মাহফুজ সাদি

০৯ অক্টোবর, ২০১৫ ১৩:৫৮

চে গেভারা: আজন্ম বিপ্লবী

চে। চে গেভারা। কাগজে-কলমে আর্নেস্তো গেভারা ডেলা সেরনা। সারাবিশ্বের শোষিত, নিপীড়িত ও মুক্তিকামী মানুষের প্রদীপ্ত প্রতীক তিনি। সাম্রাজ্যবাদী শোসকদের কাছেও সমানভাবে পরিচিত এই নামটি। লাটিন আমেরিকার এই বৈপ্লবিক বরপুত্রকে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষদের কাছেও নতুন করে চিনিয়ে দেবার প্রয়োজন পড়ে না।

১৯২৮ সালের ১৪ জুন আর্নেস্তো গুয়েভারা লিঞ্চ ও ডে লা সেরনার ঘরে জন্ম নেন চে। ১৯৫২ সালে বুয়েন্স আয়ার্স থেকে ডাক্তারি পাশ করেন তিনি। ১৯৫৪ সালে সিআইএ পরিচালিত এক সামরিক অভ্যুত্থানে গুয়াতেমালার জাকাবো আরবেনজের নির্বাচিত সরকারের উৎখাত খুব কাছ থেকে দেখেছেন চে। তারপর রাজনৈতিক কার্যকলাপের দায়ে মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে গুয়াতেমালা ত্যাগ করে মেক্সিকোতে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হন তিনি।

কিউবার স্বৈরতন্ত্রী সরকার ফুলজেনসিও বাতিস্তাকে হটাতে দেশটির নির্বাসিত বিপ্লবী নেতারা তখন মেক্সিকোতে আশ্রয় নিয়ে কর্মতৎপরতা চালাতে থাকেন। ফলে সেখানেই ফিদেল কাস্ত্রোসহ বিপ্লবীদের সাথে ঘনিষ্ঠতা ও সান্নিধ্য লাভ করেন চে। ১৯৫৫ সালের ২৫ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর সিয়েরা মায়েস্ত্রা পাহাড়ে অবস্থান নিয়ে কিউবার বাতিস্তা সরকার উৎখাতের পরিকল্পনায় বিপ্লবীদের সঙ্গী ছিলেন তিনি। চিকিৎসক হিসেবে দিয়েছেন সেবাও।

১৯৫৭ সালের জুলাইতে সশস্ত্র বিপ্লবী বাহিনীর প্রথম কমান্ডার দায়িত্ব পান। ১৯৫৯ সালে তীব্র লড়াইয়ে বাতিস্তা সরকারের পতন ঘটে। চে তখন নতুন বিপ্লবী সরকারের অন্যতম নেতায় পরিণত হন। এরপর জাতীয় ভূমি সংস্কার ও শিল্প দপ্তরের প্রধান। জাতীয় ব্যাংকের সভাপতি, শিল্প দপ্তরের মন্ত্রী হিসেবে উন্নয়ন কর্মকান্ডে যুক্ত হন। ১৯৬৫ সালে কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা হন চে। আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও জাতিসংঘে কিউবার প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। বিশ্ব দরবারে কিউবার প্রধান বক্তা হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। ওই সময়ে তিনি চোখ ফেরান অন্যান্য দেশের দিকে।

বলেন, 'সর্বোপরি, একজন বিপ্লবীকে সবসময় দৃঢ়ভাবে বিশ্বের যেকোন প্রান্তে সংঘটিত যে কোনো অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে'।

প্রতিবেশি দেশগুলোর মুক্তিকামী নেতাদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদের সংগঠিত করেন। ১৯৬৫ সালের এপ্রিলে বৈশ্বিক সংগ্রামে স্বশরীরে অংশ নেয়ার উদ্দেশ্যে কিউবা ছাড়েন। কিছু সময় আফ্রিকার কঙ্গোতে অবস্থান করেন। পরে নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর ব্যবস্থাপনায় গোপনে আবার কিউবায় ফেরেন। ১৯৬৬ সালের নভেম্বরে বলিভিয়ার নিপীড়িত মানুষের মুক্তি সংগ্রামে যোগ দেন ছদ্মাবেশে। কিউবান ও বলিভিয়ার বিপ্লবীদের নিয়ে গেরিলা বাহিনী গঠন করে সেনাপতি রূপে আবির্ভুত হন।

চে শিক্ষা দেন, 'নতজানু হয়ে সারা জীবন বাচার চেয়ে আমি এখনই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত'। তাই 'চুড়ান্ত বিজয় অর্জিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত লড়াই, সবসময়'।

শুরু হয় বলিভিয়ার সামরিক সরকার উৎখাতে গেরিলা অভিযান। তার নেতৃত্বে অভিযানে একের পর এক সফল্যের মুখ দেখেন বিপ্লবীরা। এগিয়ে যেতে থাকেন চে গুয়েভারা। আন্দোলিত হয় সারা বিশ্ব। সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে তিনি পরিণত হন এক মুর্ত আতঙ্কে। ফলে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে দৃশ্যত: বিপ্লবের সমার্থক শব্দে পরিণ হন চে। এর পরই মাঝে তার অগ্রযাত্রায় ছন্দ পতন ঘটে।

১৯৬৭ সালে ৮ অক্টোবর আমেরিকার বংশবদ প্রতিক্রিয়াশীল বলিভিয়ান সামরিক বাহিনীর হাতে আহত তিনি। সে বছরের ৯ অক্টোবর ওয়াশিংটনের নির্দেশে সরাসরি গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় আজন্ম বৈপ্লবিক চে গুয়েভারাকে। তখন তিনি বলেছিলেন, 'আমি জানি তুমি আমাকে হত্যা করতে এসেছো, গুলি করো কাপুরুষ, তুমি শুধু একজন মানুষকেই হত্যা করবে (তার বিপ্লবী চেতনাকে নয়)। এরপর ব্যক্তি চের প্রস্থান ঘটলেও মৃত্যু ঘটেনি বিপ্লবী চে'র। আজো সারা বিশ্বের কাছে মুক্তিকামী মানুষের কাছে বৈপ্লবিক চেতনার নাম চে। সংগ্রামীদের বুকের মাঝেই তার বাস।

শোষিতের প্রতীক হয়ে তিনি বেঁচে আছেন আমাদের মাঝে; তার প্রতিকৃতি এখন সারা বিশ্ব।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত