ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

১০ এপ্রিল, ২০২০ ১৩:১১

বিশ্ব হোমিওপ্যাথি দিবস ও ডা. হ্যানিমানের জন্মবার্ষিকী

আজ শুক্রবার ১০ এপ্রিল বিশ্ব হোমিওপ্যাথি দিবস। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক ডা. স্যামুয়েল হ্যানিমেনের জন্মবার্ষিকীর দিনে পৃথিবীব্যাপী এ দিবসটি পালন করা হয়। আজ জনকের ২৬৫তম জন্মবার্ষিকী।

২০০৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী হ্যানিমেনের জন্মদিন ‘বিশ্ব হোমিওপ্যাথি দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। তবে ২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশে যাত্রা শুরু বিশ্ব হোমিওপ্যাথি দিবসের এবং বিশ্ব হোমিওপ্যাথি আন্দোলনে যুক্ত হয় বাংলাদেশ। আমরা সবাই জানি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্ম জার্মানিতে। বিজ্ঞানী ডা. স্যামুয়েল হ্যানিমানের আবিষ্কারক (১০ এপ্রিল ১৭৫৫ থেকে ২ জুলাই ১৮৪৩ ছিল তার জীবনকাল)।

তিনিই প্রথম চিকিৎসাবিজ্ঞানী যিনি ভেষজ বস্তুকে শক্তিকরণ করে তা সুস্থ মানবদেহে পরীক্ষার মাধ্যমে ওষুধের রোগজ শক্তির আবিষ্কার করেন, যা তার আগে কোনো বিজ্ঞানী করেননি। তাই আমরা তাকে শ্রদ্ধা করি বিপ্লবী বিজ্ঞানী হিসেবে। বিপ্লবী এ বিজ্ঞানীর জন্মবার্ষিকী বিশ্বব্যাপী পালিত হয়,এই দিনে পৃথিবীর আর কোনো বিজ্ঞানীর জন্মদিন এভাবে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় না।

২০০৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী হ্যানিমানের জন্মদিন পালিত হচ্ছে বিশ্ব হোমিওপ্যাথি দিবস হিসেবে। বিজ্ঞানে কৃত্রিম রোগ আবিষ্কার স্বাস্থ্য বিজ্ঞানে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। ১৭৯০ সালে পৃথিবীর মানুষ প্রথম জানতে পারে তার আবিষ্কারের কথা।

জাতীয় মানবাধিকার সংস্থা, হিউম্যান রাইটস রিভিউ সোসাইটির কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা, ও হোমিও গবেষক, ডা. এম এ মাজেদ তার কলামে লিখেন,  হোমিওপ্যাথিকে জানতে হলে, হ্যানিমান কে জানতে হবে। হ্যানিমেনের মূল্য বুঝতে পারলে, হোমিওপ্যাথির মূল্য বুঝা যাবে আজ ১০ এপ্রিল বিশিষ্ট গবেষক  চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক ডা. স্যামুয়েল হ্যানিমানের ২৬৫ তম জন্মবার্ষিকী।

ডা. স্যামুয়েল হ্যানিমান ১৭৫৫ সনে জার্মানির অন্তর্গত স্যাকস্যানি প্রদেশের মিশন নগরীর পটুয়ার ঘরে ১০ এপ্রিল জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ক্রিস্টিয়ান গড ফ্রাইড এবং মাতার নাম জোহানা ক্রিস্টিয়ানা। তার পিতা মৃৎ শিল্পী ছিলেন। অর্থাৎ চীনা মাটির বাসন-পত্রের গায়ে ছবি আঁকতেন। তার পিতা বাল্যকালে হ্যানিমানের শিক্ষার প্রতি আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু তার প্রতিবার পরিচয় পেয়ে শিক্ষকদের অনুরোধে তিনি তাকে স্কুলে পাঠান। রাত্রে পড়াশোনার জন্য তেল খরচের ভার বহনে পিতা বিরক্ত হতেন। সে জন্য তিনি গোপনে মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে, ঘরের এক কোনে লুকিয়ে পড়াশোনা করতেন।

২০ বছর বয়সেই হ্যানিমান ল্যাটিন, গ্রীক হিব্রু প্রভৃতি বহু ভাষার পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। ১৭৭৫ খৃষ্টাব্দে ২০টি ডলার নিয়ে উচ্চ শিক্ষালাভের আশায় লিপজিগ শহরে গমন করেন। সেখানে দিনের বেলায় লেখাপড়া করতেন এবং রাতের বেলায় ইংরেজি থেকে জার্মান ভাষায় বই পত্র অনুবাদ করতেন। ১৭৭৯ খৃষ্টাব্দে ২৭ বছর বয়সে এনালার্জেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমডি উপাধি লাভ করেন।

১৭৮২ খৃষ্টাব্দে ২৭ বছর বয়সে তিনি দেশাউ নগরের ঔষধ বিক্রেতা কুচলারের কন্যা জোহনা হেনরিয়েটি লিওপোলডিনি কুসলারকে বিয়ে করেন। এর কিছু দিন পূর্বেই তিনি গোমারন ধর্ম মন্দিরের চিকিৎসক নিযুক্ত হন। এ সময় তিনি এলোপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতির উপর আস্থাশীল হয়ে পরেন। এসময় তিনি গোমরন ত্যাগ করে ড্রেসডেন সদর হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত নিযুক্ত হন। শুনতে অবাক লাগলে ও সত্য হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক ডা. হ্যানিমান এলোপ্যাথি চিকিৎসা শাস্ত্রে লেখা পড়া করে ডাক্তার হন এবং এলোপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি অনুযায়ী রোগীদের সেবা প্রদানও করতেন। চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি তিনি গবেষণা ও চিকিৎসা শাস্ত্রের যাবতীয় অনেক বইয়ের অনুবাদ করেছেন।

গবেষণার এক পর্যায়ে তিনি এলোপ্যাথি চিকিৎসাতে ক্ষতিকর/সাইড এফেক্ট-এর সন্ধান পান। সাইড এফেক্ট চিহ্নিত করার পরই তিনি এলোপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি চিরদিনের জন্য ত্যাগ করেন। সাইড এ্যাফেক্টর কারণ নির্ণয়ে গবেষণার মাধ্যমে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার সূত্র আবিষ্কার হয়। হ্যানিমান নিজের নিজের দেহে ১৩০টি মেডিসিন প্রুফ করেছেন। সর্ব প্রথম মানবদেহে হোমিওপ্যাথি মেডিসিন পরীক্ষা করা হয়েছে। পেরুভিয়ান কফি বা সিষ্কোকা গাছের বাকল নিয়ে গবেষণা করতে করতে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার উদ্ভব হয়।

পৃথিবীর কনিষ্ঠতম চিকিৎসা পদ্ধতি হল হোমিওপ্যাথি। ঔষধ পরীক্ষার পাশাপাশি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার নিয়ম নীতি প্রকাশ করেন ১৮১০সনে। অর্গান নামে যার পরিচিতি চিকিৎসক মহলে।তার জীবনের শেষ পর্যায়ে অর্গান ৬ষ্ঠ সংস্করণ সমাপ্ত করেন।বইটির আধুনিক ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৮৮২ সালে হ্যানিমান ফাউন্ডেশন, আমেরিকা থেকে।

হোমিওপ্যাথির জন্ম জার্মানিতে। বিকাশ ফ্রান্সে, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ব্রিটেন ১৮০৫ সনে। প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দি প্যারিস কলেজ অব হোমিওপ্যাথি ডা. হ্যানিমান সম্পর্কে ড. হুদহুদ মোস্তফার গবেষণা থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়,

সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতায় ভীষণ ভাবে আক্রান্ত আর সত্য চাপা দিতে অত্যন্ত পারদর্শী পশ্চিমা জগত যতদিন সম্ভব সম্রাট নেপোলিয়ন, মর্মাডিউক পিকথল, মরিস বোকাইলি, নীল আর্মস্ট্রংসহ আরও অনেক মনীষীর ইসলাম গ্রহণের সংবাদকে চাপা দিয়ে রেখেছিল। সত্য কোন দিনই হারিয়ে যায় না। কালের প্রবাহে কোন এক দিন প্রকাশিত হয়ই। সম্ভবত সবচেয়ে বেশী সময় ধরে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের আবিষ্কর্তা ডা. স্যামুয়েল হ্যানিমানের ইসলাম গ্রহণের সংবাদটি চাপা পড়ে আছে।

ড. হুদহুদ মোস্তফা এক নিবন্ধে লিখেছেন অনেক কথা, ১৯৯৮সালে লন্ডনে এক সেমিনারে ড. মোস্তফার সাক্ষাৎ ঘটে হ্যানিমানের এক নিকটতম  আত্মীয়  ইঞ্জিনিয়ার এর সাথে। তার নাম উইলিয়াম হ্যানিমান। বিজ্ঞানী ডা. হ্যানিমানেরই এক উওর, পুরুষ তিনি। বিশ্বাসে ক্যাথোলিক খৃষ্টান।

কথা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডা. হ্যানিমান গবেষণার এক পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে গিয়েছিলেন এবং তিনি আমৃত্যু ইসলামী বিশ্বাসেই প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। যে কারণে তিনি নিজ জন্মভূমি, স্বজাতি, আত্মীয় পরিজন ত্যাগ করে দ্বিতীয় স্ত্রী  মেরী মেলানী ডি. হারভিলীকে নিয়ে প্যারিসে হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন।  মেরী মেলানী ডি. হারভিলীও স্বামীর সাথে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এ ঘটনা জানাজানি হয়ে পড়লে হ্যানিমানের স্বজনরা তার প্রতি বিরূপ হয়ে পড়েন। চির পরিচিতি পরিবেশ তার বিরুদ্ধে চলেযায়। শান্তি ও নিরাপওার স্বার্থে সকল সহায় সম্পদ উওরাধিকারী আত্মীয় স্বজনদের মধ্য বিলিবন্টন করে তিনি ইসলামে নবদীক্ষিত স্ত্রী  মেরী মেলানী ডি. হারভিলীকে নিয়ে প্যারিসের পথে হিজরত করেন। এ সময়টা ছিল ১৮৩৫ সালের জুন মাস।

তারা তাদের জীবদ্দশায় আর কখনও জার্মানিতে ফিরে যাননি। হিজর নবীদের সুন্নাত। ইসলাম গ্রহণের কারণে জার্মান বিজ্ঞানী হ্যানিমানকেও সেই সুন্নতেরই অনুসরণ করতে হয়। উইলিয়াম হ্যানিমান আরও কিছু মহামূল্যবান তথ্য দিয়ে সবাইকে চিরকৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করেছেন। প্রথমে তিনি ড. মোস্তফাকে বলেছিলেন লন্ডনস্থ হ্যানিমান মিউজিয়ামে যেতে। সেখানে হ্যানিমানের ব্যবহৃত বহু জিনিসপত্র আছে, বই পুস্তকের এক বিরাট সংগ্রহ ও আছে এর মধ্যে মহাগ্রন্থ আল কোরআন, শতাধিক আরবি গ্রন্থ রয়েছে। ব্যবহৃত জিনিস-পত্রের মধ্যে রয়েছে মসজিদের নকশা করা জায়নামাজ, মূল্যবান পাথরের তসবিহ একটি টার্কিশ টুপি। ব্যবহৃত জায়নামাজের সেজদার চিহ্ন স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়।

ডা. হ্যানিমান ইসলাম গ্রহণ এবং জার্মানি ত্যাগের পর তিনি আর কখনও কোথাও তার পিতৃ প্রদত্ত নাম ক্রিশ্চিয়ান ফ্রেডারিক আদ্য শব্দ দু’টি ব্যবহার করেননি। যে দুটো খৃষ্ট ধর্মাবলম্বীর পরিচয় বহন করে। প্যারিসে হিজরতের পর চিঠিপত্র সহ সর্বত্র কেবল স্যামুয়েল হ্যানিমান” লিখতেন। স্যামুয়েল ইসরাইল বংশীয় একজন নবীর নাম, হিসাবেও গ্রহণযোগ্য, একথা তার খৃস্টান ধর্ম ত্যাগের আর একটি শক্তিশালী প্রমাণ।

ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত ম্যাগাজিনের ২৪৫ পৃষ্ঠায় স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে। মাদাম   তার স্বামী হ্যানিমানের মৃত্যু পূর্ব ওসিয়তের কারণে কোনো অমুসলিমকে তার দাপনে অংশগ্রহণ করতে দেননি। তিনি দাফনের দিনক্ষণ সবই গুপ্ত রেখে মুসলমানের সাক্ষাৎ পাবার আশায় অপেক্ষা করেছিলেন।হ্যানিমানের মৃত্যু ২ জুলাই ১৮৪৩ তারিখে। কোন মুসলমানের সাক্ষাৎ না পেয়ে  মেরী মেলানী ডি. হারভিলী নিজে তার সমবিশ্বাসী। (নবদীক্ষিত মুসলিম) দৃঢ় প্রত্যয়ী দুই ব্যক্তির সহযোগিতায় চিকিৎসা বিজ্ঞানী হ্যানিমানকে মৃত্যুর ৯ দিন পর ১১ জুলাই কবরস্ত করেন।

হ্যানিমানেরই ইচ্ছা অনুযায়ী প্যারিসের অখ্যাত মাউন্ট মারাট্টির গোরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। এটি খৃস্টানদের গোরস্থান হলেও একটু আলাদা স্থানে পূবেই উল্লেখ করেছি, হ্যানিমান তার সমাজের প্রচলিত খৃষ্টান ধর্ম ত্যাগের কারণে জার্মানিতে পরিচিত পরিবেশ তার বিরুদ্ধে চলে যায়। নিরাপত্তা ও শান্তির সন্ধানে তিনি ১৮৩৫ সালের জুন মাসে ৮০ বছর ২ মাস বয়সে তার পৈতৃক দেশ জার্মানি ত্যাগ করেন। আর কখনও তিনি বা তার স্ত্রী ফ্রান্স থেকে জার্মানিতে ফিরে যাননি। এতে প্রমাণিত হয় ইসলাম গ্রহণের ফলে বিজ্ঞানী হ্যানিমান ও মাদাম ম্যালনীর জীবনের শান্তি ও নিরাপওা জার্মানিতে কতটুকু বিপন্ন ছিল।

হ্যানিমানের কিছু প্রবাদ তুল্য উক্তি রোগীকে চিকিৎসা কর রোগকে নয়। অথচ কিছু কিছু হোমিও চিকিৎসক বের হয়েছে, এরা রোগীর লক্ষণ নির্বাচন না করে রোগের নামে চিকিৎসা দিয়ে থাকে, তাই আজকের এই দিনে হ্যানিমানের কথা স্মরণ করে, হ্যানিমানের অতীতের সব গুন গুলা মাথায় রাখতে পারলে সেই হল প্রকৃত হোমিওপ্যাথি। হ্যানিমান একটি কথা বলতেন; আমি বৃথা জীবন ধারণ করিনি, যা ভাল তা শক্ত করে ধরব” সব কিছুই প্রমাণ করব।

  • লেখক: ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

দৈনিক স্বাস্থ্য তথ্যের সম্পাদক ও প্রকাশক   
হিউম্যান রাইটস রিভিউ সোসাইটি কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা
সবুজ আন্দোলন কার্যনির্বাহী পরিষদের পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সম্পাদক
হোমিও বিজ্ঞান গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কো-চেয়ারম্যান

 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত