আসাদুজ্জামান, ফ্রান্স

১৩ অক্টোবর, ২০১৫ ১৮:৩৭

ফিলিস্তিনি পরিবারের ৬৫ বছরের শরণার্থী জীবন, ঠাঁই মিলে না কোন দেশে

নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে নতুন জীবনের খোঁজে পরিবারটির পূর্বপুরুষদের ভাগ্যান্বেষণের শুরু সেই ১৯৪৮ সালে। সেখান থেকেই শুরু এই পরিবারটির গল্প।  ১৯৪৮ সালের আরব ইসরাইল যুদ্ধে ইসরাইল ফিলিস্তিনের অধিকাংশ ভূমি দখল করে নেয়।সেখানে বসবাসরত ফিলিস্তিনরা বিতাড়িত হয় নিজ ঘরবাড়ি থেকে।উৎখাত হয়ে সবাই ছুটতে থাকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে।    

সেই ঘটনাকে ইংরেজিতে "1948 Palestinian exodus” আরবিতে “nakba”  আর বাংলাতে বললে “১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনদের প্রস্থান” বলা যায়। সেই সময় ৭ লক্ষেরও অধিক ফিলিস্তিনি পরিবারকে তাঁদের নিজেদের বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। আজও তাঁরা পৃথিবীর নানা দেশে উদ্বাস্তু হয়ে জীবনযাপন করে চলেছেন। তাঁরা জানেন না এর শেষ কোথায় এবং কখন।

সেইসব বিতাড়িত পরিবারগুলো থেকে একটি পরিবার পাড়ি জমায় সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসে,সাথে একটি ছোট মেয়ে।সেখানে শুরু হয় উদ্বাস্তু হিসেবে তাঁদের নতুন জীবন। নিজ দেশে পরিবারটি ছিল একটি সচ্ছল পরিবার,কিন্তু বিতাড়িত হওয়ার পর তার প্রায় সবটুকুই পিছনে ফেলে আসতে হয়েছে।
 
সেই ছোট মেয়েটির বিয়ে হয় দামাস্কাসে নতুন জীবন শুরু করা আরেকটি মোটামুটি সচ্ছল পরিবারে,সেই পরিবারে ১৯৬৮ সালে ঘর আলো করে জন্ম নেয় একটি মেয়ে সন্তান। বাবা,মা আদর করে নাম রাখেন বাসিলা। জন্মের পর থেকে সেখানেই একটু একটু করে বেড়ে উঠা। লেখাপড়া শেষ করে একটি স্কুলে গণিতের শিক্ষক হিসেবে চাকুরীতে যোগদান।সেখানে একজনের সাথে পরিচয়,মন দেয়ানেয়া তারপর ১৯৯১ সালে পারিবারিক ভাবে বিয়ে। বিয়ের পর স্বামীর সাথে ১৯৯১ সালে সিরিয়ার বিখ্যাত ফিলিস্তিনি বসবাসকারী ক্যাম্প 'ক্যাম্প ইয়ারমুক' চলে আসা।

ক্যাম্পের গিঞ্জি পরিবেশ,রাস্তাতে সবসময় লেগে থাকা বাচ্চাদের চিৎকার চেঁচামেচি,পরিবেশগত কারণে লেগে থাকা নানা সমস্যা থাকার পরও শান্তি ছিল একটাই,নিজ দেশের মানুষের সাথে বসবাস করতে পারার আনন্দ।সবার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা সহজতর।এসব কারণে তাঁদের দামাস্কাস ছেড়ে ক্যাম্প ইয়ারমুকে চলে আসা।ক্যাম্পে চলে আসার পর তাঁদেরকে দেয়া হয় ৩২ বর্গমিটারের একটি ঘর।ক্যাম্পে বসবাসকারী সবাইকেই বসবাসের জন্য প্রায় একই ধরনের ঘর দেয়া হয়। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভাল,ক্যাম্পটি জাতিসংঘের রক্ষণাবেক্ষণে চলে।

১৯৯৩ সালে বাসিলার ঘর আলো করে জন্ম নেয় তাঁদের প্রথম সন্তান 'কারাম'। ১৯৯৮ সালে পুনরায় ৩২ বর্গমিটারের ঘর আর বাসিলার কোল আলোকিত করে জন্ম নেয় তাঁদের দ্বিতীয় সন্তান ‘বাইসো'। ২ সন্তান সহ মোট চারজনের বসবাসের জন্য ৩২ মিটারের ঘর যথেষ্ট ছিল না।দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের পর তাঁরা দামাস্কাসে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেন কিন্তু নানা পারিপার্শ্বিক কারণে তা সম্ভব হয়নি।ছেলেমেয়ে দুজনকে ক্যাম্পের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়।

জাতিসংঘের  রক্ষণাবেক্ষণে স্কুলের লেখাপড়ার পরিবেশ ভাল ছিল। সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় ক্যাম্পের সামাজিক পরিবেশ।একটা ঘরের সাথে আরেকটি ঘর মিলে ঘিঞ্জি পরিবেশ,রাস্তায় অনবরত চেঁচামেচি।সামান্য বিষয় নিয়ে একজনের সাথে আরেকজনের ঝগড়া এসব ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী।ছেলেমেয়ে সহ এই পরিবেশে মানিয়ে নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল। এর মধ্যে শুরু হয় পারিবারিক অশান্তি,স্বামীর সাথে মতের অমিল। ততদিনে স্বামী ব্যবসা শুরু করে বেশ সাফল্য পেয়েছেন। অবশেষে ২০১০ সালে বিবাহ বিচ্ছেদ,মিলে মানসিক প্রশান্তি। বিচ্ছেদের পরও স্বামী সন্তানদের ভরন পোষণের খরচ দিতেন।স্বামীর ব্যবসার অবস্থাও বেশ ভাল যাচ্ছিল সময়।

২০১১ সাল, চারিদিকে আরব বসন্তের হাওয়া বইছে। সিরিয়ায়ও শুরু হয় আন্দোলন প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে।একদিকে সরকারি দমন পীড়ন,অন্যদিকে আন্দোলনকারী।অবস্থা ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। শুরু হয় তরুণ ছেলে মেয়েদের অপহরণ করা।মোটামুটি সচ্ছল পরিবারের তরুণ ছেলে মেয়েদের অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি বা মেরে ফেলা।বাসিলা দুটি ছেলে মেয়েকে নিয়ে পড়েন মহা দুশ্চিন্তায়। বিশেষ করে মেয়েকে নিয়ে গেলে ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম সাথে ছেলেকে নিয়ে চিন্তা। কিছুদিন চেষ্টার পর ২০১১ এর ডিসেম্বরে ছেলেকে রাশিয়া পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হন।এখন মেয়েকে নিয়ে চিন্তা,এভাবে দুশ্চিন্তায় আর সতর্কতার মধ্যে তাঁদের দিন যেতে থাকে। অবশেষে ২০১২ এর সেপ্টেম্বরে মেয়েকে নিয়ে ইজিপ্ট চলে আসতে সক্ষম হন।

মেয়েকে সেখানে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন।এদিকে মেয়ে স্কুল থেকে এসে কান্নাকাটি করে,মাথায় কাপড় না দিয়ে বা হাতকাটা জামা পড়ে বের হলে রাস্তায় অনেকেই বাজে মন্তব্য করে,খারাপ ইঙ্গিত করে।মেয়ে কিছুতেই খাপ খাওয়াতে পারছিলনা এই অবস্থায়।এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর ফ্রান্সে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন।ফ্রান্সে এক ভাই ছিলেন,উনার সাথে যোগাযোগ করে ফ্রান্স মন্ত্রণালয়ে আবেদন জমা করেন।আবেদন গৃহীত হয়।অবশেষে ৯ মাস ইজিপ্ট অবস্থান করে ২০১৩ সালের জুন মাসে ফ্রান্সে প্রবেশ করেন।তার কিছুদিন পর ছেলেকেও রাশিয়া থেকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন।সেই থেকে এখানে শরণার্থী হিসেবে বসবাস করছেন।

শেষের দিকের কিছু কথা তাঁর মুখের ভাষায়ই বলার চেষ্টা করলাম: আমার বাবা,মা অন্তত নিজ দেশে কিছুদিন বসবাস করতে পেরেছিলেন।কিন্তু আমার পক্ষে তা সম্ভবপর হয়নি।সিরিয়াতে আমার জন্ম,বেড়ে উঠা সবই কিন্তু কখনও আমাকে ভোট দেয়ার অধিকার দেয়া হয়নি।সোজা কথায় বললে,নিজেকে সিরিয়ান নাগরিক বলা সম্ভব হয়নি।সিরিয়া ছিলাম,ইজিপ্ট ছিলাম এখন ফ্রান্সে আছি কিন্তু পরিচয় কিন্তু সেই একই,দেশহীন শরণার্থী!

পূর্বের সিরিয়ার অবস্থা আর বর্তমান অবস্থা চিন্তা করলে নিজেকে কিছুটা ভাগ্যবান একজন মনে হয়।সিরিয়া যখন ছাড়ি তখন অন্তত সেখানে আইএস ছিল না বা থাকলেও এত ক্ষমতা ছিল না তাদের।বর্তমানে একদিকে বাশার আল আসাদ অন্যদিকে আইএস এর খড়গ সাধারণ মানুষদের পিষ্ট করছে। বর্তমানে নিজের এবং পরিবারের জীবন রক্ষার্থে মানুষ জীবনকে তুচ্ছ করে সাগরে নেমে যাচ্ছে,অকাতরে প্রাণ হারাচ্ছে,দেখলে সহ্য হয়না।মৃত্যুর পূর্বেও যদি কখনও নিজ দেশ ফিলিস্তিনে ফিরে যেতে পারি অন্তত তৃপ্তির সাথে মৃত্যুবরণ করতে পারব। ছেলেমেয়ে দুজনই বলল,সম্ভব হলে অবশ্যই ফিলিস্তিন ফিরে যাবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত