২৫ মে, ২০২৪ ১৪:০১
ফুটবলের ইতিহাস হাজার বছরের পুরানো। সময়ের সাথে সাথে ফুটবল সারাবিশ্বের সবচাইতে জনপ্রিয় খেলায় পরিণত হয়েছে। ফুটবল খেলে এমন দেশের ব্যাপ্তি জাতিসংঘের চাইতেও বিশাল। এবার জাতিরাষ্ট্র সমূহের সংগঠন জাতিসংঘ প্রথমবারের মতো বিশ্ব ‘ফুটবল দিবস’ পালনের ঘোষণা দিয়েছে। প্রতি বছর ২৫ মে সারাবিশ্বে বিশ্ব ‘ফুটবল দিবস’ পালিত হবে।
১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আয়োজনে ফুটবল ইভেন্টে বিশ্বের সবগুলো অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব ছিল। সে আয়োজনের তারিখ ছিল ২৫ মে। এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বিশ্ব ফুটবল দিবসের জন্য সেই ঐতিহাসিক দিনটিকেই বেছে নিয়েছে। প্রথমবারের মতো উদযাপিত হতে যাওয়া বিশ্ব ফুটবল দিবসকে বাংলাদেশের ফুটপ্রেমীদের কাছে স্মরণীয় করে রাখতে এই নিবন্ধ।
নিছক বিনোদনের উপলক্ষ থেকে সময়ের সাথে সাথে ফুটবল অবস্থান করে নিয়েছে সবার মাঝে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইংল্যান্ডে খেলাটার বর্তমান রূপের দেখা মিললেও ফুটবলের ইতিহাস তিন হাজার বছরের। সেখান থেকে নানা ধাপ, পরিবর্তন এবং সংযোজন পেরিয়ে এসে হালের ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ফুটবল খেলা। অপেশাদার থেকে পেশাদার, পুরষ্কারবিহীন থেকে সোনার ট্রফি কিংবা হাতেগোনা দর্শক থেকে বিলিয়ন দর্শক; ফুটবল এই গ্রহের সবচাইতে জনপ্রিয় এবং দর্শকনন্দিত খেলা।
সেই খেলা ধীরে ধীরে মানুষের মানসপটে জায়গা করে নেওয়ার পাশাপাশি মানুষের মাঝে ছড়িয়েছে মানুষের প্রতি মানুষ হিসেবে দায়িত্ববোধ। সেখানে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি বিকাশের পাশাপাশি বিকশিত হয়েছে মানবতা। ফুটবল ও ফুটবলাররা খেলাটার মাধ্যমে বারতা দিতে সচেষ্ট হয়েছে। ফুটবলের যে অপরিসীম শক্তি তা ব্যবহার করে দূর করতে চেয়েছে অনাচার ও নিপীড়ন। কালক্রমে ফুটবল আর নিছক গোলের খেলা কিংবা বিনোদনের উপলক্ষ ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং দেখিয়েছে ফুটবল হলো মোর দ্যান অ্যা গেইম। ফুটবলকে যারা মোর দ্যান অ্যা গেইম হিসেবে পরিণত করেছে সেইসব নক্ষত্রদের কতিপয় নিয়ে এই লেখাটা।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল
১৯৭১ সাল, মার্চ মাসের ২৫ তারিখ। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নেমে আসে ভয়াবহ বিপর্যয়। পাকিস্তানের পশ্চিম অংশ অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তান এখানে শুরু করে শতাব্দীর ভয়াবহ তাণ্ডবলীলা। পঁচিশে মার্চের ভয়াল কালরাতে শুরু করে দেয় নির্মম হত্যাকাণ্ড। এক রাতেই ঢাকাসহ সারাদেশে তাদের হাতে মারা যায় লক্ষ লক্ষ বাঙালি। গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই স্বাধিকার আন্দোলনের পুরোধা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দেন স্বাধীনতার। শুরু হয় মুক্তির লড়াই, স্বাধীনতার লড়াই। সেই লড়াইয়ে শামিল হয় দেশের মানুষ। সেই লড়াইয়ে শামিল হয় ফুটবলাররা। দেশের জন্য লড়াইয়ের তাড়নায় ফুটবলাররা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারত পৌঁছে আর গঠন করে ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’।
১৯৭১ সালের জুন মাসে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠিত হয় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের স্বাক্ষরিত চিঠির মাধ্যমে। কয়েকজনকে চিঠি দিয়ে মুজিবনগরে যাওয়ার জন্য বলা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলামের চিঠি নিয়ে মুজিবনগরে পৌঁছান শঙ্কর হাজরা, শেখ আশরাফ আলী, সাইদুর রহমান প্যাটেল, আলী ইমামসহ আরও অনেকে। সেখান থেকে ৩১ জনকে নিয়ে গঠন করা হয় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। যারা ফুটবলের মাধ্যমে মুক্তির লড়াইয়ে শামিল করবে অগণিত মানুষকে। যারা ফুটবল খেলে ফান্ড সংগ্রহ করবে স্বাধীনতার জন্য লড়া বাঙালিদের জন্য। আর ফুটবল ও জীবন একাকার হয়ে যেন মানুষের কথা বলে সেটা প্রচার করবে। জাকারিয়া পিন্টুর নেতৃত্বে সেই দলের ম্যানেজার ছিলেন তানভীর মাজহার তান্না আর কোচের দায়িত্বে ছিলেন ননী বসাক।
২৩ জুলাই মুজিবনগর থেকে নদীয়ায় পৌঁছে এবং ২৫ জুলাই কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে নদিয়া একাদশের বিপক্ষে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল প্রথম ম্যাচ খেলতে নামে। খেলা শুরুর আগে জাতীয় সংগীতের সাথে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে মাঠ প্রদক্ষিণ করেন খেলোয়াড়রা। খেলা ২-২ গোলে ড্র হয়। এইরকম আরও ১৬টা ম্যাচ খেলে পিন্টু, সালাউদ্দিন, শাহজাহানরা জানিয়ে দিয়েছিল জীবনের যুদ্ধে ফুটবলও একটা অংশ। ম্যাচগুলো থেকে ৫ লক্ষ টাকার মত ফান্ড সংগ্রহ হয়েছিল, যা যুদ্ধকালীন খাতে জমা দেওয়া হয়েছিল। সারা ভারতের নানা অলিগলিতে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের জয়গান পৌঁছে গিয়েছিল। ফুটবলের মাঠ, ফুটবলের একেকটা শট হয়েছিল গোলা আর বারুদে ঠাঁসা স্বাধীনতার অব্যক্ত কথামালা। ভারতের বিপুল সমর্থনে বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতির তত্ত্বাবধানে ম্যাচগুলো স্বাধীনতার কথা ছড়িয়ে দিয়েছিল আর বিখ্যাত আনন্দবাজার স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলকে ‘মুজিব বাহিনী’ বলে উল্লেখ করেছিল।
শুধু যুদ্ধকালীন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ব্যস্ত ছিল না। বরং যুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীনতা অর্জনের পরেও তারা ফুটবল চাঙ্গা করতে ম্যাচ খেলেছিল। ফুটবল আর ফুটবলাররা এভাবেই মানুষের মানসপটে স্থান করে নিয়েছে যুগে যুগে। মাঠে কারিকুরি দেখাতে অভ্যস্ত অনেকেই ফুটবলকে পাথেয় করেছে জীবনে। জীবনের যাপনকে চির সংগ্রামী করে রাখতে, মানুষের জন্য মানুষ হিসেবে নিজের লড়াই জারি রাখতে অনন্য নজির রেখেছেন অনেক ফুটবলার। জাকারিয়া পিন্টুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ১৯৭১ সালে একটা জাতির ঊষালগ্নে ঠিক সেভাবেই স্মরণীয় করে রেখেছিল, যেভাবে স্মরণ করে রাখা যায়। ফুটবলের মাধ্যমে মানবতার জয়গান গাওয়া সেইসব বীর ফুটবলারদের নমি। যারা দেশ থেকে বিদেশে ছড়িয়ে দিয়েছিল একটা ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধের আখ্যান। যারা ফুটবলকে উপজীব্য করে সারাবিশ্বকে জানিয়েছিল বাঙালিদের সাথে ঘটা জেনোসাইডের কথা। তারা প্রমাণ করেছে ফুটবল আলাদা কিছুই নয়। ফুটবল মানুষের জন্য।মানুষের মুক্তির জন্য। লড়াইয়ে ও সংগ্রামে ফুটবল ও ফুটবলাররাও অংশীদার।
বব মার্লে
ফুটবল নিছক গোলের খেলাতে সীমাবদ্ধ নেই। সময়ের সাথে সাথে একেকটা পাস, কিপারের সেইভ, রক্ষণের ট্যাকল আর সাফল্য-ব্যর্থতার সাথে জড়িয়ে গেছে নানা সমীকরণ। নানা অংশ আর অংশের শেষে হাসি-কান্না। ফুটবলের হার-জিতের সাথে আমাদের যাপিত জীবনের নানা ঘটনা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। মুক্তিকামী মানুষ, নিষ্পেষিত মানুষ, বঞ্চিত মানুষ ফুটবলেও খুঁজে নিয়েছে নিজেদের অব্যক্ত কথামালা। যা বলতে পারছে না, যা বুঝাতে পারছে না কিংবা মনের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ থেকে যারা তাদের বঞ্চিত রেখেছে তাদের বিরুদ্ধে ফুটবলের মাঠ, গ্যালারি হয়ে গেছে একেকটা জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। যেখান থেকে দ্রোহের কাব্য রচিত হয় সেখান থেকে বিপ্লবের অগ্নিফুল ফোটে।
বিশ্ব সংগীতের অন্যতম পুরোধা বব মার্লে। ফুটবল আর গানের সুতো একত্রিত করে বব মার্লে নাটাই বেঁধেছিলেন শান্তির সুবাতাস বইয়ে দেওয়ার জন্য। ববের কাছে ফুটবল ছিল নিপীড়িত ও নিষ্পেষিত মানুষের স্বাধীনতার জায়গা। মাঠে নেমে ফুটবলে কিক দেওয়ার মাঝে বব মার্লে খুঁজে নিয়েছিলেন নিজের অপ্রকাশিত সব কথামালা। ববের ভাষায়-'আমি মুক্তি চাই, ফুটবল মানে হলো মুক্তি'। বব মার্লের ফুটবলের সাথে সখ্যতার আগে গানের সাথে সখ্যতা হয়েছিল। কিন্তু গানের সাথে সমানতালে চলেছে ফুটবল। যেখানে যেতেন সেখানে কোন না কোনভাবে ফুটবল খেলার একটা ব্যবস্থা থাকতো। ট্যুর ম্যানেজার হিসেবে যাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন সেও ফুটবলার। অর্থাৎ বব মার্লের ফুটবল-প্রীতি চমক জাগানিয়া।
বব মার্লে ফুটবল খেলতেন। সিরিয়াস ফুটবলের সংজ্ঞায় হয়তোবা বব মার্লেকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু ফুটবল মাঠে ববের অবিশ্বাস্য সব