। সবার কাছে দোয়া চাই তার জন্য। বাড়িতে জুমার নামাজের পর তার কবরে ফুলের তোড়া দেয়া হবে। এরপর মিলাদ মাহফিল এবং রাতভর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে।

১৯৯০ সালে আমার মা মারা যান। মার নাম ছিল মনজান বিবি। বোধহয় বৈশাখ মাসে জন্মেছিলেন, তাই ডাক নাম ছিল বৈশাখী। খুব সহজ-সরল ছিলেন মা, তাই বাবা তার নাম দিয়েছিলেন সরলা। নিজেই বলতেন, ‘সরলার মতো একজন স্ত্রীকে না পাইলে আমি শাহ আবদুল করিম হতে পারতাম না।’ আমি সরলাকে মুর্শিদের মতো জ্ঞান করি। মাকে নিয়ে বাবা লিখেছিলেন, ‘সরলা তুমি শান্ত তুমি নূরের পুতুলা, সরল জানিয়া নাম রাখি সরলা। আমাদের অভাব-অনটনের সংসারে বাবা অনেক সময়ই বাড়িতে থাকতেন না। কিন্তু সংসারের পুরো দায়িত্বটা মা পালন করতেন। হয়তো বছরে ১১ মাসই বাবা বাইরে থাকতেন। তবে এ নিয়ে মা কখনো তাকে অভিযুক্ত করেননি। আমার মায়ের উত্সাহ-প্রেরণায় বাবা সঙ্গীত সাধনা করেছেন। মার মতো ত্যাগী একজন মানুষ যদি বাবা না পাইতেন, তাহলে উনি এত বড় হতে পারতেন না।

আমি দেখেছি, বাবা ফিরলে মা কখনো রাগ করতেন না বা ঝগড়া করতেন না। মা যখন মারা গেলেন, তখন বাবা লিখলেন, ‘আর জ্বালা সয় না গো সরলা/ তুমি আমি দুইজন ছিলাম, এখন আমি একেলা।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত