আলতামাস পাশা

২৪ জানুয়ারি, ২০১৮ ১৫:২৪

পরিবেশ ও মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্য রক্ষার আন্দোলন

ছবি: সংগ্রহ

১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়। গ্রামে গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচারও প্রবল হয়ে উঠে। দীর্ঘতর হয় যশোর রোডে শরণার্থীদের দেশত্যাগের লাইন। মার্কিন কবি অ্যালেন গিনসবার্গের কবিতা তখন বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থাকে স্পষ্ট করে তুলেছিল।

লক্ষ শিশু দেখছে আকাশ অন্ধকার
উদর স্ফীত,
বিস্ফোরিত চোখের ধার
যশোর রোড
বিষণ্ণ  সব বাঁশের ঘর
ধুঁকছে শুধু - কঠিন মাটি নিরুত্তর।
সীমান্তে আজ বানের পানি তা- থৈ -থৈ
সব ডুবেছে, খাদ্য দেবে পথটা কৈ?
মার্কিনি সব দেবতারা কোথায় আজ?
বিমান থেকে শিশুর গায়ে ছুঁড়ছে বাজ!
রাষ্ট্রপতি, কোথায় তোমার সৈন্য দল?
বিমানবহর নৌবাহিনী অর্থবল?
তারা কি আজ খাদ্য ওষুধ আনতে চায়?
ফেলছে বোমা ভিয়েতনামে নিঃসহায়

ইতিহাস বলে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই যশোর রোড দিয়েই লক্ষ লক্ষ শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। শরণার্থীদের সেই ঢল নিয়ে মার্কিন কবি গিনসবার্গের উপরের কবিতাটি রচিত হয়েছে। কবিতাটির শিরোনাম ছিল, ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। যুক্তরাষ্ট্রের গায়ক বব ডিলান সেই কবিতাকে গানে রূপ দিয়ে তা গেয়ে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তহবিল সংগ্রহের জন্য।

যশোর রোডে আজ একটি স্বাধীন দেশের নাগরিকরা প্রতিদিন চলাচল করেন। চলমান পথে শতবছরের পুরনো গাছগাছালি ফিসফিসিয়ে তাদের  কানে কানে বলে দেয় ‘৭১ এর সেই দিনগুলো কথা। যখন একশত বছরের এক বৃদ্ধাও তার হাতের ছড়িটি দিয়ে মেপে মেপে যশোর রোডের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছিলেন জীবনের আশায়।

মানুষ জানে মৃত্যু অবধারিত, তবুও সে বাঁচতে চায়। এই অপূর্ব সুন্দর পৃথিবী থেকে সে চলে যেতে চায় না। বিধাতার সকল সৃষ্টি সারা জীবনেও তো আমাদের দেখা হয়নি। হবেও না কোন দিন। কিন্তু যেটুকু আমরা দেখতে পাই সেটুকুও কি রক্ষা করবো না? করার চেষ্টাও করবো না?

সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি কতিপয় কার্যকলাপ পরিবেশ সচেতন মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। কারণ কালের সাক্ষী এই সড়কটি এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হতে চলেছে। আর তাই এই সড়কের যশোর থেকে বেনাপোল পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার চার লেনে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। নিঃসন্দেহে এই সিদ্ধান্ত একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত। যারা এধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পরিবেশ-প্রতিবেশ সম্পর্কে তাদের ধারণা খুবই কম তা বোঝা যাচ্ছে।

জানা যায়, যশোর শহরের দড়াটানা মোড় থেকে বেনাপোল স্থলবন্দর পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার সড়ক সম্প্রসারণের জন্য ২ হাজার ৩২ টি গাছ কাটান সিদ্ধান্ত হয়েছে। উল্লেখ্য, ব্রিটিশ শাসন আমলে যশোর শহরে একটি বিমান ঘাঁটির সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য যশোর রোড আধুনিকভাবে তৈরি করা হয়। সেসময়ও রাস্তার  দু‘পাশে অনেক গাছ লাগানো হয়েছিল। বর্তমানে যশোর রোড বলতে দমদম থেকে বনগাঁর পেট্রোপোল সীমান্ত পর্যন্ত মহাসড়ক বোঝায়।

সড়কের পাশে গাছ থাকলে সড়কের ক্ষয়রোধ করে। রাতে গাছে গাড়ির আলো প্রতিফলিত হয়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমে। শতবর্ষী এসব গাছগুলো মহীরুহ হিসেবে কাজ করে। যশোর রোডের উভয় পাশে রয়েছে রেইনট্রি, মেহগনি, বাবলা, খয়ের, করই, আকাশমণি, বট, শিশু, ঝাউ, আম, কাঁঠাল, সেগুন, শিমুল ও দেবদারু গাছ। এর মধ্যে একশত বছরের বেশি পুরোনো রেইনট্রি রয়েছে ৭৪৫ টি।  প্রতিটি বৃক্ষকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে উক্ত এলাকার জীব বৈচিত্র্য। এই জীব বৈচিত্র্য প্রভাবিত করছে এলাকার মাটি, গুল্মলতা, পোকামাকড় ও পাখির জীবনধারাকে। প্রভাবিত হচ্ছে নিকটস্থ শস্য ক্ষেতও। এসব গাছের কোটরে বাসা বেধে ডিম পাড়ে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। গাছের ভিতর, আশপাশের মাটিতে বিভিন্ন প্রজাতির পোকামাকড়ের আবাস বাস্তুতন্ত্রের একটি শৃঙ্খল গড়ে তুলেছে।

আজ পুঁজিতান্ত্রিক আগ্রাসনের শিকার হতে চলেছে এই বাস্তুতন্ত্র শৃঙ্খল।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, যশোরের জমিদার কালী পোদ্দার তার মাকে সোজা পথ দিয়ে গঙ্গাস্নানে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ৫৮ হাজার কড়ি ব্যয়ে ১৮৪২ সালে যশোর শহরের বকচর থেকে ভারতের নদীয়ার গঙ্গাঘাট পর্যন্ত সড়ক তৈরি করেছিলেন। প্রায় ৮০ কিলোমিটারের এই রাস্তার ছায়ার জন্য দুধারে  কালীবাবু বিদেশ থেকে এনে অতিবর্ধনশীল রেইনট্রির চারা রোপণ করেছিলেন। এই গাছগুলো এখনও ছায়া দেওয়ার পাশাপাশি অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভারত বিভাগের পরে যশোর থেকে কলকাতার মানিকতলা পর্যন্ত এই সড়কের নামকরণ করা হয় যশোর রোড। ভারতীয় অংশের গাছগুলোও বিশেষভাবে সংরক্ষণ করে যশোর রোডের সংস্কার সাধন করা হয়। সেখানে সব গাছ কেটে ফেলার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে তারা সরে এসেছিলেন পরিবেশের স্বার্থে যেমন তেমনি শত বছরের ঐতিহ্যকে ধরে রাখা জন্যেও।

যশোর রোডের এইসব গাছ এলাকার  তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন করে। বৃষ্টির সময় পানির প্রভাব নিয়ন্ত্রণে এসব শতবর্ষী গাছ নিয়ন্ত্রকের কাজ করে। বৃষ্টির ভয়াবহতা এসব গাছ নিয়ন্ত্রণ করে। ঝড়ের সময় প্রভাব বাতাস মোকাবিলা করে এসব গাছ  আর শীতের সময় শীতল বাতাস থেকে রক্ষা করে। সূর্যের তেজস্ক্রিয় রশ্মি থেকে গাছ আমাদের বাঁচায়। শতবর্ষী এসব গাছ রাস্তার পাশের ভূমি ক্ষয় থেকে মাটিকে রক্ষা করতে সহায়ক হয়। সোজা কথায় এসব রাস্তার ধারের গাছ আমাদের যেমন বিশুদ্ধ অক্সিজেন সরবরাহ করে তেমনি গ্রিন হাউস প্রভাব থেকেও রক্ষা করে। এমনকি শব্দরোধক হিসেবে কাজ করে শব্দ দূষণও রোধ করে। তাই সকল দিক বিবেচনায় যশোর রোডের হাজার হাজার শতবর্ষী গাছ কেটে সড়ক উন্নয়নের যে দিবা স্বপ্ন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দেখছে তা অবিলম্বে বন্ধ করতে সচেতন দেশবাসীর ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন।

আজ আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে দুটি কারণে, প্রথমত: এই যশোর রোডের সঙ্গে আমাদের রয়েছে আবেগের সম্পর্ক। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির সম্পর্ক। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যশোর রোড আর অ্যালেন গিনসবার্গের কবিতা থেকে পথ চলার প্রেরণা পাবে। তাদের পূর্ব-পুরুষরা যেভাবে স্বদেশ প্রেমে অনুপ্রাণিত হয়েছেন তাদেরও তেমনি অনুপ্রাণিত হতে হবে। আর এসব অনুপ্রেরণা আসতে পারে আমাদের অতীত ঐতিহ্য থেকে। প্রসঙ্গ উঠতে পারে হাজার হাজার গাছ মুক্তিযুদ্ধের এতো বছর পরেও কীভাবে আবেগের উৎস হতে পারে? অবশ্যই পারে। কারণ এর সাথে যুক্ত রয়েছে আমাদের বেঁচে থাকার ইতিহাস। এসব গাছের নীচেই স্থান পেয়েছিল আমাদের হাজার হাজার আত্মীয়স্বজন। এসব গাছ তাদের ছায়া দিয়েছে।  স্নিগ্ধ সমীরণ দিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে আসার ক্লান্তি দূর করে দিয়েছে। ভারতে পৌঁছানোর আগে সামান্য হলেও লক্ষ লক্ষ মানুষের দীর্ঘ পথযাত্রাকে সহজ করেছিল এসব শতবর্ষী গাছের ছায়া।

অকৃতজ্ঞ মানুষ আমরা আজ কিভাবে ভুলে যাই গাছের সেই অবদানকে? হাজার হাজার গাছ কেটে সেখানে নতুন গাছ আমরা লাগাতে পারি কিন্তু শতবর্ষের যে বাস্তুতন্ত্রের বিনাশ হবে তা‘তো পরবর্তী শত বছরেও ফিরে পাবো না। তাই পরিবেশ রক্ষায় ও মুক্তিযুদ্ধের  ঐতিহ্য বাঁচাতে সচেতন মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে লুটেরা আমলাতন্ত্রের সঙ্গে কোনপ্রকার আপসরফা বা ছাড় দেওয়া যাবে না।

সর্বশেষ জানা যায় যে, হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশ নামে একটি মানবাধিকার সংগঠনের দায়ের করা এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট গত ১৮ জানুয়ারি শতবর্ষী এই গাছগুলো কাটার ক্ষেত্রে ছয় মাসের জন্য স্থিতাবস্থা দিয়েছে। আমরা জানি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী যারা এই গাছ বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত তারা আইনি লড়াইয়ে যাবে, এই স্থিতাবস্থা স্থগিত করার চেষ্টা করবে। সুতরাং যশোর রোডের গাছ রক্ষা করে পরিবেশ বাঁচানোর ও মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্য রক্ষার আন্দোলন শুরু হল মাত্র।

  • আলতামাস পাশা: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী

আপনার মন্তব্য

আলোচিত