খলিলুর রহমান ফয়সাল

০২ নভেম্বর, ২০১৫ ১২:৪৩

অগ্রযাত্রার নয় বছর: সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

২ নভেম্বর দেশের কৃষি শিক্ষার অন্যতম সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নয় বছরে পা রাখল। মাত্র ৫০ একর জায়গা নিয়ে ২০০৬ সালের ২ নভেম্বর সিলেট ভেটেরিনারি কলেজ থেকে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নামে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশের চতুর্থ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এর একাডেমিক কার্যক্রম দুরন্ত গতিতে বৃদ্ধি পায়।

ভেটেরিনারি এন্ড এ্যানিমেল সায়েন্স অনুষদের পাশাপাশি নতুন ভাবে যাত্রা শুরু করে কৃষি অনুষদ ও মাৎস্য বিজ্ঞান অনুষদ। আস্তে আস্তে বদলে যেতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ। বর্তমানে আরও যোগ হয়েছে কৃষি অর্থনীতি ও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ, কৃষি প্রকৌশলী ও কারিগরি অনুষদ এবং বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনিটেক ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদ। তাছাড়া এ বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি বিশেষ ডিপার্টমেন্ট রয়েছে যা দেশের অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল তথা সিলেটের কথা চিন্তা করে ডিপার্টমেন্ট দুটি খোলা হয়েছে। এগুলো হল-(১) কৃষি তত্ত্ব ও হাওর কৃষি (২) উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মাৎস্য-বিজ্ঞান। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োটেকনোলজি কিংবা জেনিটেক ইঞ্জিনিয়ারিং আলাদা করে অথবা একসঙ্গে কোর্স হিসেবে পড়ানো হয়। একমাত্র সিকৃবিতে প্রথমবারের মতো বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনিটেক ইঞ্জিনিয়ারিং পূর্ণাঙ্গ অনুষদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলো।

সিলেটের লালচে মাটির গুণগত মান দেশের অন্যান্য অব্জল থেকে ভিন্নতর। আবার বৃহত্তর সিলেটে রয়েছে হাজার হাজার একর অনাবাদী উঁচুনিচু পাহাড়ি অসমতল ভূমি। আছে হাওড় নামের বিস্তীর্ণ জলাশয়। অপার সম্ভাবনাময় এসব প্রাকৃতিক সম্পদসমূহকে গবেষণার মাধ্যমে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার আওতায় আনার জন্য ইতিমধ্যে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬টি অনুষদ সাফল্যের সাথে কাজ করে যাচ্ছে।

ভেটেরিনারি এন্ড এ্যানিমেল সায়েন্স অনুষদে ইতোমধ্যে ১৬টি ব্যাচ বেরিয়ে গেছে। কৃষি অনুষদ এবং মাৎস্য-বিজ্ঞান অনুষদ থেকে চারটি করে মোট ৮টি গ্র্যাজুয়েট ব্যাচ এবং কৃষি অর্থনীতি ও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ থেকে মোট ২টি ব্যাচ বের হলো বের হল। এরা সবাই এখন স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ উজ্জ্বল করে আছে। সদ্য গ্র্য্যজুয়েট হওয়া শাহ মোঃ শাহাদাৎ হোসেন বলেন-“অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আমরা সফলতার দিকে এগুচ্ছি। শিক্ষক-শিক্ষার্থী মধুর সম্পর্ক সফলতার গতিকে বেগবান করছে।”


মাত্র ৫০ একর জমির উপর দাঁড়িয়ে আসে সিকৃবি ক্যাম্পাস। “সবুজে ঘেরা, ছোট ছোট টিলার ফাঁকে উকি দেয় আমাদের ক্যাম্পাস। আয়তনে ছোট হলেও এর রূপ-সৌন্দর্য আমাদের হৃদয়ে আলাদা একটা টান ও ভালবাসা জন্মায়।”-ক্যাম্পাস সম্পর্কে নিজের অনুভূতি এভাবেই বলেন সদ্য ভর্তি হওয়া নন্দিতা দিশা । বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে আর আড্ডা হবে না সেটা কি হয়! কঠিন কঠিন লেকচার বাদ দিয়ে চলে আড্ডার ধুম। কেউ কেউ আবার ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে দেয় আড্ডা। অনেকেই আবার ক্লাসের মাঝেই চিরকুট চালাচালি করে আড্ডা দেয়। ক্যাম্পাসে আবার আড্ডা দেয়ার জনপ্রিয় কিছু জায়গা রয়েছে। এর মধ্যে শহীদ মিনার, জালাল মামার চায়ের দোকান, ট্যাংকির তলা, ফুচকা চত্বর, কাঁঠাল তলা, ক্যাফেটেরিয়া, টিলা-টালা, ইকোপার্ক ইত্যাদি বেশ জনপ্রিয়।

গবেষণা:

বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর থেকেই সিকৃবি ক্যাম্পাসে গবেষণা হচ্ছে। বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত গবেষণা গুলো হল- গ্রীষ্মকালীন সবজী চাষ। টমেটো বা সীম এখন আর শুধুমাত্র শীতকালে চাষ হবেনা। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান ড. শহীদুল ইসলাম একজন প্রতিতথযশা কৃষি বিজ্ঞানী। সম্প্রতি তার তত্ত্বাবধানে শীমের নতুন দুটি জাত অনুমোদন পেয়েছে। প্রোটিন সমৃদ্ধ তিনি এ জাতগুলোর নাম দিয়েছেন সিকৃবি শিম-১ ও সিকৃবি শিম-২। শিক্ষক হিসেবে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পূর্বে তিনি ১৯৯২ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটে কৃষি বিজ্ঞানী হিসেবে গবেষণা করেছেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৬ সালে পিএইচডি সম্পন্ন করার সময় তিনি লক্ষ করেন শিম টমোটোসহ কয়েকটি জনপ্রিয় সবজি শুধুমাত্র শীতকালে হয়। তখনি তিনি মনে করলেন এই সবজিগুলো যদি গ্রীষ্মকাল সহ সারাবছর পাওয়া যেত তাহলে খুব ভাল হতো। তখনি গ্রীষ্মকালীন শিম ও টমেটো নিয়ে তিনি কাজ শুরু করেন। তার সহয়তায় ইপশা শিম-১ সহ আরো কয়েকটি জাত বের হয়।

২০১১ সালে তাঁর তত্ত্বাবধানে বারি শিম-৭ নামে একটি গ্রীষ্মকালীন শিমের জাত তিনি উন্নত করেন। সিলেট এসে তিনি প্রত্যক্ষ করেন এ অঞ্চলে শিম-টমেটোর বেশ কদর। তিনি সিলেটের গ্রামে গ্রামে গিয়ে গ্রীষ্মকালীন শিম লাগানোর জন্য কৃষকদের উৎসাহিত করেন। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা মাঠ সহ বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি গ্রীষ্মকালীন শিম-টমেটোর পরীক্ষামূলক চাষাবাদ শুরু করেন। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল হিসেবে সারা বাংলাদেশে সিকৃবি শিম-১ ও সিকৃবি শিম-২ জাত দুটি আলোর মুখ দেখলো। এই জাত সিলেটে অঞ্চলে সারাবছর ধরে প্রোটিনের চাহিদা মেটাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।


মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের আরেক বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মোঃ আবুল কাশেম। হাওর এলাকার ধানের ফলন বৃদ্ধির জন্য তিনি কাজ করছেন। বিভিন্ন ডোজের সার প্রয়োগ করে তিনি মূলত গবেষণা কার্যক্রম চালাচ্ছেন। এছাড়া হাওর এলাকায় খামার উন্নয়ন করে কিভাবে মাছ, পশুর পাশাপাশি শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায় সে লক্ষ্যেও তিনি কাজ করে যাচ্ছেন।

কৃষি তত্ত্ব ও হাওর কৃষি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস কাজ করছেন সরিষা নিয়ে। বিস্তীর্ণ হাওর এলাকায় কিভাবে সরিষার নতুন একটি জাত উন্নত করা যায় সে উদ্দেশ্যে তিনি গবেষণা কার্যক্রম চালাচ্ছেন। একই বিভাগের চেয়ারম্যান ড. নজরুল ইসলাম কাজ করছেন আগাছা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ধানের ফলন বৃদ্ধি নিয়ে। এ গবেষণা সফল হলে বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করা যাচ্ছে।

বাংলাদেশের কৃষকরা সাধারণত শীতকালে চাষের জন্য পানি পায় না। কোথাও কোথাও বোরো ধান লাগানো হয় অবশ্য। কৃষি প্রকৌশল ও কারিগরি অনুষদের সেচ বিজ্ঞানী ড. সানজিদা পারভিন রিতু তাই ভিন্নধর্মী একটি গবেষণা চালাচ্ছেন। সিলেটের উঁচু জমিতে এমনিতেই পানির অভাব। পানি না পাওয়ার কারণে হেক্টরের পর হেক্টর জমি অনাবাদী থেকে যাচ্ছে। ড. সানজিদা ভুট্টা দিয়ে তার গবেষণা শুরু করেছেন। এ গবেষণায় সফল হলে সিলেট অঞ্চলের “ক্রপ রোটেশন” পরিবর্তন হতে পারে। কম পানি দিয়েও বছরে ৩টি ফচল চাষ করা যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

বিপন্ন মাছ সংরক্ষণ নিয়ে গবেষণা করেন মৎস্যবীদ ফিসারিজ বায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুব ইকবাল। বর্তমানে তিনি হাওর ও নদী অঞ্চলের বিলুপ্ত প্রজাতির আইর মাছের প্রজনন নিয়ে গবেষণা করছেন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের অর্থায়নে এবং সিলেটের জকিগঞ্জের আমেরিকান ফিস ফার্ম লিমিটেডের সাথে তিনি এ গবেষণা কাজ সম্পন্ন করছেন। মাৎস্য-বিজ্ঞান অনুষদের পাশেই ছোট ছোট রিসার্চ পুকুর বানানো হয়েছে। এছাড়াও সারা ক্যাম্পাসের পুকুরগুলোকে গবেষণার আওতায় আনা হয়েছে। আইর মাছ ছাড়াও ক্যাম্পাসে ফ্রেশ ওয়াটারে চিংড়ি চাষ এবং তাপ দিয়ে মনোসেক্স তেলাপিয়ার লিঙ্গপরিবর্তন নিয়েও কাজ হয়েছে। মাৎস্য-বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থী পীর শাহ মোয়াজ্জেম বলেন- “মাছ নিয়ে পড়াশুনা আমার কাছে এখন খুব অবাক লাগছে। এখানে ভর্তি না হলে জানতামই না কাটাওয়ালা এই প্রাণীটির ভেতর এতো রহস্য লুকিয়ে আছে।”

অপ্রাপ্তি:
এত প্রাপ্তির মাঝেও কিছু না পাওয়ার কথা থেকে যায়। এই যেমন মাত্র ৫০ একর জায়গার উপর একটি ক্যাম্পাস দাঁড়িয়ে আছে। এখানে কোন মাঠ গবেষণাগার নেই। ছোট্ট একটা জমি ছিল যা তাও একাডেমিক ভবন নির্মাণের জন্য ছেড়ে দিতে হলো। ব্যাবহারিক ক্লাসের জন্য প্রস্তাবিত ১৫একর জায়গা এখনো হাতে পাওয়া যায়নি। বাধ্য হয়ে মাঠের বদলে পাত্রে ধান চাষ করা হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীরা হাতে কলমে সম্পূর্ণ শিক্ষা লাভ করতে পারছে না।

বাস নিয়েও ভোগান্তির শেষ নেই। পনেরশ শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র দুটি ছোট বাস। ফলে যারা সিলেট শহর থেকে ক্যাম্পাসে আসেন তারা পড়েন চরম বিপাকে। বাঁদুর ঝোলা হয়ে আসা যাওয়া করতে হয়। ডাইনিং এর খাবার নিয়েও অনেক আপত্তি অনেকের। নতুন ক্যাফেটেরিয়াটিকেও ভাল করা দরকার। ভাল একটা খেলার মাঠ নেই। অডিটোরিয়ামটাও ছোট। তবে সবকিছু ছাপিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রধান দাবী হয়ে উঠেছে জায়গা সংকট। এছাড়া কৃষি অর্থনীতি ও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ এবং কৃষি প্রকৌশল ও কারিগরি অনুষদ এবং বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের নিজস্ব ভবনের অভাবে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে ।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কর্তা অর্থাৎ ভাইস চ্যান্সেলর এবং উপমহাদেশের বিখ্যাত ভেটেরিনারিয়ান অধ্যাপক ড. মোঃ গোলাম শাহি আলম দেখালেন আশার স্বপ্ন-“মাত্র কয়েক বছরে ছয়টি অনুষদকে সাথে নিয়ে সিকৃবি ঈর্ষনীয় সাফল্যের পথে হাঁটছে। সিকৃবির হাত ধরেই সমগ্র বাংলাদেশের বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে কৃষিতে বিপ্লব আসবে। যার কর্ণধার হবে এই ক্যাম্পাসের যোগ্য গ্র্যাজুয়েটরা।”

এক নজরে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
১. ছয়টি অনুষদ
(ক) ভেটেরিনারি এন্ড এ্যানিমেল সায়েন্স
(খ) কৃষি
(গ) মাৎস্য-বিজ্ঞান
(ঘ) কৃষি অর্থনীতি ও ব্যবসায় প্রশাসন
(ঙ) কৃষি প্রকৌশলী ও কারিগরি
(চ) বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং

২. ছয়টি হল
(ক) হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী হল
(খ) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল
(গ) শাহ এ এম এস কিবরিয়া হল
(ঘ) আব্দুস সামাদ আজাদ হল
(ঙ) সুহাসিনী দাস হল
(চ) নতুন ছাত্রী হল

৩. প্রশাসনিক ভবন-১টি
৪. একাডেমিক ভবন-৩টি
৫. মিলনায়তন-১টি
৬. ক্যাফেটেরিয়া- ১টি

স্কুলে ভর্তি হবার পর বাবা-মা তাদের সন্তানদের মাথায় শুধু ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারের ভূত ঢুকিয়ে দেন। কিন্তু কৃষিবিদও ভাল একটি পেশা। শুধুমাত্র কৃষিবিদদের গবেষণা ও পরিশ্রমের ফলে কৃষক আজ টনকে টন ধান, পুকুর ভরা মাছ ঘরে তুলছে। উত্তর পূর্বাঞ্চলের সামগ্রিক কৃষি ব্যবস্থাকে উন্নয়ন করতে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় একটি সম্ভাবনার নাম। ছায়া-সুনিবিড়, সবুজ টিলায় ঘেরা ছোট্ট সুন্দর ক্যাম্পাসে সকলের আমন্ত্রণ রইল

লেখক: কর্মকর্তা, জনসংযোগ ও প্রকাশনা দফতর
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

আপনার মন্তব্য

আলোচিত