মো. মাহমুদ হাসান

১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ২২:২১

ঈদ উৎসব হোক মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানিয়ে

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ সকল তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী ২০১৬ এর ‘ঈদ উৎসব’ (ঈদুল আযহা বা কোরবানির ঈদ) ব্যতিক্রমীভাবে পালন করুন- “সকল প্রকৃত ও দুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সম্মান জানিয়ে”। যেমন, ঢাকা শহরের ওয়াসার খালগুলোর পাশের বস্তিগুলোতে রয়েছে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা। তেমনি রয়েছে গ্রামের আশ্রয়ণ বা গুচ্ছ গ্রাম প্রকল্পে অনেক মুক্তিযোদ্ধা। তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীরা এবারের ঈদের সময়ে খুঁজে বের করুন ঐসব প্রকৃত ও দুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদেরকে। ঈদ উপলক্ষে স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে, প্রেমিক প্রেমিকাকে, প্রেমিকা প্রেমিককে, বন্ধু বান্ধবীকে, বান্ধবী বন্ধুকে উপহার দিতেন যে টাকা খরচ করে,- “দুই জনের টাকা একত্র করে কিনে দিন একজন দুস্থ মুক্তিযোদ্ধাকে আপনাদের দু’জনের সামর্থ্যরে মধ্যে কোন একটা উপহার।”

তবে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ি সন্তান বা ছোট ভাই-বোনদের উপহার হতে বঞ্চিত করবেন না। আজকের শিশুই আগামীর ভবিষ্যৎ। ঈদ উৎসবে দুটি মনের প্রেমের বা ভালবাসার গল্পের পরিবর্তে শুনুন না বাঙালির চেতনার জাগরণের দ্রোহের বহিঃপ্রকাশের গল্প, মুক্তিযুদ্ধে ঐ মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বের কাহিনী। ঈদ উৎসবে তরুণরা কয়েক বন্ধু মিলেও অনেক আড্ডা হয়, টাকাও খরচ হয় বেশ। তারাও এবারের ঈদের আড্ডাটা একটু ব্যতিক্রমী করুন কোন অসহায়, দুস্থ ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সাথে।

“সেলফি” সাম্প্রতিক সময়ের এক অপ্রতিরোধ্য নেশা। এ নেশাটাকে একটা ইতিহাসের অংশ হিসেবে ব্যবহার করার কথা ভাবতে পারেন। আর ২০/২৫ বছর পর বাংলাদেশে হয়তোবা কোন মুক্তিযোদ্ধাই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই জীবিত থাকবেন না। সেদিন একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সাথে আপনার সেলফি ছবিটাই হয়ে যাবে ইতিহাসের অংশ।

আজ কুখ্যাত রাজাকারদের ছবি, অডিও, ভিডিও রাস্তাঘাটে, অলি গলিতে, যানবাহনে অবাধে বিচরণ করে। যাদের ত্যাগ, আত্মাহুতি, জীবন বাজি রেখে লড়াই করে এই দেশটি প্রাপ্তি তাদের ছবি, অডিও, ভিডিও কোথাও কি আছে? থাকলে কতইবা? আজ হতে ৫০ বছর পর আপনি আপনার উত্তরসূরিকে গর্ব করে বলতে পারবেন - আমার সাথে একজন মুক্তিযোদ্ধার দেখা হয়েছিলো, ওনার সাথে আমার একটা ছবিও তোলা ছিলো । নেন না সে সুযোগটা। আমরা জীবনে অনেক কিছুই তো জীবনে প্রথমবার করি। তো সে উদ্যোগটা আপনিই শুরু করুন, দেখুন আপনাকে অনুসরণ করবে আরো অনেকেই।

বাঙালি জাতির বড় দুর্ভাগ্য এটি যে, মুক্তিযোদ্ধাদের গুচ্ছগ্রামে ও গ্রামের আশ্রয়ণ প্রকল্পে স্থান করে দিয়ে অনেক শাসক বাহবা নেয়ার চেষ্টা করেছেন। যদিও জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সেই জাতীয় লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করে যাচ্ছেন কিছু “বীর নিবাস” তৈরি করে দিয়ে। তরুণ-তরুণীরা কোন “বীর নিবাস নামফলক” এর সাথে ঐ মুক্তিযোদ্ধা ও তার পরিবারের সদস্যদের সাথে দাঁড়িয়ে একটা সেলফি বা ছবি তুলে রাখার কথাও ভাবতে পারেন।

আপনি গল্প লিখতে পারেন না, দরকার নেই, একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তার বীরত্বের কাহিনী যা যা বলেন, তাই আপনি হুবহু লিখে ফেলুন বা ভয়েস রেকর্ড করুন। তাই দিয়ে দিন না সহজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। আপনি প্রবন্ধ লিখছেন না যে, আপনার কয়েকশ রেফারেন্স বই লাগবে, বা অনেক সময় লাগবে। একজন মুক্তিযোদ্ধার মুখের কথাই শুধু লিখুন। আমরা কত কিছুই না ফেসবুকে দিয়ে নিন্দিত হই। আপনারা তরুণরা তুলে আনুন না এই ঈদে কোন মুক্তিযোদ্ধাকে, তার বীরত্বের কাহিনীকে। দেখুন, আপনি নন্দিতই হবেন। টেলিভিশনে নাকি একটা নাটক প্রচারিত হয়েছিল- এক যুবক শুনেছে তার মা তাকে গর্ভে নিয়ে অনেক রাস্তা হেটে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিল। সে হেটে ঐ জায়গাটা অতিক্রম করেছিল, মায়ের কষ্টটা উপলব্ধি করতে। সেই নাটক নাকি অনেক জনপ্রিয় হয়েছিলো। আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে গল্প করলে এমন অসাধারণ কোন গল্প পেয়ে যেতে পারেন। (আমি দুঃখিত, আমি সেই নাটকটা দেখিনি বা তার নামও জানি না)।

সব ষড়যন্ত্র, জল্পনা-কল্পনার জাল ছিন্ন করে সদ্য ফাঁসিতে ঝুলে যাওয়া জামায়াত-শিবির ও জঙ্গিদের মূল অর্থের যোগানদাতা মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর আরো শাণিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনেক তরুণ -তরুণীর। ১৭ বিদেশী উন্নয়ন সহযোগী বন্ধুর বাংলাদেশের মাটিতে খুন হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের সাহসী চ্যালেঞ্জ নিয়ে জঙ্গি নির্মূলের সাফল্যকেও তরুণরা স্বাগত জানিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছেন বলেই।

২০১৬ সালটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সাফল্যের পাল্লা ভারি। ২০১৬ সালটিকে আপনাদের জীবনে আরো স্মরণীয় করে রাখতে একজন মুক্তিযোদ্ধার দেশকে ভালবাসার মাত্রার গভীরতা উপলব্ধি করুন, শুনুন তাঁর জীবনের বীরত্বগাঁথা, শুনুন তাঁর জীবনের বঞ্চনার করুণ কাহিনী। দু’জন বা কয়েকজন মিলে তাকে স্যালুট করুন, যেসব মুক্তিযোদ্ধাদেরকে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করে নিজ নিজ ভিটামাটি হতে উচ্ছেদ করে রাষ্ট্রযন্ত্র ও অশুভ শক্তিগুলো ঢাকা সহ বিভিন্ন শহরের বস্তিতে বা বিভিন্ন গ্রামের গুচ্ছগ্রামে বা আশ্রয়ণ প্রকল্পে স্থান করে দিয়ে বাহবা নেয়ার চেষ্টা করেছে।

তরুণরা নতুন নতুন সৃষ্টিতে ও সৃষ্টির কৌশল উদ্ভাবনে আমাদের প্রবীণদের চেয়েও পারঙ্গম-এ বিশ্বাস রেখে তরুণদের শুধুই একটু মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়াসে এই লেখা।
যদি তরুণদের মনে কিছুটা হলেও দাগ কাটে ! ১০ জন মুক্তিযোদ্ধাও যদি বাংলাদেশের তরুণ-যুবকদের বিশেষ আনন্দের এই দিনে সম্মানিত হন, তা হলে ১৯৮২-৯০ এর সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ও ১৯৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের একজন কর্মী হিসাবে নিজের মনে কিছুটা হলেও শান্তি পাব।

আর এ ধরনের দু’চারটি ঘটনা সমগ্র জাতি ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে একটি প্রশ্নের সম্মুখীন করবে, গত ৩৯ বছরে কতজন রাজাকারকে রাষ্ট্রযন্ত্র অবৈধভাবে পুরস্কৃত করেছে, আর কতজন মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত করা হয়েছে। ওয়াসার খালের পাশে কতজন মুক্তিযোদ্ধাকে থাকতে দিয়ে অসম্মান করেছে, আর কতজন নরপশু রাজাকারকে আইনকানুন ফাকি দিয়ে এক নরপশুর ৪/৫ এমনকি ৮/১০ টি নাম দিয়ে ৪/৫ এমনকি ৮/১০ টি প্লট দিয়েছে। এ ধরণের বহু অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে বাধ্য করবে আজকের তরুণরা। এ বিশ্বাস নিয়েই এ লেখা।

মো. মাহমুদ হাসান : ভূতপূর্ব কলেজ অধ্যক্ষ ও সমাজ গবেষণা কর্মী।

  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত