নিজস্ব প্রতিবেদক

৩১ আগস্ট, ২০১৫ ১৫:১৪

শাবিতে ছাত্রলীগের ‘কাণ্ডে’ লজ্জিত সাবেক ছাত্রনেতারাও

মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উদ্ধুব্ধ শিক্ষক পরিষদের ভিসির অপসারণ সম্পর্কিত আন্দোলনে ছাত্রলীগ নেতাকর্মী কর্তৃক শিক্ষক লাঞ্ছনার প্রতিবাদে নিজেদের ক্ষোভ ও দুঃখপ্রকাশ করেছেন সংগঠনটির শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) কমিটির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা সাবেক ছাত্রনেতারা।

ফেসবুকে নিজ নিজ টাইমলাইনে দেওয়া স্ট্যাটাসে তারা তাদের ক্ষোভের কথা প্রকাশ করেছেন। সামাজিক, রাজনৈতিক সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজ নিজ অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত সাস্টিয়ান সাবেক এসব ছাত্রনেতারা দুঃখপ্রকাশ করে শাবিতে সংঘটিত এ ঘটনাকে ‘কালো অধ্যায়’ আখ্যা দিয়ে দোষিদের শাস্তি দাবি করেছেন।

তারা সাবেক ছাত্রনেতা হিসেবে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কাছে তদন্তপূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানান।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি মকদ্দস আলী ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে লিখেন- শাবি-এর ঘটনায় অত্যন্ত লজ্জা পেলাম। আহত শিক্ষকদের অনেকেই ছাত্রলীগের মিছিলে ঘনিষ্ঠ সাথী ছিল।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা শাহ ঘটনার একটা লিংক শেয়ার করে লিখেন- আমি শকড্‌, ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। আমি ছাত্রলীগকে বিশ্বাস করি। ১৯৯৭ সালে ছাত্রলীগ ছাড়ার পর তা বদলে গেছে। অনেক দূর চলে গেছে, যা আমার ধারণার বাইরে।

আমি গর্ব করে বলতাম আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ছাত্রনেতাদের নৈতিকতা ও অন্যের প্রতি সম্মানবোধ বাংলাদেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চাইতে ছিল কিন্তু এই দুর্ঘটনা প্রমাণ করল আমি ভুল ভেবেছি।

তিনি আরও লিখেন- আমি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে পরামর্শ দেব শাবিতে কালো অধ্যায়ের সৃষ্টিকারীদের চিহ্নিত করুন এবং তাদের ছাত্রলীগের যে কোন কমিটি থেকে তাদের প্রত্যাহার করুন।

বদরুদ্দোজা শাহ আরও লিখেন- বিশৃঙ্ক্ষলা সৃষ্টিকারী ও অপরাধীদের স্থান ছাত্রলীগে হতে পারে না।

শাবি ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি মোহাম্মদ সাদিকুর রহমান নোমান আক্ষেপ করে লিখেন- ক্যাম্পাসে কি ভালো মানুষ নাই? সব কি হিজড়া হয়ে গেল? ইতর ভিসিকে পিটিয়ে ক্যাম্পাসের বাইরে পাঠায় না কেন? লজ্জা পাচ্ছি সাস্টের সাবেক ছাত্রলীগার বলে!

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ও যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক সুশান্ত দাস গুপ্ত লিখেন- কী লিখবো বুঝে উঠতে পারছিনা। হতভম্ব হয়ে বসে আছি। 

এ আমারই ক্যাম্পাস। এই ক্যাম্পাসে কাটিয়েছি জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো। এই ক্যাম্পাসের সিড়িতে বসেই স্বপ্ন দেখেছি, রাজনীতি শিখেছি, জীবন শিখেছি।

সেই ক্যাম্পাসেই এরকম ঘটনা! আর সেই ঘটনা ঘটিয়েছে আমাদেরই সংগঠন ছাত্রলীগ!

অভিমান, হতাশা আর লজ্জায় বৃষ্টিতে ভিজছেন আমাদের জাফর স্যার! যে মানুষটা আমাদেরকে পথ দেখান, ছাতা হয়ে আগলে রাখেন সেই মানুষটাই ছাতা ছাড়া বৃষ্টিতে ভিজছেন চোখের পানি লুকাতে! এর থেকে অপমানের বিষয় আর কী হতে পারে?

এই দেশে যখনই ক্রান্তিকাল এসেছে ছাত্রলীগ ততবারই রুখে দাঁড়িয়েছে, বুকের রক্ত দিয়েছে। সেই ছাত্রলীগ আজ হামলা করেছে আমাদের প্রিয় ইয়াসমিন ম্যামের উপর, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ধুব্ধ প্রিয় শিক্ষকদের উপর। তাও আবার কণ্ঠে 'জয় বাংলা' স্লোগান নিয়ে, এ লজ্জা রাখবো কোথায়?

বিতর্কিত ভিসি নিজের গদি টিকিয়ে রাখতে ব্যবহার করছেন ছাত্রলীগকে। ভিসির রাস্তা পরিষ্কার করতে ছাত্রলীগ নির্যাতন করছে শিক্ষকদের। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে আমার জন্য এর থেকে লজ্জার কিছু আর হতে পারেনা।

জাফর স্যার, ইয়াসমিন ম্যাম সহ সব শিক্ষকদের কাছে ক্ষমা চাই। আমাদের ক্ষমা করবেন। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার চাই। এ লজ্জার ভার বহন করা আমাদের জন্য কঠিন হবে।

ছাত্রলীগ নেতাকর্মী কর্তৃক শিক্ষকদের লাঞ্ছিতকরণ প্রসঙ্গে সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি ও শাবি ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক নাঈম হাসান ফেসবুকে লিখেন- আমি খুব লজ্জিত! খুবই লজ্জিত!

সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সহ-সাধারণ সম্পাদক ও শাবি ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুজ্জামান খান সুইট লিখেন- আমি দুঃখিত...

উল্লেখ্য, রবিবার (৩০ আগস্ট) সকালে ভিসিবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ব্যানার কেড়ে নিয়ে শিক্ষকদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ।

এদিন সকাল আটটায় প্রশাসনিক ভবন-২(উপাচার্য ভবন) এর সামনে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় ছাত্রলীগের হামলায় অধ্যাপক মো. ইউনুছসহ কয়েকজন শিক্ষক আহত হন। লাঞ্ছিত হন অধ্যাপক ড. ইয়াসমীন হক।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ব ঘোষিত একাডেমিক কাউন্সিল ঠেকাতে রবিবার সকাল ৯টা থেকেই প্রশাসনিক ভবন-২(উপাচার্য ভবন) এর সামনে অবস্থান কর্মসূচী ছিল আন্দোলনকারী 'মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ' শিক্ষক পরিষদের।

অন্যদিকে শিক্ষকদের অবস্থান কর্মসূচি ঠেকাতে সকাল ৭টা থেকেই একই স্থানে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ। পরে সকাল সাড়ে ৭টায় আন্দোলনকারী শিক্ষকরা উপাস্থিত হলে ছাত্রলীগের সাথে বাক-বিতন্ডা হয়। এসময় ছাত্রলীগ কর্মীরা নিজেদের সাধারণ শিক্ষার্থী বলে দাবী করলেও ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি আবু সাঈদ আকন্দ, সহ-সভাপতি অঞ্জন রায় ও যুগ্ম সম্পাদক সাজিদুল ইসলাম সবুজ উপস্থিত ছিলেন।

সকাল আটটায় উপাচার্য তার কার্যালয়ে উপস্থিত হলে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আন্দোলনকারী শিক্ষকরা এ সময় উপাচার্যকে তার কার্যালয়ে প্রবেশ করতে বাধা দিতে চাইলে ছাত্রলীগ কর্মীরা মিছিল করে জোরপূর্বক উপাচার্যকে নিয়ে তার কার্যালয়ে প্রবেশ করেন।

এ সময় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ‘শাবিপ্রবির মাটি/ছাত্রলীগের ঘাঁটি’ স্লোগান দিয়ে শিক্ষকদের উপর হামলাও চালায়। ছিনিয়ে নেয় শিক্ষকদের ব্যানার। দিনভর ক্যাম্পাসে বৃষ্টিতে ভিজে এ ঘটনার প্রতিবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল।

এদিকে, ঘটনায় শাবি ছাত্রলীগ নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে বলেছে এ ঘটনায় ছাত্রলীগ জড়িত নয়। যদি কোন অনুপ্রবেশকারী এ ঘটনায় জড়িত থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ লক্ষ্যে শাবি ছাত্রলীগ সভাপতি সঞ্জিবন চক্রবর্তী পার্থকে প্রধান করে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে অন্যান্যদের মাঝে রয়েছেন, সিনিয়র সহ-সভাপতি আবু সাইদ আকন্দ, সহ-সভাপতি অঞ্জন রায়, ১ম যুগ্ম সম্পাদক সাজিদুল ইসলাম সবুজ, সাধারণ সম্পাদক ইমরান খান।

তবে আন্দোলনরত শিক্ষকদের অভিযোগ, হামলাকারীদের দিয়েই তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ছাত্রলীগ। সরাসরি হামলায় অংশ নেওয়া ছাত্রলীগ নেতাদের অনেকে কমিটিতে রয়েছেন বলে দাবি শিক্ষকদের।

শাবির আন্দোলনকারী শিক্ষকদের অন্যতম নেতা ফারুক উদ্দিন সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, আবু সাইদ আকন্দ, অঞ্জন রায় ও সাজিদুল ইসলাম সবুজ রোববার সকালে শিক্ষকদের উপর হামলায় সরাসরি অংশ নেন। এদের নেতৃত্বেই শিক্ষকদের উপর হামলা চালানো হয় বলে দাবি করেন তিনি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত