প্রত্যুষ তালুকদার

১৯ অক্টোবর, ২০২৩ ১০:৫০

অকৃত্রিম স্থাপত্য শৈলী আর প্রকৃতির রহস্যময়তায় আবৃত গোলকুন্ডা দুর্গ

ভারতের ‘সিটি অব পার্লস’ নামে পরিচিত শহর হায়দরাবাদ। স্রোতস্বিনী নদী মুসির তীরে অবস্থিত অবস্থিত দক্ষিণ ভারতের তেলেঙ্গনা রাজ্যর রাজধানী। মুঘল সাম্রাজ্যর পূর্বেই ১৫৯১ খ্রিষ্টাব্দে কুতুব শাহী রাজ বংশের পঞ্চম শাসক মুহম্মদ কুলি কুতুব শাহের হাতে ইতিহাস বিখ্যাত এই শহরটির গোড়াপত্তন।

হায়দরবাদের গোলকুন্ডা দুর্গ শহরের ১১ কিলোমিটার দূরে প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্যের ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা এক নির্দশন। জানা যায়, দরিয়া-ই-নূর আর কোহিনূর হিরার সন্ধান মিলেছিল এ অঞ্চলে। মহামূল্যের হিরার সন্ধানের ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে অকৃত্রিম স্থাপত্য শৈলীর কথাই মনে আসে, চোখে ভাসে। হাজার বছরের পুরনো স্থাপনায় লেগে থাকা শাহি শাসনামলের ঐতিহ্য আর প্রকৃতির রহস্যময়তায় আবৃত এক অনাবিল সৌন্দর্য।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে বাংলাদেশ থেকে আসা আমাদের ২৮ সদস্যদের সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের প্রতি সদস্যের অবাক চাহনি ঘুরছিল তখন এদিক-ওদিক, মনটা তখন অনেকেরই ফিরেছিল অদেখা-অজানা সেই কালে। সময়ের ঘড়ি তখন সন্ধ্যায় পৌঁছেছে। আমরা চলছি, সঙ্গে দুর্গের গাইড শেখ। তিনি বলছিলেন, আমাদের কান খাড়া; মন্ত্রমুগ্ধ আমরা!

দুর্গে ঢুকলাম আমরা। ফটক পেরিয়েই চোখে পড়ে দুটো দরজা। যার একটি ছিল বাদশার, যেখান দিয়ে তারা হাতিঘোড়া নিয়ে ঢুকতেন, অন্যটি অন্যদের।

আমাদের গাইড শেখ দাঁড়িয়ে পড়লেন, সঙ্গে আমরাও। কাউকে কিছু বুঝতে দেওয়ার আগেই দিলেন করজোড়ে তালি। মুহূর্তেই সেই তালি ধ্বনি-প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসল ফের কানে। এ যেন অতিমানবীয় অনুভূতি। জানা গেল, সেই আমলে শত্রুপক্ষের আগমণের জানান দিতে এভাবেই তালি দিয়ে সিপাহিদের সতর্ক ও প্রস্তুত করা হতো।

গোলকুন্ডার ইতিহাস নিয়ে নানা মত আছে। এই দুর্গের প্রথমে নাম ছিল মাটফোর্ট। স্থানীয় ভাষায় বলা হতো গোল্লাকুন্ড, যার মাঝে গোল্লা অর্থ গোলাকার ও কুন্ড অর্থ পাহাড়।

সুলতান কুতব শাহ এই দুর্গ নির্মাণ শুরু করেন যা সম্পন্ন হতে সময় লেগেছিল প্রায় ৬২ বছর। সুলতান অবশ্য তার জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারেননি এই দুর্গ। দুর্গ নির্মাণে ইট, বালি, সুরকির সঙ্গে মেশানো হয়েছিল ওড়ুত অর্থাৎ অড়হর ডাল, যাতে শক্তিশালী হয় দুর্গের প্রাচীর; মোকাবিলা করতে পারে শত্রুপক্ষের আক্রমণ।

দুর্গের আঁকাবাঁকা পথ ধরে আমরা এগিয়ে যাই। মোহাবিষ্ট হয়ে শুনি গাইডের কথা। প্রাচীন স্থাপত্য শৈলীর অপূর্ব নিদর্শন আর ইতিহাস শ্রবণে জন্মায় জানায় আগ্রহ। দেখা মেলে চৌকোনা দুটি ঘরের, যাতে নেই কোনো দরজা জানালা- আছে শুধু চারকোনায় চারটি পেরেক। গাইড জানান, এই পেরেকে ভারী পর্দা টাঙিয়ে আলাদা করা হতো দুটো ঘরকে। এখানে বসতেন বাদশাহর হিসাবরক্ষক দুই ভাই মান্দানা ও আকান্না।

গল্পে গল্প বাড়ে, তবে আমাদের মনে উঁকি দিচ্ছিল কোহিনূর হিরার খোঁজ।

জানা যায় গোলকুন্ডার অদূরে বিজয়বরা কুত্তুর গ্রামের এক বয়স্ক নারী পেয়েছিলেন কোহিনূর হিরা। হিরাটি বাদশাহকে উপহার দিয়েছিলেন সেই নারী। এরপর এই কোহিনুর হিরার জায়গা হয় গোলকুন্ডার নাগিনা গার্ডেনে। এরপর বহুবার বহিঃশত্রুর আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে গোলকুন্ডা আর লুট হয়েছে কোহিনুর হিরা।

শুরুতে বলেছিলাম, তালি প্রসঙ্গে। নাতিদীর্ঘ নিবন্ধের শেষের দিকেও এসে ফিরে যাই সেই তালি-প্রসঙ্গে। গোলকুন্ডা দুর্গের স্থাপত্যকলার উল্লেখযোগ্য একটি হলো ফতেহ দরওয়াজা বা বিজয় তোরণ। এ বিজয় তোরণ দিয়েই দীর্ঘ নয় মাসের অপেক্ষা শেষে আওরঙ্গজেব বিজয়ীর বেশে দুর্গে প্রবেশ করেছিলেন বলে এর নাম বিজয় তোরণ। গোলকুন্ডা দুর্গটির উঁচু খিলানওয়ালা ফতেহ দরওয়াজা দিয়ে প্রবেশ করেই খিলানের নিচে একটি বিশেষ জায়গায় দাঁড়িয়ে দু’হাত দিয়ে তালি বাজালে দুর্গের সর্বোচ্চ চূড়ায় ১ কিলোমিটার ওপরে নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিও তা স্পষ্ট শুনতে পান। এ তালির আওয়াজ, তোরণের আশপাশের কোনোও স্থাপনা থেকে শোনা যায় না। এর উদ্দেশ্য ছিল দুর্গের ফটকে কোনো আগন্তুকের আগমনের বার্তা সঙ্গে সঙ্গে ওপরে থাকা রাজকীয় ব্যক্তিবর্গের কানে পৌঁছে দেওয়া।

এখন তথ্যপ্রযুক্তির যুগ, তবু এই যুগেও তালি বাজানো এই প্রক্রিয়াটি পর্যটকদের ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। আমরাও আকৃষ্ট হই, আলোড়িত হই। গাইডের বাজানো তালিতে নিজেদের আবিস্কার করি সেই যুগে, যখন বিজ্ঞানের আলোচনা এমন ছিল না, তবে ছিল সেই ব্যবহার; জানা-অজানায়!

আপনার মন্তব্য

আলোচিত