তানভীর চৌধুরী পিয়েল

২৮ অক্টোবর, ২০১৭ ১৭:৫৮

ডুব: দৃশ্যগুলো দৃষ্টিকে আটকে দিয়েছে

মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর “ডুব” এর প্রথম শো দেখতে সমর্থ হয়েছি। কিন্তু দর্শক হিসেবে ডুব আমাকে ছুঁয়ে যেতে পারেনি। পারেনি হুমায়ূন আহমেদ-কে ছুঁতে, কিংবা প্রধান চরিত্র নির্মাতা জাভেদ হাসানকে। সাগর ভেবে ডুব দিয়ে গিয়ে দেখি কোমর পানি! ডুবে এমন কোন গল্প নেই যা বাংলাদেশী দর্শকদের অজানা। ডুব নতুন কোন সত্যকে রিভিল করতে পারেনি। চলচ্চিত্রকার বলতে চেয়েছিলেন মৃত্যু সব কিছু নিয়ে যায় না,অনেক সময় কিছু দিয়েও যায়, কিন্তু দর্শক হিসেবে সেরকম কিছু পাইনি।

“ডুব” মধ্যবয়সী এক নির্মাতার গল্প। সিনেমা শুরু হয় একটি স্কুলের রিইউনিয়নের দৃশ্যের মধ্য দিয়ে (সিনেমার শেষেও একই দৃশ্য ছিলো), যেখানে দুই বান্ধবী নিতু আর সাবেরী গভীর বিষাদ নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। পরবর্তী সময়ে জানা যায় এদের একজন নির্মাতার মেয়ে, অন্যজন নির্মাতার দ্বিতীয় স্ত্রী। আরও জানা যায় সাবেরী আর নিতু সর্বদাই একজন আরেকজনের প্রতিযোগী ছিলো।

শুরুর দিকে পর্দায় দেখা যায় জাভেদ হাসান (ইরফান খান) অবকাশ যাপনে বান্দরবানে হলিডে রিসোর্টে যান। স্মৃতিতে রোমন্থন হয় জাভেদ হাসানের বিয়ের গল্প। জাভেদ হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়র ছাত্র, যখন তিনি তার প্রথম স্ত্রী মায়াকে (রোকেয়া প্রাচী) পালিয়ে বিয়ে করেন। মায়ার মধ্যবিত্ত বাবা পুলিশের কাছে অপহরণ মামলা দিতে চান কিন্তু পুলিশ আপোষের প্রস্তাব দেয়। তারপর দেখা যায় জাভেদ হাসান ও তার স্ত্রীর সম্পর্কের ক্রাইসিস। জাভেদ হাসানকে বারবার অতীতে ফিরে যেতে দেখে মায়া প্রশ্ন করেন, “এখানে আসার পর বারবার তুমি অতীতের কথা বলছো কেন, আমাদের মধ্যে বর্তমানে কি কিছুই নেই”। জাভেদ হাসান নিরুত্তর থাকেন।

এরপর জাভেদ হাসানের জীবনে নিতুর (পার্ণো মিত্র) অনুপ্রবেশ ঘটে। জাভেদ হাসান আলাদা বাড়িতে বাস করেন। সে বাড়ির দেয়াল টপকে জাভেদের কাছে চলে আসতেন নিতু। পত্রিকায় বিভিন্ন খবরের বিষয়বস্তু এবং টিভির টকশোর আলোচ্য বিষয় হয় এই সম্পর্কের বিষয়টি। দেখানো হয় কেউ এই সম্পর্কটিকে মেনে নিতে পারছেন না এবং জাভেদ হাসানকে দেখা যায় মানসিক দোটানায়। জাভেদ হাসানের আলাদা বাড়ির বিভিন্ন দৃশ্যে তার বৃদ্ধ গৃহপরিচারকের সক্রিয় উপস্থিতি ছিলো।

জাভেদ হাসানের মেয়ে সাবেরী (নুসরাত ইমরোজ তিশা) বাবার বাড়িতে এসে তার কঠিন সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে যান, “আজকের পর থেকে তুমি তোমার ছেলের এবং মেয়ের কোন রকম কোন খবর পাবা না”। অন্যদিকে দেখা যায় তার দ্বিতীয় নিতু- স্ত্রী হিসেবে তার অধিকার পাবার জন্য লড়ে যাচ্ছেন।

এরপর সেই মুহূর্ত আসে। তার বাসার ড্রইংরুমে কিছু মানুষকে কোরান শরিফ পড়তে দেখা যায় এবং জানা যায় নির্মাতা জাভেদ হাসানের মৃত্যু হয়েছে। টেলিফোনে খবর পাবার পর স্ত্রী মায়ার মধ্যে কোন ভাবান্তর লক্ষ্য করা যায় না, স্বাভাবিক ছিলেন মায়ার মেয়ে ও ছেলে। তারপর শোনা যায় মায়ার শক্তিশালী ডায়লগ, “যখন শুনলাম তুমি মারা গিয়েছ, খুশি হয়েছি। সত্যিই অনেক খুশি হয়েছি। আজকের পর থেকে তোমার প্রতি আর অন্য কারো অধিকার রইলো না”।

যখন সাবেরীর চাচা এসে জানান “নয়নতারা”-তে জাভেদ হাসানের দাফন হবে তখন সাবেরী প্রতিবাদী হয়ে উঠেন। সাবেরী জানান এসব নিতুর ষড়যন্ত্র। তার ভাষায় "মারা যাবার দুই ঘন্টার মধ্যে শেষ ইচ্ছা ম্যানুফ্যাকচারড হয়ে গেলো?"

বাবার কাফনে মেয়ের চুমু খাবার করুণ দৃশ্যের মধ্য দিয়ে সিনেমার পরিসমাপ্তি ঘটে।

এই সিনেমার সবচেয়ে শক্তিশালী উপাদান ছিলো এর সিনেম্যাটোগ্রাফি, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, সুমীর “আহারে জীবন” গান এবং ইরফান খান ও রোকেয়া প্রাচীর অনবদ্য অভিনয়। সিনেমায় প্রত্যাশিত গভীরতা ছিলো না। আমি বারবার সিনেমার ভেতরে ঢুকতে চেয়েছি। কিন্তু দৃশ্যগুলো বারবার আমার দৃষ্টিকে আটকে দিয়েছে।

“ডুব” এর নিমার্তা বরাবরই অস্বীকার করেছিলেন এটি উপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ এর গল্প নয়। এবং তিনি এই বিচারের ভার দর্শকদের উপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। অথচ হুমায়ূন আহমেদকে মাথা থেকে সরিয়ে এই সিনেমা দেখার সুযোগ অন্ততঃ বাংলাদেশী দর্শকদের ছিলো না। আমি দর্শক হিসেবে এই সিনেমায় বহুবার এমন সব গল্প আর দৃশ্যের উপস্থিতি পেয়েছি যেখানে জাভেদ হাসানকে হুমায়ূন আহমেদের রূপে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। অথচ এই সিনেমা হুমায়ূন আহমেদের বিশালতার খুব কম অংশই ধারণ করতে পেরেছে। এছাড়া শেষের দিকে নির্মাতার নিতুকে জড়িয়ে ধরা ছাড়া পুরো সিনেমায় নিতুর আবেগকে মূল্য দেয়া হয়নি।

হুমায়ূন আহমেদের জীবনের গল্পের ছায়ায় নির্মিত “ডুব”কে হুমায়ূন আহমেদের বায়োপিকের মর্যাদা দিলে আমি আরেকটু বেশি রেটিং দিতে পারতাম। দুঃখিত।

মূল চরিত্র:
জাভেদ হাসান - ইরফান খান
মায়া - রোকেয়া প্রাচী
নিতু - পার্ণো মিত্র
সাবেরী - নুসরাত ইমরোজ তিশা

“ডুব” সকলে দেখার মত একটি সিনেমা। দেখার জন্য রিকমেন্ডেশন থাকলো।
সিনেমার জয় হোক!

আপনার মন্তব্য

আলোচিত