১৬ জুন, ২০২০ ০২:০০
কী বলে শুরু করা যায়! সান্ত্বনা নাকি বেদনায় মুষড়ে যাওয়া হৃদয়ের ক্ষরণ, হাহাকার, মাতম নাকি স্মৃতিতর্পণ, অরূপ জীবনালেখ্য নাকি অন্য কিছু?
আজ বরং লিখি 'একজন' কামরান 'সবার' হয়ে উঠার গল্প!
বিশ্বাস করুন, কাল শেষ রাতের করুণ বাতাসে চড়ে যে সংবাদটি ছড়িয়ে পড়ে সবখানে, যে সংবাদটি সুবেহ-সাদিকে ডুকরে উঠা কান্নার বার্তা দিয়ে যায় অযুত-নিযুত মানুষের মনে- তারপর থেকে এ লেখা পর্যন্ত, এই শহরে নামা অচেনা এক শব্দহীন, বোবা, নিকষ আঁধারে ঢাকা সন্ধ্যা পর্যন্ত কোথাও তাঁর একটাও মলিন মুখের ছবি দেখিনি! আজ এ শহরজুড়ে, শহর পেরিয়ে দেশ-দেশান্তরে বইছে যে কান্নার অথৈ জল তা ঠোঁটের কোনে সর্বদা হাসি লেগে থাকা এই মানুষটিরই জন্য।
বদর উদ্দিন আহমদ কামরান! যারা চিনেন তাদের কাছে নামটাই কেবল যথেষ্ট। করোনার প্রাণঘাতী ছোবলে পৃথিবীজুড়ে জীবন গেছে লাখো লাখো মানুষের, মানুষ হৃদয়হীনতারও পরিচয় দিয়েছে অসংখ্য কিন্তু আমি জানি না, কোথাও কী এমন বাঁধভাঙা মানুষের ঢল নেমেছিল; নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে কেবল এক বুক ভালোবাসা নিয়ে আজ যারা সামিল হয়েছিলেন কামরানের শেষ বিদায়ে।
কে ছিলেন কামরান? কিতাবি বর্ণনা তো আছেই। প্রায় সত্তর বছর বয়সী কামরান এক রাজনীতিক এর নাম অথবা প্রায় ত্রিশ বছর নানাভাবে থাকা কামরান একজন জনপ্রতিনিধির নাম... কিন্তু যেখানে তিনি ব্যতিক্রম ছিলেন সেটা হলো দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় একদিন 'জনতার কামরান' হয়ে উঠা, 'সিলেটবাসীর প্রিয় নাম' হয়ে উঠা, 'সিলেটের কামরান', 'ভোটের রাজা' হয়ে উঠা এবং সর্বোপরি সকল শ্রেণি, পেশার মানুষের বন্ধু হয়ে উঠা।
কামরান বন্ধু ছিলেন সকলের, কামরান হাসিমুখে কথা বলতেন তার রাজনৈতিক বিরোধী শিবির থেকে শুরু করে যারা তাকে পছন্দ করতো না তাদের সাথেও, কামরান হাত বাড়িয়ে দিতেন আগে, কামরান সালাম দিতেন আগে, কামরানের হৃদয়টা বড়ো নরম ছিল-বুকে কোন কষ্ট জমা হলে হাউমাউ করে কাঁদতেন সবার সামনেই। কামরান শ্রমজীবী মানুষকে বুকে টেনে নিয়ে কথা বলতেন, প্রিয়জনদের মাথায় হাত দিয়ে কথা বলতেন। সংকটে-সংগ্রামে কামরানই ছিলেন সিলেট নগরীর মানুষের আশ্রয়স্থল। কামরান কৈশোরে চাঁদেরহাট করতেন, শিশু-কিশোর সংগঠন করতেন, কামরান ছড়া লিখতেন, গান গাইতেন, কামরান সংস্কৃতি অন্তঃপ্রাণ ছিলেন, সাংবাদিকবান্ধব ছিলেন - এসবই তাঁকে 'সবার' করে তুলেছ!
বিজ্ঞাপন
না, তিনি এলিট পলিটিশিয়ানদের মতো ছিলেন না, তাকে একগাদা পিএস এপিএস পেরিয়ে পেতে হতো না, অধিকাংশ সময়ই নিজেই ফোন রিসিভ করতেন তিনি, তিনি কল ব্যাকও করতেন। তিনি ছিলেন গণমুখী রাজনীতিবিদ। যে কেউ আপনজনের মতো তাঁর কাছে যেতে পেরেছে। সুখের কথা, দুঃখের কথা জানাতে পেরেছে। রাজপথ থেকে কামরান পারিবারিক ডাইনিং টেবিলে, জনসভা থেকে যেকোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে; বাচ্চার জন্মদিনে কামরান, বিবাহ বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে কামরান, খৎনা অনুষ্ঠানে কামরান, ওয়াজ- কীর্তনে-রথযাত্রাতেও কামরান। এই শহরের অধিকাংশ পরিবারের পারিবারিক এ্যালবামে পাওয়া যাবে তাঁর ছবি। কামরান মানুষের পারিবারিক বন্ধু হতে পেরেছিলেন, সামাজিক বন্ধু হতে পেরেছিলেন, সাংস্কৃতিক বন্ধু হতে পেরেছিলেন। এটাই এক কামরানকে করেছে কোটি জনতার।
তাঁর মতো সহজ করে মানুষের সাথে মেশার ক্ষমতা এ সময়ের খুব কম রাজনীতিকেরই আছে। কামরানের মতো অহিংস রাজনীতিক পাওয়াও বড়ো দুর্বল। প্রতিহিংসার রাজনীতিতে কেউ তাকে কখনো দেখেছে বলে মনে হয় না। পদ-পদবী আর ক্ষমতাকে সাধারণের কাছে নিয়ে যাওয়ার যাদুকরী ক্ষমতাই কামরানকে 'অসাধারণ' বানিয়েছে।
হ্যাঁ, কামরানের জীবনেও উত্থান পতন আছে, সংগ্রাম আর সাহসিকতার অন্য অধ্যায় আছে। কৈশোর থেকে রাজনীতির ক্লাসে ঢুকে পড়ে নানা চড়াই উৎরাই পেরোনোর গল্প আছে। তাঁর ভুল আছে, তাঁর ব্যর্থতা আছে, তাঁর সমালোচনা আছে। আর এই সবকিছু বুকে ঠেলে বার বার এগিয়ে গেছেন বলেই তিনি ' সবার ' কামরান হয়ে উঠেছেন। তিনি নিন্দুকের যেমন ভাই, তেমনই যারা ভালোবাসে, তাদেরও ভাই।
বদর উদ্দিন আহমদ কামরান এক খণ্ড মেঘের মতো বড়ো অসময়ে শূন্যে উড়ে গেলেন। তবে যে শূন্যতা তৈরি হলো, তা গোছাবে কী দিয়ে, কাকে দিয়ে! ক্ষমতালোভী আর জনবান্ধব রাজনীতিক তো এক কথা নয়।
কামরানের মৃত্যু আজ এটাই প্রমাণ করে দিয়ে গেল যে, মানুষের জন্য রাজনীতি করলে মানুষ কখনো ফিরিয়ে দেয় না!
প্রণবকান্তি দেব: শিক্ষক, সংগঠক।
আপনার মন্তব্য