ইয়াকুব শাহরিয়ার, শান্তিগঞ্জ

০৫ মার্চ, ২০২২ ১২:৩৪

মকরম শাহ’র বাউল আসরে বসেছিলো আনন্দ মেলা

সারাদিনের ব্যস্ততাকে পাঁশ কাটিয়ে একটু আনন্দঘন অবসর সময়কেই খুঁজে বেড়াচ্ছিল উচাটন মন। ‘আনন্দকে কোথায় খুঁজি, এমন সুদিন ভাগলো বুঝি’ অবস্থায় যখন পড়ি পড়ি ভাব তখন খুবই ঘনিষ্ঠ আত্মীয় একজনের ফোনকল। তাদের বাড়িতে যেতে হবে, বাৎসরিক ওরস। ওরস বলতে বাউল গানের আনন্দ মেলা। প্রাণে সঞ্জীবনী শক্তি ফিরিয়ে দেবার এক প্রাচীন আয়োজন। আনন্দ বিতরণের এক মাহেন্দ্রক্ষণের পশরা সাজানো হয়েছে। যেতে হবে। খুব সরল অথচ যেতে বাধ্য হওয়া ‘ইনভাইটে’ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। ১৮ ফাল্গুন (৩ মার্চ) বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত যাবো। গেলামও।

যাত্রা সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার লক্ষ্মীশ্রী ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামে। বাউল, সাধক, লোককবি, অসংখ্য মরমি গানের রচয়িতা, আসা যাওয়া বারণ হইলো না গানগ্রন্থের স্রষ্টা মকরম শাহের বাড়িতে। স্কুল বন্ধু মুবিন সিদ্দিকী আমার সহযাত্রী। রাত দশটা। শীত ঝেঁকে বসেছে খুব। মুবিনকে গিয়ে আনতে হলো পাগলা বাজারের উত্তর মাথা মহাসিং নদীর পাড় থেকে। তখন রাত ১০টা বেজে ২০ মিনিট। এর টিক ৯মিনিট পর মোটরসাইকেল যোগে আমাদের যাত্রা। ড্রাইভিং সিটে আমি। খুব ধীরে ধীরে কুয়াশা আর পড়ন্ত শীতকে ঠেলে ঠেলে সদরের বাহাদুর পুরের দিকে এগুচ্ছিলাম। পাগলা বাজার থেকে আসরে পৌঁছতে ২৫ মিনিট সময় লাগলো আমাদের। বাহাদুর পুর গ্রামের প্রধান রাস্তায় পৌঁছোবার আগেই আমার কানে মরমি সুর ভেসে আসলো। প্রার্থনা গান-

‘হে পরোয়ার তুমি দয়ার ভাণ্ডার দয়া করো তুমি আমার...’

আমরা পৌঁছলাম। তার আগেই একটা বিপত্তি ঘটলো। রাস্তার বেহাল দশা টাহর করতে পারিনি। বেতালা খারাপ রাস্তা। ভাঙা তো ভাঙাই কোনো কোনো জায়গায় মাটিও নেই। মোটরসাইকেলটি আমাদের নিয়েই পড়ে গেলো। তবে, আমরা পড়লাম না। শঠাম দেহের বন্ধু মুবিন টেনে ধরলো। যাক। এসব বিপত্তিকে বাঁধা না ভেবেই আমরা গিয়ে পৌঁছলাম মূল মজমায়। জমজমাট আসর। দারুণ ভাবে সুসজ্জিত। সুশৃঙ্খল। যে গানের কথা আগে বলেছিলাম- সে গানটি গাইছিলেন মকরম শাহ’র সুযোগ্য উত্তরসূরি বাউল শাহজাহান সিরাজ। তারপর জোড়াগান গাইলেন। আরেকটি গান। গানটি  যখন গাইছিলেন তখন খুব ভাবে খেয়াল করলাম আনন্দ আসলে কী! মরমের আনন্দ। শরীরের আনন্দ। কত চুপচাপ বসে থেকে তারা গানগুলো শুধু শুনছেলিনই না মন দিয়ে উপলব্ধিও করছিলেন। হাজার খানেক দর্শক স্রোতা না হলেও তার কাছাকাছি হবে নিশ্চিত। গানটি আমরাও উপভোগ করলাম। কী এক অদ্ভুত ঘোর আমাদের মাঝে কাজ করতে লাগলো। গান শেষে দর্শক স্রোতা ‘উলি’ দিয়ে উঠলেন। আরেকটা.... আরেকটা....। দর্শকদের অনুরোধে তিনি আরেকটি গানে টান দিলেন। নবীর শানে গান। এবার তিনি গাইলেন-

আমার নবী তোমার নবী সাইয়িদি না মাওলানা...

গান শেষ হলো। মরমের উপরে গানের যে দখল সেটা গেলো না। একে একে আরও শিল্পীরা এলেন গাইলেন। গানগুলো মানুষকে আনন্দ দিয়েই চললো। আমরা একপাশে দাঁড়িয়ে গান শুনছিলাম। তখনই দেখা হলো নূর আলম ভাইয়ের সাথে। তিনি মকরম শাহের ভাতিজা। অনুষ্ঠান নিয়ে তার ব্যস্ততা প্রচুর। আমাদেরকে চেয়ারে বসানোর জন্য তার ব্যস্ততা আরও বেড়ে গেলো। পরক্ষণেই দেখা মকরম শাহের নাতি, বাউল শাহজাহান সিরাজের ছেলে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করা মেধাবী শিক্ষার্থী শাহ সুলতান রাসেল। আতিথিয়েতা আরও বেড়ে গেলো। আমরা তাদের ঘরে গেলাম। তোবারক খেলাম। তোবারক মানে ওরস উপলক্ষে রান্না করা খাবার। আমাদেরকে একটু বিশেষভাবে খাওয়ানো হলো। তারপর আবার গান শুনতে গেলাম। ঘুরে ঘুরে দেখলাম পুরো আয়োজন।

গান শুনছিলাম একজন মহিলা শিল্পীর। ভালো গাওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা ছিল মহিলাটির। আমার চোখ তখন আটকে গেলো অন্য এক জায়গায়। স্টেজে থাকা ব্যানারে। মকরাম শাহের বড় ছবি সম্বলিত ব্যানারটি সৌজন্য করেছেন সুনামগঞ্জ জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। বিষয়টি এই প্রথম দেখলাম। এর আগে মাদকদ্রব্যের সৌজন্য ব্যানার কোনো গানের আসরে আমি দেখিনি। মুবিন অবশ্য অন্য একটি কারণে গানের এ আসরটিকে অন্য উচ্চতায় রাখতে চাইছিল। সে দেখল কোনো বিশৃঙ্খলা নেই পুরো আয়োজনে। কেউ অশ্লীল কোনো লাফালাফিও করছেন না। মাটিতে, ঘাসের উপর বসে গান শুনছেন, আনন্দ করছে। দোকানপাট কিছু বসেছে। চায়ের দোকান, গোল্লা, পেঁয়াজু আর চানাচুরের দোকান।

আরেকটা বিষয় দেখে অত্যন্ত ভালো লাগলো বাহাদুরপুরে। মহিলা দর্শক ছিল দুই শতাধিক। টানা তিনচারটে লম্বা ঘরের ‘দাইরো’ বসে ছোট, মধ্যম, যুবক-বৃদ্ধ বয়সী মহিলারা গান শুনছিলেন। ভালো লাগার মতো পরিবেশ। ভালো লাগলোও।

মুবিনকে নিয়ে ঢুকলাম মকরম শাহ থাকার ঘরে। মাটির ঘরে তিনি থাকেন। মাথার দিকটায় কয়েকটা পাথর। তিনি বসে আছেন। কয়েকজন জ্যেষ্ঠ লোক তাঁর চারপাশে। সালাম দিলাম। মুবিন কৌতূহল বশত জিজ্ঞেস করলো বয়স কত হবে? পাশের জন উত্তর দিলেন  ১০৭! মুবিন অবাক হলেও আমি অবাক হলাম না। যখন মকরম শাহ’র বয়স ১০৬ তখন আমি দু’তিনবার তাঁর বাড়িতে এসেছি। তিনি ভাবুক। জ্ঞানী। তাঁর জ্ঞান সম্পর্কে আরেকদিন বলবো। তিনি আমাকে আশীষ দিলেন। বসতে বললেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। দোয়া করলেন ভালো থাকার। তাঁর নাতনীর (আমার স্ত্রী) কথা জিজ্ঞেস করলেন। বললেন- ‘সাংবাদিক, নাতিনরে লইয়া আইও আরেক দিন। আগামীবার পাইতায় না আমারে।’ ভিতরটা মোচর দিয়ে উঠলো। বললাম যাবো।

ঘড়ির কাটা ১টার উপরে। ঠাণ্ডাও প্রচুর পড়েছে। এবার আসতে হবে। শেষ রাত্রি পর্যন্ত অপেক্ষা করা কষ্টকর হবে। তাই রওনা দেওয়ার পালা। এতো ব্যস্ততার পরও পরিবারের সবাই আমাদের ছাড়তে চান না। ছোট বোন একটা হেলমেট দেবেই না। শেষ করে আসতে হবে। বুঝিয়ে সুজিয়ে রওয়ানা দিলাম। মকরম শাহ’র ছেলে শাহজাহান সিরাজ অনেক মায়া দেখালেন। বললেন, ভাগনা ভালো করে লিখবে কিন্তু। আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।

তাকে প্রশ্ন করেছিলাম- কত বছর ধরে এ আসর হয়। বললেন আমার দাদার সময় থেকে। ১১০ তম আসর এটি। বাবা আজো আসরে বসেন।

গাড়িতে যখন উঠবো তখনই আবার পড়ে যাওয়ার শঙ্কা হলো ভাঙা রাস্তায়। এ রাস্তাটি মকরম শাহের সম্মানে হলেও সংস্কার হওয়া জরুরি। জীবদ্দশায় তিনি যদি দেখে যেতে পারেন তার সম্মানে রাস্তাটি কাজ হচ্ছে মরেও শান্তি পাবেন। আর জীবিত মকরম শাহকে সম্মান রাস্তাটি সংস্কার করে তাঁর নামে করে দিলে আমাদের সমাজের তো কোনো ক্ষতি হবে না? বরং জীবিত একজন চিন্তক, সাধক-বাউল, লেখককে সম্মান দেওয়ার চর্চা শুরু হলো আমাদের জেলায়। প্রস্তাবটি ভেবে দেখবেন। সংস্কৃতির সুষ্ঠু চর্চা অব্যাহত থাকুক। গ্রামীণ ঐতিহ্যও বাঁচুক সগৌরবে। আনন্দ আসুক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত