আল আমিন হোসেন মৃধা

২০ জুন, ২০১৭ ২২:৩২

প্রসঙ্গ: সুলতানা কামালের গ্রেপ্তার চেয়ে আইনি নোটিশ ও জাতির লজ্জা

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগ এনে মানবাধিকার কর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং নারী জাগরণের পুরোধা সুফিয়া কামালের মেয়ে সুলতানা কামালের বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের বিধান অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ ও গ্রেপ্তার চেয়ে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন হাইকোর্টের এক আইনজীবী।

সুপ্রিম কোর্টের ওই আইনজীবী তার নোটিশে উল্লেখ করেছেন, ‘সম্প্রতি ফেসবুক, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারি যে, সুলতানা কামাল দেশের একজন বিশিষ্ট নাগরিক ও মানবাধিকার কর্মী হওয়া সত্ত্বেও কিছু দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য ও মন্তব্য করে যাচ্ছেন। তার ওই বক্তব্য ইসলাম ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং দেশের কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের হৃদয়ে আঘাত হেনেছে। এ কারণে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী মুসলমান এবং দেশের সর্বোচ্চ আদালতের একজন আইনজীবী হিসেবে সংক্ষুব্ধ হয়ে তিনি এই আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন।'

নোটিশে বলা হয়েছে, এই লিগ্যাল নোটিশ পাওয়ার ৭ দিনের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতিতে ‘আঘাত’ এর ‘দায়ে’ দেশের বিশিষ্ট নাগরিক সুলতানা কামালের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে ফৌজদারি কার্যবিধি ও প্রচলিত আইনের বিধান অনুসারে আইনানুগ ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করার জন্য বাংলাদেশের কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানের পক্ষে অনুরোধ জানাচ্ছি। নোটিশ গ্রহীতারা এ বিষয়ে ব্যর্থ হলে আদালতে এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে মামলা দায়ের ও নির্দেশনা চাওয়া হবে।

বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল নিউজ টোয়েন্টিফোরে ‘জনতন্ত্র গণতন্ত্র’ নামে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য স্থানান্তর প্রসঙ্গে প্রচারিত টকশো-তে বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সুলতানা কামাল ও হেফাজতে ইসলামের প্রতিনিধি মুফতি সাখাওয়াত হোসেন এর মধ্যে আলোচনা হয়েছিল, যা পরবর্তীতে হেফাজতের দাবি মতে 'ইসলাম ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আনে'।

টকশো-তে আলোচনায় সুলতানা কামালের বক্তব্যের যে অংশ হেফাজতের দাবি মতে 'কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এনেছে' সে অংশ তুলে ধরা হলঃ

হেফাজত নেতা মুফতি সাখাওয়াত বলেন, "কেউ ভাস্কর্য বলেন, কেউ বলেন মূর্তি। আমি মূর্তি বলি। গ্রিক গড অব জাস্টিস। এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট, এই মূর্তিটি থেমিসের। প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, এটি থেমিসের মূর্তি। আর থেমিস হচ্ছে গ্রিক দেবী। তারা সেটিকে উপাসনা করে, পূজা করে। আর সেই মূর্তি স্থাপিত হয়েছে, এটা কখনও কোনও মুসলমান মেনে নিতে পারেন না। এখানে মূর্তি স্থাপনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কাজ করা হয়েছে।'
জবাবে সুলতানা কামাল বলেন, "আমার কথা হলো, সেটা যদি মূর্তিও হয়, সেটা সেখানে থাকলে অসুবিধা কী? মুসলমানরা সেটা পূজা না করলেই হলো।'
প্রত্যুত্তরে মুফতি সাখাওয়াত বলেন, "অসুবিধা আছে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত।"
সুলতানা কামাল বলেন, "তার মানে কি কিছুই থাকবে না?"
উত্তরে সাখাওয়াত বলেন, 'সব থাকবে।"
সুলতানা কামাল বলেন, "তাহলে মসজিদও থাকার কথা না।
এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় মুফতি সাখাওয়াত বলেন, "এই মূর্তি সাম্প্রদায়িক। আদালত প্রাঙ্গণের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কোনও সাম্প্রাদায়িক কিছু থাকতে পারে না।"
সুলতানা কামাল বলেন, "থাকতে পারে, ওখানে ঈদগাহ আছে কেন? সেখানে যদি মসজিদ থাকতে পারে, মূর্তি থাকতে পারবে না কেন?'

গত ২ জুন বায়তুল মোকারম মসজিদ থেকে জুমার নামাজ শেষে 'ভাস্কর্য থাকতে না দিলে মসজিদ থাকতে দেওয়া হবে না' সুলতানা কামালের বিরুদ্ধে টকশোতে এমন বক্তব্য দেবার অভিযোগ তুলে হেফাজতে ইসলামের হাজার খানেক নেতারা বিক্ষোভ করে সুলতানা কামালকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের আল্টিমেটাম দেন এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার অথবা তসলিমা নাসরিনের মতো দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবার দাবি তোলেন।

তারা বলেন, "সুলতানা কামালের দেশ বাংলাদেশ নয়। সুলতানা কামাল রাজপথে নেমে দেখুন, হাড্ডি-গোস্ত রাখা হবে না।"

অতীতেও এই মৌলবাদী গোষ্ঠী সুযোগ পেলেই দেশের প্রগতিশীল লেখক, শিল্পী, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবীদের ওপর আঘাত করেছে। কখনো প্রকাশ্যে, কখনো টেলিফোনে বা উড়োচিঠির মাধ্যমে তাঁদের হুমকি দিয়ে চলেছে, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে। মানবাধিকারকর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামালকে হেফাজতে ইসলাম যে হত্যার হুমকি দিয়েছে, তাঁকে দেশছাড়া করার হুংকার ছেড়েছে, সেটি খুব উদ্বেগের বিষয় নয়। উদ্বেগের বিষয় হলো, এ ব্যাপারে সরকারের নির্লিপ্ততা, ঔদাসীন্য ও স্ববিরোধী অবস্থান। সেই সাথে হাইকোর্টের একজন আইনজীবী হেফাজতের অসার দাবির সাথে একমত হয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগ এনে আইনি নোটিশ পাঠালেন।

মানবাধিকারের পক্ষে সোচ্চার সুলতানা কামাল বরাবরই ন্যায় ও প্রগতির পতাকা ঊর্ধ্বে ধরেছেন। যা সত্য মনে করেছেন, জোরালো ও স্পষ্ট ভাষায় তাই বলেছেন, এখনো বলছেন। ২০০৬ সালে ইয়াজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে যখন দেখলেন প্রধান উপদেষ্টার দলবাজির কারণে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করা যাচ্ছে না, তখন আরও তিন উপদেষ্টার সঙ্গে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সুন্দরবনকে যে ভয়াবহ ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তা সম্পর্কে মানুষকে সজাগ করেছেন। সুন্দরবন বিনাশী এই রামপাল কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরোধীতা করে আসছেন, তৈরি করছেন জনমত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধে মৌলবাদী শক্তি যখন সারাদেশে আস্ফালন চালাচ্ছিল, তখন আরও অনেককে সঙ্গে নিয়ে তিনি বাংলাদেশকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন।

আর মানবাধিকারের পক্ষে সোচ্চার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সুলতানা কামালকে এই মৌলবাদী শক্তি নিশানা করল, তাতে আমরা বিচলিত হইনি। অবাক হয়েছি সরকারের কঠোর ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থান দেখে। অবাক হয়েছি একজন আইনজীবীকেও না পেয়ে, যারা সুলতানা কামালকে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকিদাতা হেফাজত নেতার বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধি ও প্রচলিত আইনের বিধান অনুসারে আইনানুগ ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে আইনি নোটিশ পাঠাবে।

 

  • লেখক : রাজনৈতিক কর্মী
  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত