সৈয়দ মনির হেলাল

২৬ জানুয়ারি, ২০২২ ০১:০৫

শাবিপ্রবির সাম্প্রতিক সঙ্কট: উত্তরণের পথ, একটি প্রস্তাবনা

সবখানেই উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা—এ সঙ্কট থেকে উত্তরণ কীভাবে সম্ভব! কীভাবে সম্ভব—শিক্ষার্থীদেরকে ক্লাসে ফেরানো, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে (শাবিপ্রবি) আবারো সচল করার পথ কী! আন্দোলনকারী ছাত্রদের দাবি ভিসিকে পদত্যাগ করতে হবে, ভিসি বলছেন ছাত্রদের দাবি ইতোমধ্যে পূরণ করা হয়েছে, আর মধ্যস্থতাকারী শিক্ষক-রাজনীতিকদের কথা—আলোচনায় বসি, আলোচনা করি।

১৩ জানুয়ারি থেকে আজ তেরো দিন; ১৯ জানুয়ারি থেকে অনশনের সাত দিন—ছাত্রদের পেটে একটাও দানাপানি নেই, বই-খাতা-ল্যাব ছেড়ে নির্ঘুম রাত পার করছে খোলা সড়কে, শিক্ষকরা উদ্বেগ-আশঙ্কায় রাত-দিন ঘুরছেন রাস্তায় রাস্তায়, ভিসি সপরিবারে অবরুদ্ধ, কোন বিবেকবান মানুষই এটা মানতে পারবেন না।

ছাত্রদের এক কথা, আগে ভিসিকে পদত্যাগ করতে হবে। কারণ কী? কারণ ভিসি ছাত্রদের সমস্যাগুলোকে গুরুত্ব দেননি, পুলিশ ডেকে এনেছেন। আর পুলিশ ছাত্রদের ওপর হামলা করেছে, টিআর ছুড়েছে, সাউন্ড গ্রেনেড মেরেছে, গুলি করেছে। তারপর, তাদের ওপর মামলা করিয়েছেন। ছাত্রদের ক্ষোভ অত্যন্ত যৌক্তিক। এবং ছাত্ররা এমনই হবে—সকল প্রকার অন্যায় অনিয়মের বিরুদ্ধে সকলের আগে ছাত্ররাই সোচ্চার হবে, ইতিহাসও এমন সাক্ষ্যই দেয়। একই সাথে আমাদের মনে রাখতে হবে, যে শিক্ষকের কাছ থেকে জীবনের পাঠ নিচ্ছি, তাকে গালি দিয়ে কী অর্জন করতে চাচ্ছি আমরা? শিক্ষকদের সাথে আমাদের বাহাস হতেই পারে, কিন্তু তা কি শালীনতা, সভ্যতা-ভব্যতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে? ভিসি তো একটি প্রশাসনিক পদ মাত্র, তার আগে তো তিনি একজন শিক্ষক।

তবে সমস্যাটি অন্যখানে। আমরা নিকট অতীতেও দেখেছি—বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে ক্ষোভ-আন্দোলন শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা ছড়িয়েছে। সেই আন্দোলনগুলি যেনতেন প্রকারে সামাল দেওয়ার পর কেউ আর খোঁজ-খবর রাখেননি। ফলে ক্ষোভ-বিক্ষোভ ছাই-চাপা পড়ে যায় যথারীতি। সমস্যাগুলোও আরও প্রকট থেকে প্রকটতর হতে থাকে। আমাদের মনে রাখতে হবে, উচ্চশিক্ষার ধারাটা চালু রাখতে হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তা না হলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি থেমে যেতে বাধ্য। শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণের বিপদ সম্পর্কে আমরা কি ওয়াকিবহাল নই?

না, একজন ভিসি পদত্যাগ করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে- এমনটা মনে করার কোন কারণ নাই। ছাত্রদের সমস্যার কথাগুলো না শোনা, সেগুলোর ত্বরিত সমাধানের পদক্ষেপ না নেওয়া, অবশ্যই ভিসির ব্যর্থতা। একটি স্বায়ত্তশাসিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কী করে পুলিশ এলো, কতটা জরুরি ছিল—সেগুলো নিশ্চয়ই খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিংবা ভিসিকে নিশ্চয়ই জবাবদিহি করতে হবে।

তাই বলছিলাম, ভিসিকে তার ব্যর্থতার দায় স্বীকার করার সুযোগটা দিতে হবে আগে! আন্দোলন কখনো আবেগ, জেদ কিংবা প্রতিহিংসা দিয়ে হয় না। ছাত্রদেরকে আরও বুদ্ধিদীপ্ত, বাস্তবানুগ এবং দূরদর্শী হতে হবে। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, আন্দোলনকারী ছাত্রদের নৈতিক জয় ইতোমধ্যে অর্জিত হয়ে গেছে। এখন প্রয়োজন তাকে সংহত করা। এই আন্দোলন থেকে যদি সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজমান সমস্যাসমূহের স্থায়ী সমাধানের একটা বিহিত হয়, সেটা হবে অনেক বড় একটা অর্জন। সুতরাং সংশ্লিষ্ট সকলের বরাবরে আমার আরজ:

ক. শিক্ষার্থীদের ওপর দায়ের মামলা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিন;

খ. বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা প্রত্যাহার করে হলগুলো খুলে দেওয়া প্রয়োজন;

গ. অনশন-সহ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সকল কর্মসূচি এক সপ্তাহের জন্য স্থগিত করতে হবে;

ঘ. সাস্টের ৫ জন প্রাক্তন শিক্ষার্থী, ৫ জন শিক্ষক এবং ৫ জন বর্তমান শিক্ষার্থী নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা প্রয়োজন, যে কমিটি সাস্টের সকল সমস্যা চিহ্নিত করবে এবং সমাধানের পথ নির্দেশ করবে;

ঙ. সাম্প্রতিক সমস্যার কারণ অনুসন্ধান এবং দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসার জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতা-সম্পন্ন কমিটি গঠন করতে হবে, এবং এই কমিটি সাত দিনের মধ্যে একটি রিপোর্ট উপস্থাপন করবে।

চ. দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং সেগুলো সমাধানের জন্য আইন প্রণেতা, শিক্ষাবিদ এবং অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষদের সমন্বয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতা-সম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠন করা প্রয়োজন;

ছ. আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদেরকে কোনভাবেই হয়রানি করা যাবে না;

জ. আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা ব্যয়ভার বহন করতে হবে।

সৈয়দ মনির হেলাল: আইনজীবী ও সাংস্কৃতিক সংগঠক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত