ডা. সাঈদ এনাম

২৮ জুন, ২০১৯ ০১:২৩

জেনোভেস সিনড্রম এবং কিছু হত্যা ঘটনা

বরগুনার কতিপয় সন্ত্রাসী কতৃক এক তরুণকে খুনের ঘটনায় সবাই শোকার্ত। হত্যাকাণ্ডের ভিডিও চিত্র সবার হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে। ভিডিওতে দেখা যায় প্রকাশ্যে দিবালোকে জনবহুল এলাকায় সবার সামনে কয়েকজন সন্ত্রাসী এক তরুণকে কুপিয়ে হত্যা চেস্টা করছে। কেবল মাত্র তার স্ত্রী তা ঠেকানোর চেষ্টা করছেন বাকি সবাই তাকিয়ে দেখছে। এগুচ্ছে না, অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আর মুহুর্তেই সব ঘটে যাচ্ছে।

ভিডিও দেখে সবার মুখে মুখে একটাই প্রশ্ন, যেখানে একজন নারী প্রতিহতের চেস্টা করছেন, সেখানে বাকিরা এগুলেইতো হতো। আক্রান্ত তরুণটি মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেতে পারতেন।

এ প্রশ্নের উত্তর কিছু বলার আগে এরকম আরেকটি সন্ত্রাসী ঘটনার প্রসঙ্গ টানি।

ঘটনাটি খুব একটা আগের নয়। বছর দুয়েক আগে সিলেটের এম.সি কলেজ প্রাঙ্গনে বদরুল নামের এক সন্ত্রাসী খাদিজা নামের অনার্স পড়ুয়া এক তরুণীকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টার করে।

দৈবক্রমে সে ঘটনার রেকর্ড করা ভিডিও ফুটেজটিতে বদরুলের ভাবভঙ্গি, আশপাশ দাড়িয়ে থাকা সহপাঠীদের প্রতিক্রিয়া, পুলিশের প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি বিষয়ের মনোস্তাত্মিক দিকগুলো পর্যালোচনা করলে গুরুত্বপূর্ণ একটি সাধারণ বিষয় বেরিয়ে আসে। কেনো কেউ এগিয়ে আসেনা সাহায্যে।

বরগুনার মতো তখনও অনেকে ভিডিও দেখে প্রশ্ন করেন, "কেনো কোন একজন এগিয়ে এলো না? এগিয়ে আসলে হয়ত এতোটা জখম খাদিজার হতোনা"।

এসব ঘটনায় কেউ উদ্ধারে এগিয়ে আসে না এর একটি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আছে। কারণ এসময় উপস্থিত সকলের মনেত মাঝে কাজ করে "ডিফিউশন অব রেসপনসিভিলিটি"। মনোবিজ্ঞানী বা সাইকিয়াট্রিস্ট দের ভাষায় "জেনোভেস সিনড্রোম" নামে পরিচিত।

কি এই "জেনোভেস সিনড্রম" তা জানতে হলে একটু পিছনে 'কেটি জানোভেস' নামের আমেরিকান এক তরুণীর হত্যাকান্ডের দিকে তাকাতে হবে। এটা অনেকটা বরগুনা ও এমসি কলেজ প্রাঙ্গণের মতোই একটা ঘটনা।

কেটি জেনোভেস হত্যাকান্ড:

১৯৬৪ সালে নিউ ইয়র্ক শহরে নিজ অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এভাবে এক তরুণীকে প্রকাশ্যে উপুর্যুপুরি ছুরিকাঘাতের মাধ্যমে হত্যার ঘটনাটি ছিল ওই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত হত্যাকাণ্ডগুলোর একটি।

হোভার এভিনিউ এ সিগনাল বাতির সবুজ সংকেতের জন্য কেটি জেনোবেস তার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষারত ছিলেন। তিনি তখন অফিস থেকে বাসা ফিরছিলেন। এসময় মোসেলে নামের এক যুবক তাকে ফলো করে এবং পিছু নেয়। ৮২-অস্টিন স্ট্রিটের অদূরে গাড়ি পার্ক করে কেটি জেনোভেস যখন তার গার্ডেনস এপার্টমেন্ট এর দিকে হেটে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই মোসেলে তাকে পিছন থেকে চাপাতি দিয়ে একের পর আঘাত করে। কেটি তখন নিজেকে বাঁচাতে চিৎকার করতে থাকেন।

প্রায় ১০/১৫ মিনিট যাবত তিনি মোসেলের হাত থেকে আত্মরক্ষার্থে হেল্প হেল্প বলে চিৎকার করছিলেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তখন কেউ আসেনি তাকে উদ্ধার করতে যদিও তখন সেখানে অনেক লোক উপস্থিত ছিলো।

কেন সেই ঘটনা এতো আলোচিত? কারণ The New York Times এর মতে ওই সময়ে ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শী ছিল প্রায় ৩৭-৩৮ জনের মতো, যাদের যে কেউ অসহায় তরুণীকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসলে হয়তো তাকে বাঁচানো যেতো।

যাহোক এরপর থেকেই শুরু হয় এই ঘটনা নিয়ে অনেক বিচার বিশ্লেষণ। সবার মনে প্রশ্ন জাগে, কেন জনাকীর্ণ একটি জায়গায় কেউ আক্রান্ত হলে আশেপাশের কেউ সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে না?

বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে থাকেন আমেরিকার সাইকিয়াট্রিস্টরা। দীর্ঘ গবেষণা ও উপস্থিত সকলের সাথে আলাপ করে তারা এই সিদ্ধান্তে উপনিত হন যে, "ডিফিউশন অব রেসপনসিবিলিটি'র" জন্যে এধরনের কোন আকস্মিক আক্রান্ত হবার ঘটনায় ভিকটিমকে সাধারণত কেউ সাহায্য করতে আসে না।

পরবর্তিতে কেটি জেনোভেস এর নামেই আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন এই ডিফিউশন অব রেসপনসিবিলিটি'র আরেক নাম দেন "জেনোভেস সিনড্রোম"। আদালতে মোশেলের ফাঁসির রায় হয়।

যে কোন আকস্মিক আক্রমনের ঘটনায় সামনে উপস্থিত সবার মাঝে "জেনোভেস সিনড্রোম" বা "ডিফিউশন অব রেসপনসিবিলিটি" কাজ করে তাই তারা এগিয়ে আসেন না। কারন তখন প্রত্যক্ষদর্শি সবাই ভাবেন, "অন্য সবাই তো আছে সাহায্য করার জন্য, আমি কেন ঝামেলায় জড়াবো নিজেকে?" অথবা "কেউ আগালে আমিও আগাবো" এরকম একটা দোদুল্যমান অবস্থা।

পরবর্তীতে সাইকিয়াট্রিস্টরা এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, "তুমি যত বেশি মানুষের সামনে বিপদে পড়বে তোমার সাহায্য পাবার সম্ভাবনা তত কম হবে"। আবার "যত কম মানুষের সামনে থাকবে তত বেশী সাহায্য পাবার সম্ভাবনা থাকে"।

আমরা একটু চারপাশে তাকালেই এই নির্মম সত্যটুকু উপলব্ধি করতে পারব। এরকম ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই আমাদের চারপাশ ঘটছে।

তবে এখানে একটা আশার কথা বলে রাখি, এরকম আক্রান্তের ঘটনায় বিপরীত ঘটনাও ঘটতে পারে। যেমন উপস্থিত যে কেউ সাহস করে এগিয়ে আসলে সবাই তখন এগিয়ে আসে, ডিফিউশন অব রেসপন্সিবিলিটি তখন আর খুব একটা কাজ করে না।

ডা. সাঈদ এনাম: মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত