শাবি প্রতিনিধি

১৮ এপ্রিল, ২০১৫ ০৪:২৩

শাবিতে উপাচার্য সচিব হতে যাচ্ছেন বিতর্কিত সেই কবীর উদ্দিন!

উপাচার্যের স্বাক্ষর জালিয়াতি, আর্থিক কেলেংকারি, সাবেক উপাচার্যের বাসায় চুরি, নিয়োগ বাণিজ্য, আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের হেনস্থা এবং মুক্তিযুদ্ধের ভার্স্কয নির্মাণ বিরোধী আন্দোলনের সহযোগিতা করার অভিযোগ যার বিরুদ্ধে তিনিই হতে যাচ্ছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সচিব!

তিনি মো. কবীর উদ্দিন। ছিলেন দুর্নীতির দায়ে পদত্যাগকারী বিএনপি-জামায়াতপন্থী উপাচার্য মুসলেহ উদ্দিনের একান্ত সহচর ছিলেন।বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নমান সহকারী হিসেবে যোগদান করেছিলেন এবং এখন অপেক্ষায় আছেন উপাচার্য সচিব হিসেবে নিয়োগ পেতে।

শনিবার ১১টায় আহুত সিন্ডিকেট সভায় এ নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে বলে জানা গেছে। এ নিয়ে আওয়ামীপন্থী শিক্ষক-কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।

কবীর উদ্দিন ২০১২ সালে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মানবিরোধী আন্দোলনে সরাসরি কলকাটি নাড়ার অভিযোগ রয়েছে। তখন জাফর ইকবালকে প্রধান করে গঠিত তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ভাষ্কর্য্যের নকশা নির্বাচনের জন্য নয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে।

নয় সদস্যের কমিটি ভাষ্কর্যের ১৫টি নকশার মূল্যায়ন করে একটি নকশা নির্বাচন করার পর কবীর উদ্দিন ওই নকশার ফটোকপি ও ভাস্কর্য নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ নথি উপাচার্য দপ্তরের পিওন জোবায়ের আনসারিকে দিয়ে বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের হাতে পৌছে দেয়।

পরে সিলেটের সচেতন সিলেটবাসীর ব্যানারে ভাস্কর্য নির্মানবিরোধী আন্দোলকারীরা উপাচার্যকে স্বারকলিপি দেয়ার সময় কবীর কর্তৃক পাচারকৃত নথিগুলোর কপি সংযুক্ত করে দেয়। এবং কবীর বিশ্ববিদ্যালয়ের সব তথ্য ‘সচেতন সিলেটবাসী’ নামের সংগঠনগুলোর কাছে পাচার করে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯১ মো. কবীর উদ্দিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে যোগদান করেন। কিছুদিন চাকরি করার পর ১৯৯২ সালে চাকরি থেকে চলে আসেন।

১৯৯৫ সালে সিলেটের স্থানীয় এক বিএনপি নেতার সুপারিশের ভিত্তিতে তাকে শাবিতে নিম্নমান সহকারী পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তখন তিনি উপাচার্যের দপ্তরে ডেসপাস শাখায় ক্লার্ক হিসেবে কাজ করেন।

১৯৯৬ সালে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক হাবিবুর রহমান নিয়োগ পাওয়ার পর উপাচার্যের বাসার অফিসে ক্লার্ক হিসেবে স্থানান্তরিত করা হয়। পরে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ উদ্দিন নিয়োগের পর বাসার অফিস উঠিয়ে দেওয়া হয়।

২০০১ সালে বিএনপির সরকারের শাসনামলে উপাচার্য হিসেবে শফিকুর রহমান এবং উপ-উপাচার্য হিসেবে মুসলেহ উদ্দিন নিয়োগের পর কবীর উপাচার্যের পিএ হিসেবে কাজ করেন। তখন কবীর উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে নানা ষড়যন্ত্র শুরু করে। পরে আন্দোলনের মুখে শফিকুর রহমান পদত্যাগ করলে মুসলেহ উদ্দিন উপাচার্যের দায়িত্ব পান।

এরপর কবীর পুনরায় মুসলেহ উদ্দিনের পিএ হিসেবে কাজ শুরু করেন। ওই সময় তার খালাতো ভাই, স্ত্রীসহ ছয় জনকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেয়।

অভিযোগ রয়েছে ২০০৪ সালে মদিনা মার্কেট এলাকায় সাবেক উপাচার্য মুসলেহ উদ্দিনের ভাড়া বাসায় স্বর্নালংকার, টিভিসহ নানা সরাঞ্জমাধি চুরির অভিযোগ উঠে কবিরের বিরুদ্ধে। তখন সৈয়দ সলিম মো. আব্দুল কাদির, জয়নাল আবেদিন, মো. মুইনুল হক ও মোরশেদ আহমেদ দিয়ে গঠিত কমিটি তদন্ত সাপেক্ষে তা প্রমানিত হলে কবীর মুসলেহ উদ্দিনের হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেন।

২০০৬ সালে দুর্নীতির অভিযোগে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে বিএনপি-জামায়াতপন্থী উপাচার্য মুসলেহ উদ্দিন ঢাকায় চলে যান। এসময় ৫০ হাজার করে টাকার বিনিময়ে ওই ৬ জনকে সাবেক উপাচার্য মুসলেহ উদ্দিনের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে এডহক ভিত্তিতে নিয়োগের সুপারিশ করে রেজিস্ট্রারের কাছে জমা দেয়া হয়।

বিষয়টি তখনকার সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও বর্তমান পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মজিবুর রহমানের নজরে আসলে উনার সন্দেহ হয় এবং নিয়োগ আটকে যায়। পরবর্তিতে মুসলেহ উদ্দিন পুনরায় ক্যাম্পাসে ফিরে আসলে তার নজরে আনা হলে কবীর ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে যায়।

এদিকে মুসলেহ উদ্দিন ক্যাম্পাসে ফিরে আসায় আন্দোলনকারী শিক্ষকরা উপাচার্যের কার্যালয় ঘেরাও করলে কবীর উদ্দিন উপাচার্যের আস্থা ফিরে পেতে এবং বিশ্বস্ততা অর্জন করতে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের বাঁশ দিয়ে ধাওয়া করে এবং আন্দোলনকারীদের ব্যানার ও পোস্টার ছিড়ে ফেলেন।

কবীর উদ্দিনের তৎপরতা দেখে মুসলেহ উদ্দিন পুনরায় তাকে উপাচার্যের দপ্তরে দায়িত্ব দেন। দুর্নীতির অভিযোগে মুসলেহ উদ্দিন পদত্যাগের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে উপাচার্য হিসেবে আমিনুল ইসলাম নিয়োগের পর কবীর উদ্দিনকে নিম্নমান সহকারী থেকে উচ্চমান সহকারী পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। তখন নিয়োগ বাণিজ্য করতে গিয়ে সাবেক উপাচার্যের পিএস আবুল কালাম এর হাতেনাতে ধরা পড়ে কবীর উদ্দিন।

এছাড়া ১৭ হাজার টাকার জাল ভাউচার উপাচার্যের হাতে ধরা পড়লে কবীর উদ্দিনকে উপাচার্য দপ্তর থেকে স্থানান্তরিত করে গ্রন্থাগার ভবনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ২০০৯ সালে উপাচার্য হিসেবে পুনরায় মো. সালেহ উদ্দিনের নিয়োগের খবর পেয়ে কবীর সালেহ উদ্দিনের ঢাকার বাসায় চলে যান। সালেহ উদ্দিনের স্ত্রীকে ‘মা’ ডেকে সালেহ উদ্দিনের আস্থাভাজন হয়ে উঠে এবং তাকে ঢাকা থেকে সিলেটে নিয়ে আসেন।

তখন মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ইয়াসমিন হক, ড. ইউনুস, হাসানুজ্জামান শ্যামল, মুনিম জোয়ারদার সহ আওয়ামীপন্থী শিক্ষকরা এর প্রতিবাদ জানান এবং কবীরকে চাকরীচ্যুত করতে পরামর্শ দেন। পরে উপাচার্য সালেহ উদ্দিন এর পরামর্শে কবীর উদ্দিনকে জাফর ইকবাল ও ইয়াসমিন হকের কাছে ক্ষমা চাওয়ার পর তাকে চাকরী স্থায়ী করে মোবাইল ভাতাসহ বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে উপাচার্যের পিএ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

পরে সিন্ডিকেট চলাকালীন সময়ে সভায় বসে বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষক গোলাম আলী হায়দার ও আশরাফুল আলমের কাছে মুঠোফোনে তথ্য পাচার করার সময় সালেহ উদ্দিন তাকে হাতেনাতে ধরে সভা থেকে বের করে দেয়া হয়। এ ঘটনায় আবারো ক্ষমা চেয়ে পার পেয়ে যান তিনি।

সালেহ উদ্দিন এর আমলেই উচ্চমান সহকারী থেকে নীতিমালা লঙ্গন করে তাকে সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। অফিসার্স নিয়োগ নীতিমালায় প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পেতে সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে তিন বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার কোন ক্ষেত্রে তৃতীয় বিভাগ গ্রহণযোগ্য নয়।

তবে অভ্যান্তরীনদের ক্ষেত্রে একটি তৃতীয় বিভাগ গ্রহণ যোগ্য, এক্ষেত্রে অতিরিক্ত আরো এক বছরের অভিজ্ঞতা লাগবে এমন নীতিমালা থাকা সত্বেও কবীরের দুইটি তৃতীয় বিভাগ এবং সাড়ে তিন বছরের অভিজ্ঞতা থাকার পর তাকে ২০১২ সালে নীতিমালা লঙ্গন করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।

২০১৩ সালে বর্তমান উপাচার্য আমিনুল হক ভ’ইয়ার নিয়োগের পর তাকে উপাচার্যের পিএ থেকে উপাচার্যের পিএস এর দায়িত্ব দেওয়া হয়। বর্তমানে তিনি ১১হাজার টাকা স্কেলে বেতন পাচ্ছেন।

অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে উপাচার্যের পিএস এর দায়িত্ব পালন করে আসছেন ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদ মর্যাদার কর্মকর্তারা। বর্তমানে তিনি উপাচার্যে সচিব নামে একটি স্থায়ী পদ সৃষ্টি করে ওই পদে নিয়োগের পায়তারা করছে।

যার পদমর্যাদা হবে ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদমর্যাদার সমান এবং বেতন স্কেল হবে ১৮হাজার টাকা। শনিবার ১১টায় আহুত সিন্ডিকেট সভায় এ নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে বলে জানা গেছে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত