আব্দুল্লাহ আল সাফি

০৮ জুলাই, ২০১৬ ১৪:৫৬

'সিক্স আপ আর টেন ডাউন' সমস্যায় গণমাধ্যম

সাবেক বিনোদন জগতের তারকা 'মখলেস' বর্তমানে একটি অনলাইন 'খোরাকি.কম' পত্রিকার সম্পাদক। কুটির শিল্প টাইপ একটি 'সুখী পরিবার' টাইপ পরিবেশে তার পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হয়। যে নিউজই হয় তাতে বিনোদনের একটা ছোঁয়া রয়েই যায়, তা বিষয়ে বিনোদন নয়তো পরিবেশনায় বিনোদন। বিনোদনই বিনোদন।

অ্যালেক্সা র‌্যাঙ্কিং আর ভুয়া নিউজ শিকারিদের সঙ্গে পাল্লা দিতে তার পত্রিকায় 'গুজব ওয়াচ' নামে একটি সেকশন চালু করলেন। এই ওয়াচ বডি আসলে তার পত্রিকার নীতি নির্ধারক। কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের মতামত লাগে, ক্রাইসিস পিরিয়ডে তাদের কথাই আইন।

গুলশান হামলার পরে তার পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতি 'মৃদু চাপ' অনুভব করা শুরু করলো। লাইক/শেয়ার/কমেন্টের সঙ্গে 'আপলোড' হুমকির মুখে থাকায়, মখলেস সাহেব সবসময় 'মৃদু নিম্নচাপ' ম্যানিয়ার মধ্যে থাকেন। টয়লেটের টিস্যু পেপারের মাসিক খরচ বেড়ে যাওয়ার মুখে চিন্তিত 'গুজব ওয়াচ' কমিটি।

২.
মখলেস সাহেবের দ্বিতীয় পক্ষের ঘরের প্রথম ছেলে সন্তান গ্রাম থেকে শহরে এসেছে মায়ের সঙ্গে। একসঙ্গে 'দুই দিক' সামাল দেওয়া সফল পুরুষ মখলেস। ঐক্য আর ঐক্য.. নেই কোনো আন্দোলন, ধর্মঘট, মানববন্ধন... চারিদিকে শুধুই 'স্ত্রী-বন্ধন'। গ্রাম থেকে অপরপক্ষ আসলে তাদের একটু অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন মখলেস সাহেব। গণতন্ত্র রক্ষায় ও ম্যানেজে তিনি দারুণ পারদর্শী।

শুক্রবার সকালে অফিসে আসার সময় আবদার করায় অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলের হাত ধরে অফিসে ঢুকলেন তিনি। এসেই এক 'নিম্নচাপ' পরিস্থিতির মুখে। 'গুজব ওয়াচ' কমিটির সবচেয়ে জুনিয়র সদস্য, যে কিনা 'খোরাকি.কম' এর সাপ্লাই-চেইন ম্যানেজের দায়িত্বে তার কাছে ছেলেকে দিয়ে পরিস্থিতি সামালে ব্যস্ত হয়ে পরলেন। সম্পাদকের বালকপুত্রের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত কমিটি সদস্য, বসের ছেলে বলে কথা।

অফিসের বসদের সন্তানদের একটা বিরাট ভূমিকা থাকে 'ম্যানেজমেন্টে', তারা ইংল্যান্ড-আমেরিকায় থেকেও অনেক কিছু ম্যানেজ করতে পারেন। আর ওইসব সন্তানদের সঙ্গে যদি ছেলেবেলার কোনো স্মৃতি থাকে, তাহলেতো কথাই নেই! ভবিষ্যতে রেফারেন্স হিসেবে কাজে লাগে... "ওই যে বাবা, আমি ছোটবেলায় তোমাকে ম্যাঙ্গো-ক্যান্ডি কিনে দিয়েছিলাম", "আরে বাবা তোমার মনে নেই, তুমি ছোটবেলায় আমার গায়ে হিসু করে দিয়েছিলে.. হে হে হে"... এই টাইপ রেফারেন্স সফলতার অনেক কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে যে কাউকে।

ওইসব মাথায় রেখে মখলেসপুত্রের সেবার নিয়োজিত হলেন কমিটি মেম্বর মজিদ। মখলেসপুত্রের চটুল আর আগ্রাসি আচরণ দেখে বুঝেই নিলেই, মখলেসের প্রথম পক্ষ আর দ্বিতীয়পক্ষ মিলিয়ে ৩ সন্তানের মধ্যে এই ছেলেই একদিন হবেন এই 'খোরাকি.কম' এর ভবিষ্যৎ কর্ণধার। সেজন্য একটু বেশী খাতির করতে লাগলেন। চিপসের প্যাকেট আর সেভেন আপ হাতে পেয়ে মখলেসপুত্রের প্রশ্ন, "চাচা, এইটার নাম সেভেন আপ কেনো?"। উল্টাপাল্টা একটা উত্তর দিতে যাবেন, এমনসময় সম্পাদকের রুমে ডাক পড়লো মজিদ সাহেবের। ওনার অবর্তমানে কোনো সিদ্ধান্তই নেন না মখলেস সাহেব।

নিজের ফেসবুকটা লগআউট করে মখলেসপুত্রকে তার কম্পিউটারে 'ক্যান্ডি পটাশ' গেমস ধরিয়ে দিয়ে উঠে গেলেন বোর্ডরুমের দিকে। মজিদ ছাড়া সবাই বসে আছেন, খুব মনোযোগ সহকারে মখলেস সাহেবের সামনে একটি নির্দেশনামূলক চিঠি। বিষয়টি এখানেও উল্লেখ করা যাচ্ছে না, 'খুবই স্পর্শকাতর'... আইফোনও এতো স্পর্শকাতর স্ক্রিন বানাতে পারেনি এখনও। যাইহোক মজিদের একটি চমৎকার পরামর্শে মাত্র ১০ মিনিটের মাথায় মিটিং শেষ, খুবই সন্তোষ প্রকাশ করে মখলেস তার রুমে চলে গেলেন। মজিদও ফিরে গেলেন বসপুত্রের খেদমতে, ভবিষ্যতের বিষয়ে মজিদ খুবই সচেতন।

সিটে ফিরে দেখেন, বসপুত্র তার কম্পিউটারের কীবোর্ডে 'সেভেন আপ' ঢেলে দিয়েছে। আইটি সেকশনের হেড তার টিম নিয়ে কী-বোর্ড পরিষ্কারে ব্যস্ত, সিচুয়েশন নিয়ন্ত্রণে ৪৮ ঘণ্টা সময় চাচ্ছে কনফিডেন্ট 'আইটি হেড'।

মজিদ হাসি মুখে তাদের বললেন, 'ব্যাপার না চেষ্টা করো, বসের ছেলের বলে কথা। এভাবে ভুল করতে করতেই সে একদিন পারফেক্টশনিষ্ট হয়ে উঠবে।"

বসপুত্রের মধ্যে নেই বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ, মজিদকে দেখেই আবার জিজ্ঞেস করলো, "চাচা, এইটার নাম সেভেন আপ কেনো?"

মজিদ বললো, "বাবা, এটা খেলে ৭ বার ঢেকুর উঠে। সেজন্য এটার নাম সেভেন আপ।" বসপুত্র উত্তর পেয়ে খুশী মনে স্ট্যাপলারের পিন পাঞ্চ করতে থাকলো একটি কাগজে। আর কম্পিউটার না থাকায় নিজের ফোনে 'খোরাকি.কম' এর হোম পেইজ দেখতে থাকলেন মজিদ।

৩.
ঈদকে সামনে রেখে মখলেস সাহেব নানা হিসেব নিকেশ নিয়ে ব্যস্ত। ঈদ স্পেশাল আইটেমসহ কোন কোন খাত থেকে খোরাকি সামাল দিতে আমদানি হবে, তা নিয়ে চিন্তিত চৌকশ ওই সম্পাদক। কড়া প্রশাসনিক দক্ষতা দেখাতে 'গুজব ওয়াচের' পরামর্শে স্টাফদের বেহুদাই বকাবকি করেছেন সকালে। 'গুজব ওয়াচের' অনেক বিষয়-পরামর্শ তার কাছে বিরক্তিকর মনে হলেও তার কার্যকারিতায় খুশী মখলেস সাহেব।

রুমের কাঁচের দেয়াল দিয়ে চোখ তুলতেই চোখে পড়লো, 'গুজব ওয়াচ' কমিটি সদস্য মজিদ তার ছেলেকে যত্ন করছে, সময় দিচ্ছে। দেখে ভাল লাগলো মখলেসের, মনে মনে ভাবলেন... "এজন্যই খোরাকি.কম সদস্যদের তিনি পরিবার বলে থাকেন"

এমন সময় একই সাথে পলিটিক্যাল-বিনোদন বিটের তরুণ রিপোর্টার সম্পাদকের রুমে ঢুকলেন। "বস, একটু পরামর্শ ছিলো, একটা নিউজ নিয়ে", তরুণ রিপোর্টারে প্রশ্ন।

মজিদসহ 'গুজব ওয়াচ' কমিটির দুজন ওই রিপোর্টারে পেছন পেছন ঢুকে গেছে রুমে। তাদের একজনের দিকে চোখে চোখ রাখলেন মখলেস। উনারা থাকতে রিপোর্টার কেনো সম্পাদকের রুমে সরাসরি ঢুকে পড়ে, এই ইঙ্গিত পেয়ে 'গুজব ওয়াচ' কমিটির একজন বললো, "কী পরামর্শ আর কোন নিউজ?"

রিপোর্টার বললো, "কক্সবাজার থেকে ঢাকা ফেরার পথে সাবেক নায়িকা ময়ূরীর স্বামী ইয়াবাসহ আটক হয়েছে। ময়ূরীর স্বামী টাঙ্গাইলের এক থানার একটি ইউনিয়নের বিএনপি নেতা। এই নিউজ কি যাবে?"

ময়ূরীর নাম শুনে একটু নড়েচড়ে বসলেন সম্পাদক মখলেস। রিপোর্টার বললো, "বস! একেতো কক্সবাজার তার উপর বিএনপি নেতা, কোনো সমস্যা হবে নাতো? বদি সাহেবের রেফারেন্স যদি চলে আসে। তাছাড়া বিএনপি আবার যদি বলে, ষড়যন্ত্র করে তাদের নেতাকে আটক করা হয়েছে। আওয়ামী-বিএনপি দু'দলই খেপবে।"

মখলেস সাহেব আরেকটু নড়েচড়ে বসলেন। 'গুজব ওয়াচ' কমিটির সবচেয়ে বয়স্ক সদস্য বললেন, "ছেলের কথায় দম আছে। কিন্তু এ নিউজ মিস করাও উচিত হবে না। ময়ূরীর বিশাল ভক্তকুল আছে। তাছাড়া অ্যালেক্সার এই কঠিন সময়ে এধরণের আইটেম আমাদের বেশী বেশী দরকার।"

রিপোর্টার একটু সাহস পেয়ে বললো, " তা বস, কোন ক্যাটাগরিতে দেবো নিউজটা? বিনোদন? ক্রাইম? নাকি রাজনীতি?"

আবার একটা প্যাঁচ অনুভব করলেন মখলেস, কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব নিয়ে অপেক্ষা করলেন কীভাবে 'গুজব ওয়াচ' কমিটি বিষয়টি হ্যান্ডেল করে।

এবার চৌকশ মজিদ মুখ খুললেন, "মখলেস ভাই, যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি একটা ওয়ে আউট প্ল্যান করতে পারি"।

হাফ ছেড়ে মখলেস বললো, "অবশ্যই মজিদ! বলো কী করা যেতে পারে?"

মজিদ বললো, "এটা অবশ্যই বিনোদন ক্যাটাগরিতে দিতে হবে। ময়ূরীর একটা বৃষ্টি ভেজা ছবি ও কিছু ইয়াবার ছবি দিয়ে নিউজটি করতে হবে। হেডলাইন হতে পারে 'ময়ূরীর পরিবারে এ কীসের আলামত!!!!', একটা ষড়যন্ত্রের গন্ধ ঢুকিয়ে দিতে হবে। হেডলাইন দেখে মনে হবে কোনো পরকীয়া ও মাদকের গল্প। দেশের পাবলিক নিজেদের অধিকার হারিয়ে এখন ষড়যন্ত্রতন্ত্র নিয়ে বেশী ব্যস্ত। কিছু হলেই একেকজন কাজকর্ম ছেড়ে ফেসবুক গরম করে ফেলে। এটা অবশ্য আমাদের জন্য ভাল। তো যা বলছিলাম, ওই নিউজের প্রথম ৩ প্যারাতে ময়ূরীর অতীত জীবন নিয়ে লেখা থাকবে। আর শেষের প্যারায় দেড় লাইনে লেখা থাকবে ইয়াবাসহ তার স্বামীর ঘটনা, তবে এখানে 'মাদক' বলতে হবে ইয়াবা না। এছাড়া তার স্বামীকে বলতে হবে 'একটি রাজনৈতিক' দলের নেতা। সবদিক সামাল দেওয়া হবে।"

মখলেস সাহেব একটু রিল্যাক্সভাবে বসলেন।

৪.
মখলেস পুত্র বাইরে থেকে বাবার রুমের দিকে খেয়াল করছিলো। দেখলো, মজিদ হাত নেড়ে নেড়ে তার বাবাকে কী যেনো বোঝাচ্ছে। ছেলেটি মনে করলো, তার সেভেন আপ ফেলার ঘটনা হয়তো মজিদ চাচা তার বাবাকে নালিশ করছে। মজিদের কেবিন থেকে ছেলেটা বাবার রুমে প্রবেশ করেই বললো, "বাবা, মজিদ আঙ্কল অনেক ভাল। কিন্তু তার সেভেন আপটা মনে হয় ভেজাল।" নিজের কৃতকর্ম সামল দিতেই বাবার কাছে এই নালিশ।

মখলেস একটু সতর্ক হলো, কনফিডেন্টের সঙ্গে মজিদ জিজ্ঞেস করলো, "কেনো তোমার কাছে ভেজাল মনে হলো?"

ছেলেটি উত্তর দিলো, "আপনি না বললেন, ৭টি ঢেকুর ওঠে বলে 'সেভেন আপ', কিন্তু আমারতো 'সিক্স আপ আর টেন ডাউন' হলো।"

মখলেস বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করলেন, মজিদ ততক্ষণে বিষয়টি বুঝে সমাধানের জন্য বললো, "বাবু, তুমি সকালে মনে হয় একটু উল্টাপাল্টা কিছু খেয়েছো, সেজন্যই এই 'ডাউন' ইনসিডেন্ট হয়েছে। তাছাড়া সেভেন আপই হয় সাধারণত। আর যেহেতু সিক্স আপ হয়েছে তারমানে এটা মোটেই খারাপ না।"

মখলেসপুত্র ও মখলেস দু'জনই মজিদের কথায় কনভিন্সড। মখলেসপুত্রের বুদ্ধিমত্তা আর ব্লেইম দেওয়ার দক্ষতায় আবারও তাকে ভবিষ্যৎ 'খোরাকি.কম' কর্ণধার মেনে মজিদ হজম করে গেলো ওই মৃদু ফাউল।

'কিছু উপরের চাপ আর কিছু নীচের চাপ' সামাল দেওয়ার মতো এমন বুদ্ধিমান সদস্য পেয়ে মখলেস সাহেব নিশ্চিন্তবোধ করতে লাগলেন। পরিবার-প্রতিষ্ঠান সামলে আর 'খুবই স্পর্শকাতর' চাপ মেনে সুখে শান্তিতে চলতে থাকলো মখলেস সাহেবের 'খোরাকি.কম'।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত