২৫ অক্টোবর, ২০২৫ ০০:১৭
থাইল্যান্ডের ‘ডেথ রেলওয়ে’র নাম শুনেছেন? পাহাড়ে ঘেরা সবুজ প্রকৃতির বুক চিরে এগিয়ে গেছে এই রেলপথ। এই রেলপথের সৌন্দর্য আর ইতিহাস পুরোপুরি বিপরীত।
প্রতি বছর এই রেলওয়ে দেখার পর্যটকেরা ভিড় জমান। ৪১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেল পথ তৈরির সময় প্রতি কিলোমিটারের জন্য প্রায় ২৯ জন মানুষ তাদের জীবন খুইয়েছিলেন। আর সেজন্য ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত এই রেলপথ।
দীর্ঘ এই পথটি মাত্র এক বছরের মধ্যে তৈরি করে জাপান সরকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নির্মিত রেলপথটি ব্যাংকক থেকে মিয়ানমার (তৎকালীন বার্মা) সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে।
থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত রাতচাবুরির নং প্লাডুক জংশন স্টেশন থেকে শুরু হয়েছে ডেথ রেলওয়েটি।
দুইটি কারণে জাপানিদের জন্য বার্মা তখন গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। জাপান চীন ও ভারতের কিছু অংশ অধিগ্রহণ করার পথ খুঁজছিলো। এজন্যই দেশটি মূলত বার্মার দিকে হাত বাড়িয়েছিলো। তারা স্থলপথে সহজ যোগাযোগের উপায় খুঁজছিলো। কেননা মিত্রশক্তির আক্রমণের কারণে সমুদ্রপথে পণ্য পাঠানো বিপজ্জনক ছিল। পানি পথে জাহাজগুলোকে প্রায় ৩২০০ কিলোমিটার ঘুরে বার্মা পৌঁছোতে হত। জলপথ এড়াতে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক থেকে বর্মার রেঙ্গুন (ইয়াঙ্গুন) পর্যন্ত একটি রেলপথ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় জাপান।
১৯৪২ সালের শেষের দিকে সিঙ্গাপুর, হংকং, ফিলিপাইন এবং ডাচ অধিকৃত ইস্ট ইন্ডিয়ার মিত্রশক্তির শক্তিশালী ঘাঁটিগুলি জাপানের হাতে পরাভূত হয়। আনুমানিক ১ লাখ ৪০ হাজার মিত্রশক্তির যুদ্ধবন্দি জাপানিদের হাতে ধরা পড়ে ওই যুদ্ধে। এ ছাড়াও, প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার নাগরিক, যার মধ্যে প্রায় ৪০ হাজার শিশুকেও বন্দি করেছিলো জাপান। মিত্রবাহিনীর যুদ্ধবন্দিদের সিংহভাগই ছিল কমনওয়েলথ দেশগুলোর।
বন্দিদের মধ্যে প্রায় ২২ হাজার অস্ট্রেলীয়, ৫০ হাজারেরও বেশি ব্রিটিশ সেনা এবং কমপক্ষে ২৫,০০০ ভারতীয় সেনা ছিলেন। এদেরই যুদ্ধবন্দি করে জাপান।
জাপানিরা ৬০ হাজারেরও বেশি মিত্রশক্তির যুদ্ধবন্দিকে বার্মা রেলওয়ে নির্মাণের কাজে লাগিয়েছিল। ১৯৪২ সালের জুন থেকে ১৯৪৩ সালের অক্টোবরের মধ্যে থাইল্যান্ডের বান পং থেকে বর্মার থানবিউজায়াত পর্যন্ত প্রায় ৪১৯ কিমি রেলপথ তৈরি করেছিল জাপান।
জানা যায় যে, রেলপথ নির্মাণ চলাকালে প্রতিদিন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। যুদ্ধবন্দিদের কঠোর পরিশ্রম করানো এবং শারীরিক নির্যাতন তো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ছিল। এসব বন্দিরা খাবারের কষ্টে ছিলেন।অর্ধাহার ও অনাহারে বহু বন্দি মারা যান।
প্রতি দিনের খাবারের তালিকায় থাকত অল্প পরিমাণে সেদ্ধ ভাত এবং নষ্ট হয়ে যাওয়া মাংস বা মাছ। কখনও কখনও সেই খাবারেও মেশানো হত ইঁদুরের বিষ্ঠা ও পোকামাকড়। পান করার জন্য পর্যাপ্ত পানি পর্যন্ত মিলত না বন্দিদের। বন্দিরা অপুষ্টি, পানিশূন্যতার কারণে ঘন ঘন অসুস্থ হয়ে পড়তে শুরু করেন। চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা করেননি জাপানিরা।
বন্দিশিবিরের অস্বাস্থ্যকর অবস্থা এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় পরিবেশের কারণে নানা রোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। রেলপথ নির্মাণে নিযুক্ত বন্দিদের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশির মৃত্যুর জন্য অমাশয় এবং ডায়রিয়ায় ভুগে। এ ছাড়াও বন্দিরা কলেরা, ম্যালেরিয়া এবং আলসারে ভুগতে শুরু করেছিলেন। সীমিত উপকরণ ও ওষুধের অপ্রতুলতার কারণে অসুস্থদের চিকিৎসা করাও কঠিন ছিল।
জাপানিরা চেয়েছিল রেলপথটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চালু করতে। কিন্তু ঘন জঙ্গল ও অসমতল পাথুরে জমিকে সমান করে রেলপথ বসানো ছাড়া ওই কাজ করা সম্ভব ছিলো না। পরে বন্দিরা হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে রেলপথের জন্য জমি সমতল করে।
নদী এবং গিরিখাতগুলোতে সেতুনির্মাণ করতে হয়েছিল। পাহাড়ের কিছু অংশ কেটে ন্যারো গেজ ট্র্যাকটি বসানোর জন্য সোজা এবং সমতল মাটি তৈরি করতে হয়েছিল।
জাপানি কৌশল এবং যুদ্ধবন্দি শ্রমিকদের উল্লেখযোগ্য সাফল্য সত্ত্বেও বার্মা রেলওয়ের কাজের গতি নির্ধারিত সময়ের চেয়ে পিছিয়ে যায়। ১৯৪৩ সালের জুলাই থেকে অক্টোবরের মধ্যে ‘স্পিডো’ নামের একটি কুখ্যাত নিয়ম চালু হয়। একেতো অনাহারে, অর্ধাহারে থাকতেন বন্দিরা, অন্যদিকে তারা ছিলেন অসুস্থ। ওই অবস্থায় দৈনিক ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হত শ্রমিকদের। না পারলে চলত অকথ্য অত্যাচার। এই সময়কালে শ্রমিকদের অবস্থার আরও দ্রুত অবনতি ঘটে।
জাপানিরা মিত্রবাহিনীর বন্দিদের কাজের গতিতে সন্তুষ্ট ছিল না। এর ফলে বন্দিদের নৃশংস শারীরিক অত্যাচার সহ্য করতে হত। জানা যায় ‘হেলফায়ার পাস’ নামের একটি অংশ তৈরি করতে প্রায় ৭০০ বন্দির মৃত্যু হয়েছিল।
হতাহতের হার তীব্র ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বন্দিদের দিকে জাপানি রক্ষীদের আক্রমণাত্মক ভাবে ‘স্পিডো! স্পিডো!’ বলে চিৎকার করতে শোনা যেত। আরও কঠোর শাস্তি দিয়ে দ্রুত কাজ করতে বাধ্য করা হত।
রেলপথ নির্মাণে কাজ করতে বাধ্য করা ৬০ হাজারেরও বেশি যুদ্ধবন্দির মধ্যে প্রায় ১২ হাজারেরও বেশি শ্রমিক মারা গিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। মিত্রবাহিনীও নির্মাণকাজ ব্যাহত করার জন্য বিমান হামলা চালায়। ফলে আরও হতাহতের ঘটনা ঘটে। যারা বেঁচে গিয়েছিলেন তাদের অনেকেই পরে জাপানের কারাগারে বন্দি হয়ে পড়েছিলেন দীর্ঘকাল। সেখানেও তাদের সঠিক চিকিৎসা মেলেনি।
আপনার মন্তব্য