মিহিরকান্তি চৌধুরী

২২ আগস্ট, ২০২১ ১৭:৫৭

শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা : অধ্যাপক এএনএএ মাহবুব আহমেদ

এক কালে বিশেষ করে সত্তরের দশকের আগে তো বটেই সত্তরের দশকের প্রথম দিকে বা পুরো দশকেই জেলা সদর ও তৎকালীন মহকুমা সদরের বাইরে হাতেগোনা দুচারটি কলেজ ছাড়া বেসরকারি বা সরকারি কোনও কলেজ ছিল না। সিলেট অঞ্চলের কথাই ধরা যাক। কুলাউড়া ডিগ্রি কলেজ, তাজপুর ডিগ্রি কলেজ, শ্রীমঙ্গল কলেজ, কমলগঞ্জ কলেজ, ছাতক ডিগ্রি কলেজ, ঢাকাদক্ষিণ ডিগ্রি কলেজ, গোবিন্দগঞ্জ আবদুল হক স্মৃতি কলেজ ও আরও দু’একটি কলেজ ছাড়া উচ্চমাধ্যমিক বা তার উপরের স্তরের কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। গ্রামের ছেলেমেয়েরা শহরে আসত, কেউ হোস্টেলে, কেউ মেসে, কেউ বা আত্মীয়ের বাসায় থেকে পড়াশোনা চালাত। উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতিতে কলেজ শিক্ষকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন তাঁদের মেধা, মনন, ব্যক্তিত্ব ও বাৎসল্য রস দিয়ে।

এমনই এক শিক্ষক, শিক্ষাবিদ ও বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী হচ্ছেন প্রফেসর মাহবুব আহমেদ যিনি সিলেট শহরের সবচেয়ে স্টাইলিশ ও রুচিশীল ব্যক্তিত্বদের অন্যতম। ছিলেন সরকারি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক, এক পর্যায়ে বিভাগীয় প্রধান। ছিলেন সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের উপাধ্যক্ষ, মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ও ঐতিহ্যবাহী সিলেট মুরারিচাঁদ কলেজের অধ্যক্ষ। প্রফেসর মাহবুব আহমেদের মতো ব্যক্তিত্ববান শিক্ষক বর্তমানে খুবই কম। তাছাড়া, বিগত দুই দশক ধরে অ্যাকাডেমিক ইনফ্লাশন মাথা চাড়া দিয়ে উঠায় খাল, বিল, নদীনালা, সাগরের পানি সব এক হয়ে গেছে। কোন পানি কোন জায়গার তা এখন বুঝা দায়।

প্রফেসর মাহবুব আহমেদ হচ্ছেন স্যূট, সাফারি, শার্ট প্যান্ট, হাফ শার্ট, টি-শার্ট, লুঙ্গি-গেঞ্জিসহ সকল সম্ভাব্য পোষাকে মানানসই সৌম্যকান্তি চেহারার এক রাজপুরুষ। তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন বা আছেন। এর মধ্যে সিলেট লায়নস ক্লাব, সিলেট স্টেশন ক্লাব, জেলা ক্রীড়া সংস্থা ডিএসএ ও সিলেট রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

প্রফেসর মাহবুব আহমেদ শিক্ষাঙ্গন ছাড়াও ক্রীড়া জগতের লোক, ক্রিকেট জগতের লোক। নানা খেলাধূলা বিশেষ করে ক্রিকেটের সাথে তাঁর ছিল চির এক সখ্য। এক সময় জেলা ক্রীড়া সংস্থা ডিএসএর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাঁর কার্যকালেই বর্তমান সিলেট স্টেডিয়াম নির্মিত হয়। ত্রিশ পয়ত্রিশ বছর আগে নির্মিত স্টেডিয়াম ও স্টেডিয়াম মার্কেট ২০২১ সালেও যুগের দাবি মেটাচ্ছে। বড়ো ক্যানভাসে মানানসই এক নাম মাহবুব আহমেদ। সংগঠক হিসেবে, উদ্যোক্তা হিসেবে নামডাক আছে তাঁর। ঐতিহ্যবাহী সিলেট লায়নস ক্লাব ও সিলেট স্টেশন ক্লাবের সাথেও জড়িত আছেন, সদস্য। যতদূর জানি লায়ন্স ক্লাবের রিজিওন চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন। সিলেট স্টেশন ক্লাবের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তাঁর অবদান ও অংশগ্রহণ রয়েছে। দীর্ঘদিন সিলেট রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি সিলেট শাখার সভাপতি ছিলেন। তাঁর কার্যকালে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি বেশ গতিশীল একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। ক্রিসেন্ট সোসাইটির সাথে এখনও জড়িত আছেন।

প্রফেসর মাহবুব আহমেদ স্যার ও অধ্যাপক বিজিতকুমার দে স্যারের টয়োটা টু ডোর পাবলিকা ছিল সিলেটখ্যাত। যথাক্রমে সিলেট- ৩৭৭৩ ও সিলেট ৩৭৫৩ নাম্বারের কার। এগুলোকে অন্তত আধ মাইল দূর থেকে চিনতাম। পয়ত্রিশ, চল্লিশ বছর আগের কথা খুবই তরতাজা, টাটকা রয়েছে মনে। শহরে শত শত গাড়ীর মধ্যে চার পাঁচটা গাড়ীর রং, হর্ন এখনও চোখের সামনে ভেসে ওঠে, কানে বাজে। প্রফেসর মাহবুব আহমেদ স্যার ও অধ্যাপক বিজিতকুমার দে স্যারের গাড়ির বাইরে একটা ছিল জনাব এমএস দৌলার লাল রংয়ের সুবারু কার। বাকীগুলোর মধ্যে ছিল মিসেস সুরাইয়া রাজা চৌধুরীর টয়োটা স্প্রিন্টার ও ইউনাইটেড সেন্টারের জনাব আব্দুল মতিন খানের কমলা রংয়ের টয়োটা করোলা। এসব গাড়ির রং ও নাম্বারের বিশেষত্ব ছিল শহরের যেকোনও জায়গায় পার্ক করা থাকলে কোনও টোকাই এসে গাড়ির বডি নিয়ে খেলা করতে পারত না, ইটের টুকরা বা ছোটো পাথর দিয়ে দাগ দিতে পারত না।

আমার ও আমাদের সিলেটে আসা, এখানকার সমাজের সাথে যুক্ত হওয়া, আমার শিক্ষকতায় সুযোগ পাওয়া, সুবিধা পাওয়া ইত্যাদির পেছনে প্রথম পর্যায়ে বেশ কয়েকজন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্বের অবদান আছে। ১৯৮৪ সালে প্রথম পর্যায়ে ছিলেন মিসেস সুরাইয়া রাজা চৌধুরী, অ্যাডভোকেট সুলেমান রাজা চৌধুরী, Blue Bird School এর (পরবর্তীতে স্কুল ও কলেজ) অধ্যক্ষা মিসেস রাবেয়া খান আহমেদ, মুরারিচাঁদ কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মাহবুব আহমেদ ও আমার ভাগ্নির জামাই কানুমামা বা হিমাংশুশেখর দে। ১৯৮৬ সালে পরিচয়ের পর থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ে ছিলেন জনাব সালেহ উদ দৌলা, মিসেস সুরাইয়া দৌলা, জনাব নওয়াব আলী, মিসেস রিহানা আলী, জনাব আবুল হাসনাত চৌধুরী ও মিসেস রুহেনা হাসনাত চৌধুরী।

উল্লেখ্য, তার আগে ১৯৮০ সালে আমার বাবার মৃত্যুর পর আমাকে শাহবাজপুর হাইস্কুলে শিক্ষকতার সুযোগ দিয়েছিলেন আমার শিক্ষাগুরু জনাব আছদ্দর আলী ও বিশিষ্ট আইনজীবী অ্যাডভোকেট তবারক হোসেইন। আমি তাঁদের সকলের কাছে চিরকৃতজ্ঞ।

প্রফেসর মাহবুব আহমেদ ও মিসেস রাবেয়া খান আহমেদের ছেলেমেয়েরা এলিজা, শীলা, আদনান ও মঞ্জুর আমার ছাত্র। তাঁরা অত্যন্ত মনোযোগী ছাত্র ছিল। বড়ো কথা, মাহবুব স্যার বা রাবেয়া আপা কেউই শিক্ষক হিসেবে তাঁদের ছেলেমেয়েদের শাসন করতে বাধা দিতেন না, দূঃখিত হতেন না বা নাক গলাতেন না। আমিও পড়াতে গিয়ে তাঁদের ছেলেমেয়েদের ছাত্র হিসেবেই বিবেচনা করেছি, বসের ছেলেমেয়ে বা শ্রদ্ধাভাজন মাহবুব স্যারের ছেলেমেয়ে মনে করিনি। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা কোনও কোম্পানির তেলের ভাণ্ড আমার ছিল না। এ মানের অভিভাবক বর্তমানে খুবই কম।

প্রফেসর মাহবুব আহমেদ স্যারের সাথে পরিচিতির প্রায় সাড়ে তিন দশক। অনেক স্মৃতি আছে তাঁর সাথে, তাঁর পরিবারের সাথে। ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পরপর সিলেটের প্রতিক্রিয়াশীল মহল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিকল্পনা করে। সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের প্রভাবশালী বিবেকমান অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্বদের কড়া হুশিয়ারিতে তারা এগোতে পারেনি। ওই সময়ের থমথমে পরিস্থিতিতে প্রফেসর মাহবুব আহমেদ স্যার আমার ও আমার পরিবারের স্মরণযোগ্য খোঁজখবর নেন এবং সশরীরে আমাদের বাসায় উপস্থিত হয়ে অভয় প্রদান করেন। এ বিষয়গুলো আলজেইমার বা ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত না হলে ভুলে যাওয়ার কথা নয় আমার পক্ষে, আমাদের পক্ষে বা যে কারও পক্ষে।

প্রফেসর মাহবুব আহমেদ মুরারিচাঁদ কলেজ থেকে অবসর নেওয়ার পর ব্রিটিশ বাংলাদেশ ইন্টান্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজের অ্যাডভাইজার। বার্ষিক এক অনুষ্ঠানে অপরাজেয় বাংলাখ্যাত বিশিষ্ট স্থপতি প্রফেসর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ প্রধান অতিথি। প্রফেসর খালিদের বাড়ি সিলেটে। শহরের জিন্দাবাজার এলাকার কাজী ইলিয়াস মহল্লায় তাঁর পৈতৃক ভিটা। তিনি তখন চট্টগ্রামে থাকেন। চারুকলা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক। ব্রিটিশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজের পক্ষে অ্যাডভাইজার প্রফেসর মাহবুব আহমেদ তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এবং জিজ্ঞেস করেছেন তাঁর বাড়ির বাইরে সিলেটে আর কাউকে নিমন্ত্রণ ‍দেওয়া যায় কি না। প্রফেসর খালিদ স্যারকে জানালেন, সিলেটে আমার এক প্রিয়ভাজন ব্যক্তি আছেন, নাম মিহিরকান্তি চৌধুরী। যদি সম্ভবপর হয় উনাকে একটা দাওয়াত দেবেন। মাহবুব স্যার আমাকে ফোন করে দাওয়াত দিলেন, আমি তাঁর স্নেহভাজন দাওয়াতী। কিন্তু তাঁর মধ্যে একটা বিষ্ময় কাজ করল, প্রফেসর খালিদ মিহিরকে কেমন করে চেনেন। জিজ্ঞেস করলেন। আমি আর কী বলতে পারি? বললাম, “স্যার, বিষয় হচ্ছে আমি উনাকে চিনি।”

২০০৭ সালের দিকে তিনি ইডেন গার্ডেন স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ। আমি তখন তাঁর নিকট প্রতিবেশী। একই আঙিনায় তাঁর বড়ো ভাইয়ের বাসায় ভাড়া থাকি। এক শনিবারে ইডেন কলেজে লাঞ্চে আমার দাওয়াত। দাওয়াত রক্ষা করতে গিয়ে দেখি নতুন কলেজের শিক্ষক ইন্টারভিউ। সেখানে উপস্থিত এমসি কলেজের অনেক কৃতবিদ্য শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ইংরেজির প্রফেসর হায়াতুল ইসলাম আকঞ্জি, পদার্থবিজ্ঞানের প্রফেসর রতীশ তালুকদার, রসায়ন বিজ্ঞানের প্রফেসর রণধীর দত্ত চৌধুরীসহ আরও অনেকে। স্যার পরিচয় করিয়ে দিলে প্যানেলের অনেকেই বললেন যে আমি তাঁদের পরিচিত। লাঞ্চের পর ভাইভা টেস্ট। বিদায় নিতে চাইলে বললেন ইন্টারভিউতে থাকতে। সাবজেক্ট এক্সপার্ট এর আওতা বেশি। এর বাইরে ২৫ নম্বরের আইকিউ টেস্ট। নানাজনের নানা প্রশ্ন। মাহবুব স্যার কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে আমিও দু’চারটা প্রশ্ন করলাম। আমার তো সেই যোগ্যতা নেই। তাই ইন্টারভিউ বোর্ডের কাঁধে বন্দুক রেখে কাজ সারলাম। বাংলার এক প্রার্থীকে জিজ্ঞেস করলাম, “ইন্টারভিউ বোর্ড আপনার কাছে জানতে চাচ্ছেন, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সাথে গফুর মিয়ার সম্পর্ক কী ছিল। তিনি বলতে পারেননি। তিনি চলে গেলে একজন এক্সপার্ট বললেন, গফুর মিয়া সিলেট স্টেশন ক্লাবের বাবুর্চি। সবাই হাসলেন অকৃক্রিমভাবে। আসলে সেই গফুর মিয়াও বাবুর্চি ছিলেন, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির যার কর্তা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তথ্যটি অনেকের মধ্যে বিষ্ময় জাগালো। বাংলার আরেক প্রার্থীকে জিজ্ঞেস করলাম, “ইন্টারভিউ বোর্ড আপনার কাছে জানতে চাচ্ছেন, “কাদম্বরী চক্রবর্তীর সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক কী ছিল। তিনি লাইনে রওয়ানা দিয়ে মাঝপথে বেলাইন হয়ে যান। বললেন, “রবীন্দ্রনাথের নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী, রবীন্দ্রনাথের বৌঠান”। এটাও হয়নি। আসলে নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী, রবীন্দ্রনাথের বৌঠান ছিলেন কাদম্বরী দেবী, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির বাজার সরকার শ্যামলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে। কাদম্বরী চক্রবর্তী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রিয় কবি ও বেয়াই বিহারীলাল চক্রবর্তীর স্ত্রী, রবীন্দ্রনাথের বেয়াইন । রবীন্দ্রনাথের বড়ো মেয়ে মাধুরীলতা দেবীর সাথে চক্রবর্তী দম্পতির বড়ো ছেলে শরৎকুমার চক্রবর্তীর বিয়ে হয়েছিল। এই বিয়েতে কাদম্বরী চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথের নিকট থেকে বিশ হাজার টাকা যৌতুক দাবি করে বারো হাজার টাকায় রফা করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এক প্রার্থীকে প্রফেসর গিয়াসউদ্দিন আহমেদ কাগজ কলম এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস বললেন, “জন লকের নাম শুনেছেন?” “জ্বি, স্যার।” এই যে কাগজ, ইংরেজিতে জন লকের নামটি লিখুন।” কিছুটা থতমত খেয়ে লিখলেন, “John Lock”। “আসেন।” ইন্টারভিউ শুরু হতেই “আসেন” মানে “জলদি ভাগেন।” একজন প্রার্থীকে যাচাই করতে বেশি কিছু লাগে না। পরবর্তীকালে ইডেন কলেজে সিলেট অঞ্চলের শিক্ষা নিয়ে একটা সেমিনারের আয়োজন হয়। স্যারের পছন্দে সেমিনার পেপারের প্রবন্ধকার আমি। তাঁর ও আমার বাসার দূরত্ব মাত্র কয়েক ফুটের। তারপরও তিনি আমাকে তেমন কিছু বললেন না। শুধু বললেন, “আমাদের কলেজের দুইজন ডাইরেক্টর তোমার সাথে একটা সেমিনার নিয়ে আলাপ করবেন।” পরে দেখি জনাব হেলাল আহমেদ ও জনাব ইকরামুল কবির আমার সাথে দেখা করে বিস্তারিত জানালেন। আমি তাঁর অনুজপ্রতিম, ছোটোভাই হলেও সেমিনারের প্রাবন্ধিককে পথেঘাটে দাওয়াত দেননি। এমনই মাত্রাজ্ঞান ছিল তাঁর যা এখন বড়ো বড়ো পদের অধিকারীর মধ্যেও দেখা যায় না।

ভদ্রসমাজে বিধান আছে, সব ছোটো মেয়ের শ্বশুর নিজের সব বড়ো ছেলের সমবয়সী বা ছোটো হলেও তাঁকে পুত্রবৎ মানলে চলে না, বেয়াই মানতে হয়। ছোটোভাই এমনকি নিজের ছেলে হলেও আনুষ্ঠানিক প্লাটফর্মে তাকে বয়সের বিবেচনায় বা পোর্সোনাল ক্যাপাসিটিতে দেখার কোনো সুযোগ নেই। আমি শুধু সৌজন্যের কথাটাই বললাম। সেমিনারের প্রস্তাবিত প্রধান অতিথি ছিলেন সিলেট শিক্ষাবোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মো. আব্দুল খালেক। আমি সবকিছু সম্পন্ন করলেও প্রধান অতিথি সময় দিতে পারছিলেন না। একসময় দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রফেসর ড. মো. আব্দুল খালেক পরলোকগমন করেন। পরে আর সেমিনারটি হয়নি। মাহবুব স্যারও ইডেন কলেজ ছেড়ে দেন।

২০১২ সালের ১২ নভেম্বর। আগেই বলেছি আমি তাঁর নিকট প্রতিবেশী। একই আঙিনায় তাঁর বড়ো ভাই জনাব মাসুম সাহেবের বাসায় ভাড়া থাকি। অনেক বড়ো বাসা, ২৭০০ বর্গফুট। আমার বইয়ের সংগ্রহ বাসার বড়ো এক জায়গা দখল করে আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিকবিষয়ক মাননীয় উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী আমার বাসার শুভাগমন করেন। সিলেটের জেলা প্রশাসক জনাব খান মোহাম্মদ বিলাল, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জনাব মিজানুর রহমান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) জনাব শাহাবুদ্দিন খান, দক্ষিণ সুরমার ইউএনও মিসেস সাবেরা আক্তার, তাঁর স্বামী শাবির অধ্যাপক মাজহারুল ইসলাম, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জনাব সালাউদ্দিসহ জেলা প্রশাসনের অনেক কর্তাব্যক্তি, চিকিৎসক, আইনজীবী, সাংবাদিকতা-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের বরেণ্যজন উপস্থিত ছিলেন, ছিলেন মাহবুব স্যার, রাবেয়া আপা মিসেস রাবেয়া খান আহমেদ ও সুপ্রিয় চক্রবর্তী রঞ্জুদা। মাহবুব স্যার, রাবেয়া আপাকে পেয়ে ড. গওহর রিজভী স্যার যারপর নাই উচ্ছ্বসিত হলেন। প্রফেসর মাহবুব আহমেদ ও ড. গওহর রিজভী দুজনই ফৌজিয়ান অর্থাৎ ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্র। প্রফেসর মাহবুব আহমেদ দুই বছরের সিনিয়র। কিছুক্ষণ তাঁদের মধ্যে ফৌজিয়ান কায়দায় আলাপচারিতা, তারপর আমাদের মতো সিভিলিয়ান কায়দায়। মান্যবর ড. গওহর রিজভীকে দেখলাম সিনিয়রকে যথেষ্ট সম্মান দিতে, সম্মান দিয়ে কথা বলতে। আর রাবেয়া আপার বাবার বাড়ি এবং বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়মহলের অনেকের সাথে ড. রিজভীর আত্মীয়তা আছে। রাবেয়ার ছোটোভাই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জনাব সাহেদুল আনাম খান ড. রিজভীর বন্ধু, ছোটোবেলা থেকে ক্যাডেট কলেজ শেষ করা পর্যন্ত। প্রকারান্তরে তিনিও আত্মীয়। আত্মীয়তাসূত্রের বাইরে সিনিয়র ফৌজিয়ানের স্ত্রীর সাথে আলাপে যথেষ্ঠ সমীহ ও সম্মানের ছাপ রেখে গেলেন। মর্যাদা বাড়ল সকলেরই। মান্যবর ড. গওহর রিজভীর সম্মানে একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয় টেগোর সেন্টার, সিলেট এর পক্ষ থেকে। ওই দিন আমার বইয়ের পুরো সংগ্রহ নিয়ে টেগোর সেন্টার, সিলেট এর যাত্রা শুরু হয়। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রফেসর মাহবুব আহমেদ ও সুপ্রিয় চক্রবর্তী রঞ্জুদা বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। আমার একটি বইয়ের মোড়কও উন্মোচন করা হয়, ‘Tagore-Einstein Relations’। তার আগে দীর্ঘ প্রবন্ধ হিসেবে জার্মানিতে জার্মান, ইংরেজি ও বাংলা- এই তিন ভাষায় প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধের কন্টেন্ট ১৪,০০০ শব্দের। আপ্যায়ন পর্বে সকলে পরষ্পরের সাথে অন্তরঙ্গভাবে কথাবার্তা বলেন, ছবি তোলেন। ড. গওহর রিজভী স্যার অফার দিয়েছিলেন দুই বছরের জন্য শান্তিনিকেতনে স্কলারশিপ নিয়ে যেতে। আমার ব্যক্তিগত অসুবিধায় যেতে রাজি হইনি। এবারও প্রফেসর খালিদ পর্বের মতো তাঁর মধ্যে একটা বিষ্ময় কাজ করল, প্রফেসর ড. গওহর রিজভী মিহিরকে কেমন করে চেনেন। জিজ্ঞেসও করলেন একবার। আমি আর কী বলতে পারি? আমার একটা উত্তর মুখস্থ আছে। বললাম, “স্যার, বিষয় হচ্ছে আমি উনাকে চিনি।” নিচ থেকে তো বড়ো গাছ দেখা যেতেই পারে। উপর থেকে নিচ দেখাটা জটিল, কঠিন ও অবাস্তব।

২০০৮ সালের দিকে আমি বেশ সমস্যায় ছিলাম। অ্যাকাডেমিক লাইনের একটি চাকরি সন্ধান করছিলাম। হঠাৎ দেখি, খাজাঞ্চিবাড়ি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি বিজ্ঞাপন। ভাইস প্রিন্সিপাল পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি, দ্বিতীয় ভাইস প্রিন্সিপাল। মাহবুব স্যার এই প্রতিষ্ঠানের একজন ট্রাস্টি। তাঁর সাথে আলাপ করলাম। বললেন, “আবেদন কর।” শুধু তাই নয়, আমার সামনেই তাঁর ড্রয়িং রুমে বসিই অন্য এক ট্রাস্টির সাথে আমার বিষয়টি আলাপ করলেন। আকারে ইঙ্গিতে বুঝলাম অপর প্রান্তের ট্রাস্টি মহোদয়ের আমার বার্থ সার্টিফিকেট পছন্দ হয়নি। আমিও দেখলাম অন্য একটা টেকনিক্যাল সমস্যা রয়েছে, তাই আবেদন করিনি। খাজাঞ্চিবাড়ি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রিন্সিপাল মি. প্রাণবন্ধু বিশ্বাস হিন্দু ধর্মাবলম্বী, প্রথম ভাইস প্রিন্সিপাল মিসেস ভারতী দেব হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এখন যদি দ্বিতীয় ভাইস প্রিন্সিপালও হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়, তবে জনগণের একাংশ বলবে খাজাঞ্চিবাড়ি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ হিন্দুস্তান হয়ে গেছে। শুনতে যেমনই লাগুক, এটাই আমাদের সমাজের বাস্তবতা। প্রতিষ্ঠানকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে দেওয়া উচিত নয় বলে এগোইনি।

প্রফেসর মাহবুব আহমেদ উচুঁমনের মানুষ। মুরারিচাঁদ কলেজে অধ্যক্ষ থাকাকালীন বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বীরেশ চক্রবর্তী কন্ঠনালীর ক্যানসারজনিত কারণে কন্ঠ হারিয়ে ফেলেন, তাঁর স্বরযন্ত্র অপসারণ করা হয়। একটা মেশিনের সাহায্যে কথা বলেন। সরকারি চাকরি আছে আরও কয়েক বছরের। এত জটিল চিকিৎসা পরবর্তী পরিস্থিতিতে অধ্যাপক বীরেশ চক্রবর্তীকে বাংলা বিভাগে পুনরায় যোগদান করার সুযোগ ও অনুমতি দিয়েছিলেন প্রফেসর মাহবুব আহমেদ। অন্য অধ্যক্ষ কী করতেন তা বলা মুশকিল।
প্রফেসর মাহবুব আহমেদ স্যারের বাবা মরহুম আশরাফ আলী সাহেব একজন সমাজসেবী ও উদ্যোক্তা ছিলেন। পেশাগত দিক থেকে ছিলেন বীমার নির্বাহী । ১৯৬১ সালে সিলেটের ব্লু বার্ড স্কুল প্রতিষ্ঠায় তাঁর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল। তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।

অন্যান্য প্রতিষ্ঠাতারা হলেন জনাব এস.এম. ওয়াসিম সিএসপি, জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও চেয়ারম্যান, জনাব আমিনুর রশীদ চৌধুরী, ডা. জামশেদ বখত (কোষাধ্যক্ষ), জনাব আবদুল হাফিজ (১৯৬১-৬৬), অ্যাডভোকেট শহীদ আলী, অধ্যক্ষ সলমান চৌধুরী, জনাব আবদুর রহমান, মি. নির্মল কুমার চৌধুরী, মিসেস আলী, জনাব আলাউদ্দিন, জনাব ফজল এলাহী শেখ (১৯৬২-৬৪), জনাব আজমল আলী, অ্যাডভোকেট আবদুল হাই। জনাব আশরাফ আলী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপালন করেন (১৯৬১-৬৬)। স্কুলের প্রতিষ্ঠা ও সার্বিক উন্নয়নে সম্পাদক হিসেবে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। জেলা প্রশাসক (ডিসি) জনাব এস.এম. ওয়াসিম সিএসপি এক সময় বদলি হয়ে গেলে জেলা প্রশাসক (ডিসি) হয়ে আসেন জনাব কাজী ফজলুর রহমান সিএসপি। জনাব কাজী ফজলুর রহমানের সাথেও তাঁর টিমওয়ার্ক ভালো ছিল। আজ ব্লু বার্ড স্কুল উচ্চমাধ্যমিক কলেজে উন্নীত হয়ে এক বিশাল প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়েছে। বেগম সিরাজুন্নেসা, জনাব জেড আর জাহিদ, সৈয়দ মোতাহার উদ্দিন, জনাব মোস্তাকিম আলী, জনাব আবদুল মান্নান, জনাব নুরুল হুদা, দেওয়ান তৈমুর রাজা, জনাব সাইফ খান, ডা. এম. আহমেদ, মিসেস হুসনে আরা আহমেদ, মিসেস ফাহমিদা রশিদ চৌধুরী, অ্যাডভোকেট শাহ মোদাব্বির আলী, অধ্যক্ষ মাসউদ খান প্রমুখ। জনাব আশরাফ আলী সাহেবের পর সচিবের দায়িত্ব নেন ডা. এম. আহমেদ। অধ্যক্ষ হিসেবে মিসেস সোমিংস, মিস জে ক্যাপস্টেড, মিসেস সাজেদা খানম চৌধুরী, মিসেস মাসুদা বেগম হয়ে মিসেস রাবেয়া খান আহমেদ। এর পর অনন্য এক ইতিহাস। জেলা প্রশাসকরাই স্কুলের পদাধিকার বলে চেয়ারম্যান। জনাব কাজী ফজলুর রহমানের (সিএসপি) পর জনাব এস.এম.এইচ চিস্তি সিএসপি, জনাব মোকাম্মেল হক সিএসপি, জনাব শফিউল আলম, সিএসপি, জনাব আবদুস সামাদ, সিএসপি ও জনাব ইরশাদুল হক, সিএসপি। ১৯৭৫-পরবর্তী আরেক ইতিহাস। আলাদা লিখব। এখানে শুধু জনাব আশরাফ আলী সাহেবের সতীর্থ, সহযোগী ও সমসাময়িকদের কথা বললাম। এই সংক্ষিপ্ত বয়ানে পাঠকদের আগ্রহ সৃষ্টি হলে নাতিদীর্ঘ রচনা আসবে। প্রায় তৈরি আছে। শুধু বাগাড় দিতে হবে। ব্লু বার্ড স্কুলের গোড়াপত্তনে মাহবুব স্যারের বাবার ভূমিকার পর ১৯৭৯ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত তাঁর স্ত্রী মিসেস রাবেয়া খান আহমেদ অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া তাঁদের মেয়ে আফরাহিম আহমেদ এলিজা এ স্কুলে প্রায় ২৫ বছর যাবৎ শিক্ষকতা করছেন। সুতরাং এ প্রতিষ্ঠানের সাথে আহমেদ পরিবারের বন্ধন অত্যন্ত দৃঢ়, সংযোগ অত্যন্ত টেকসই। প্রফেসর মাহবুব আহমেদ তাঁর বাবার যোগ্য সন্তান হিসেবে বাবা মরহুম আশরাফ আলী সাহেবের নাম নিজের নামে ধারণ করে চলেছেন, নাম লিখেন আবু নছর আলী আশরাফ (এ.এন.এ.এ) মাহবুব আহমেদ।

প্রফেসর মাহবুব আহমেদ অত্যন্ত অসাম্প্রদায়িক এক ব্যক্তিত্ব। তাঁর মতো ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে থাকলে নিজেকে নানা বিবেচনায় সুরক্ষিত মনে হয়। আমার প্রোফাইল ছোটো। শুধু মাঝারি মান ও স্তরের শিক্ষক হিসেবে মোটামোটী একটা পরিচিতি আছে। তবে আমার কর্মপ্রচেষ্টায় সমাজে যাঁদের প্রেরণা, উৎসাহ ও সায় ছিল প্রফেসর মাহবুব আহমেদ তাঁদের অন্যতম।

প্রফেসর মাহবুব আহমেদ উচ্ছ্বাসে ভরা একজন টগবগে তরুণ। তাঁর অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু জনাব গৌছুল আলম সাহেব ও তাঁর বড়ো ভাই জনাব মাসুম সাহেবের মৃত্যু তাঁকে বড়ো ধাক্কা দিয়েছে মানসিকভাবে। বাধভাঙা উচ্ছ্বাসের জায়গা নিয়েছে নিয়ন্ত্রিত উচ্ছ্বাস।

প্রফেসর মাহবুব আহমেদ স্যারের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।


মিহিরকান্তি চৌধুরী : লেখক, অনুবাদক ও নির্বাহী প্রধান, টেগোর সেন্টার, সিলেট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত