জয়দেব কর

১৯ মে, ২০২০ ১৬:০৯

প্রসঙ্গ বুদ্ধ: বিচ্ছিন্ন ভাবনা

গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে আমার আগ্রহের জায়গাটি হলো তাঁর প্রজ্ঞা ও সারল্যের অভিজাত্য। যে আভিজাত্য সকল প্রাণিকে দেখে সন্তানের মতো। মহাপ্রকৃতিকে বুকে নিয়ে এমন প্রেমের আহবান সহস্রাব্দ পেরিয়েও ম্লান হয়নি। মাটিতে চাপা দিয়েও অপশক্তি রোধ করতে পারেনি এই প্রেমিকসত্তার উদাত্ত আহবান, "নিজেই নিজের নাথ বা ত্রাতা, অন্য কোনও নাথ বা ত্রাতা নেই”।

প্রচলিত ধর্মগুলো যেখানে মানুষকে তার নিজের সত্তার প্রতি অশ্রদ্ধাশীল করে তুলতে মরিয়া, সেখানে বুদ্ধ মানুষকে নিজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার এই মৌলিক পাঠটি দিয়েছেন। তথাকথিত ধর্মযাজক-প্রবর্তকদের শঠতার হাসি তাঁর মুখে ছিল না। নিজেকে পূজোর আসনে বসিয়ে পা মেলিয়ে দেননি তাঁকে পূজা করার জন্য। মাটির পৃথিবীতে নিজেকে সকল মানুষের ও সকল জীবের একজন ভেবেই কাজ করে গেছেন, যেখানে পা নয় বুকই সংযোগের একমাত্র জায়গা।

বিজ্ঞাপন

তিনি মানুষকে যে মর্যাদায় দেখতেন, তা হলো_ কেউ তার সমান নয়, কেউ তার চেয়ে ছোটো নয়, আবার কেউ তার চেয়ে বড়োও নয়। ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করার মতো এই উন্নত বোধ নিয়েই তিনি প্রচার করেছিলেন, "সঙ্ঘং সরনং গচ্ছামি" নামক মানুষের সামাজিক মুক্তিযানের কথা।


ঈশ্বরে বিশ্বাস না করেও সুকর্ম যেমন করা যায় তেমন পরকাল বিশ্বাস না করেও সুকর্ম করা যায়। যারা অভিজ্ঞতাবাদী তাদের কাছে বিশ্বাসের কোনও মূল্য নেই। মূল্য রয়েছে শ্রদ্ধার। কারণ বিশ্বাস চাপিয়ে দেওয়া হয়। আর শ্রদ্ধা অন্তরে উদিত হয় এবং তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলস্বরূপ, মানে 'এহি পাসসিকো' চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে জন্ম নেওয়া এক পরম বোধের নাম। পুরোহিতরা মুষ্টিবদ্ধ করে বলত তাদের মুষ্টির মধ্যে সত্য লুকায়িত। সেই সত্য কী? ঈশ্বর আর পরকাল। তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে শেখাতো- পূজা আর পুরোহিতকে দানের মধ্যেই ক্ষত্রিয়-বৈশ্যের মুক্তি। নারী ও শূদ্রের মুক্তি সেবায়। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এমন কপট উচ্চারণ মোকাবেলা করে তথাগত গৌতম মুষ্টি খুলে ঘোষণা করেন তাঁর মুষ্টির ভেতর কোনও কিছু লুকিয়ে রাখা তাঁর ধম্ম নয় এবং মানুষে মানুষে ভেদ তৈরি ধম্ম নয়।

খোলা মুষ্টিতেই সকল সত্য নিহিত। সেই সত্যগুলো হলো- চার মহাসত্য, অষ্টাঙ্গিক মহাপথ, প্রতীত্যসমুৎপাদ নীতি, যা যে কেউ অনুশীলন করে আপন মুক্তির পথ নির্মাণ করতে পারেন। শুধু তাই নয়, তিনি আরও চমৎকারভাবে মানুষকে মর্যাদা দিয়েছেন। বলেছেন, "নিজেই নিজের প্রভু, নিজেই নিজের ত্রাতা", "আমার দর্শন ভেলার ন্যায়, পারাপারের বাহন; মাথায় তোলে ঘোরার কিছু নয়"।

বিজ্ঞাপন

তাঁর শিক্ষার মূলকথা- করুণা ও প্রজ্ঞা জাগ্রত করো। আজকের দিনের কল্যাণমুখী বিজ্ঞানও স্বীকার করে করুণা ও প্রজ্ঞা প্রকৃত মানব-প্রকৃতি বহন করে। প্রকৃত মানবপ্রকৃতিই স্বধর্ম, তা-ই প্রকৃত মানবিক। যা কিছু অমানবিক তা-ই পরধর্ম। তিনি বলেন, এই পরধর্মই মনে বিরাজ করে লোভ-দ্বেষ-মোহ নাম ধরে। পরধর্মে জর্জরিত মানুষগুলো অহমের বিষাক্ত থাবায় বন্দি। অহমের বিষে বন্দি মানুষ এই বন্দিত্ব ছড়িয়ে দেয় বা দিতে চায় ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে, সমাজ থেকে সমাজে। যার ফলে হিংসা-বিদ্বেষে কলুষিত হয়ে ওঠে মহামাতৃকা পৃথিবী।

তাই ব্যক্তিগত ও সামাজিক সুখ-শান্তি নিশ্চিত করতেই আপন গরজ তথা মনুষ্যগরজেই মানুষকে বুদ্ধ নির্দেশিত সুকর্ম-সুচিন্তা-সুবচনের আশ্রয় নিতেই হবে। তাঁর ধম্ম হচ্ছে কুশল মনোবৃত্তি তৈরির এক উন্নততর শিক্ষাপদ্ধতির নাম, যা অমার্জিত অসংস্কৃত (মিথ্যাদৃষ্টিপরায়ণ) ব্যক্তির ক্ষেত্রে সহজে মেনে নেওয়ার মতো নয়।

সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসার মতো সর্বসত্তার প্রতি তাঁর সার্বজনীন প্রেমের শিক্ষা এড়িয়ে গিয়ে বাকির লোভে নগদ পাওনা ছেড়ে দেওয়ার মতো মূঢ়তাই আমাদেরকে প্রগতির চাকা সচল করতে দিচ্ছে না। এত অর্জনের পরেও আমরা সামগ্রিকভাবে মানবিক হয়ে উঠতে পারিনি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত