রাজীব রাসেল

১৫ নভেম্বর, ২০১৬ ২১:২৫

বিশেষ চাঁদের আলোয় দেখা মহা রাসলীলা

দেখতে পাচ্ছেন সুধীজন? ওই, ওই যে বৃন্দাবন। যমুনার তীর। ধীরে ধীরে সাঁঝ নামছে যমুনা তীরে। পাখিরা কুলায় ফিরে যাচ্ছে। সাঁঝবেলায় গোপীরাও যমুনার জলে গা ধুয়ে তাদের ঘরে ফিরে গিয়েছে। এখন ঘরের কাজে ব্যস্ত তারা। যমুনার আশেপাশে জঙ্গল জুড়ে নেমে আসছে ঘন অন্ধকার। সেই ঘন অন্ধকার ফুঁড়ে একসময় আকাশে ওঠে চাঁদ। গোল থালার মতো বিশাল এক চাঁদ।

যমুনার তীর নয়, এখানে ঘটনাস্থল মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর। সেই যমুনা তীরের বৃন্দাবনের ঘটনাকে ঘিরে ঐতিহাসিকভাবে চলে আসা রাসলীলা উপভোগ করতে সোমবার (১৪ নভেম্বর) ১৭ জনের বড় একটা দল নিয়ে হাজির হই কমলগঞ্জের মাধবপুরে। সিলেট থেকে ট্রেনযোগে বিকেলের মধ্যে পৌঁছে যাই ভানুগাছ স্টেশনে। রেস্টহাউজে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সেখান থেকে সিএনজি অটোরিকশাযোগে মিনিট বিশেকের পথ পাড়ি দিতেই দেখা মেলে অজস্র মানুষের সারি। দল বেঁধে সবাই এক পথের পথিক। বুঝতে পারি, এটাই আমাদের কাঙ্ক্ষিত মাধবপুর মণিপুরি মণ্ডপ।

নিরাপত্তাকর্মীদের অনুরোধে আমাদের সিএনজি অটোরিকশা অনুষ্ঠানস্থল থেকে কিলোখানেক দুরেই আটকে যায়। আকাশে তখন বিশাল চাঁদ, যাকে বলা হয় 'সুপারমুন'। সেই বিশাল চাঁদের বিপুল আলোয় আমরা হাঁটতে থাকি গন্তব্যের দিকে। মণ্ডপে পৌঁছার আগেই পড়তে হয় অভাবনীয় এক 'মানব জ্যামে'। পথে হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশুদের ভিড়। ভিড় ঠেলে ফুটখানেক এগোতেও সময় লেগে যায় বেশ খানিকটা। দর্শনার্থীদের প্রচণ্ড ভিড় কোনোরকমে পার হয়ে অবশেষে পৌঁছে যাই মণ্ডপে।

পাশাপাশি ৩টি মণ্ডপে তখন চলছে রাসলীলা। সুসজ্জিত ১ম মণ্ডপের মূল কেন্দ্র ঘুরে নাচছে ছোট্র এক মণিপুরি শিশু। মণ্ডপের এক পাশে বসে গেয়ে চলেছেন মণিপুরি নারী শিল্পীরা। ঢোল, মৃদঙ্গ, বাঁশি, করতাল বাজিয়ে তাল দিচ্ছেন বাদক দল। মণিপুরি ভাষাজ্ঞানের অভাবে গানের কথা বুঝতে পারি না। তবে ধীর লয়ের নাচ আর আকুতিভরা কণ্ঠের গানের সাথে মণ্ডপ ঘিরে বসে থাকা মণিপুরি নারীদের কিছুক্ষণ পরপর চোখ মুছতে দেখে আন্দাজ করে নেই গানটি বিরহের।

স্থানীয় এক মণিপুরি বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, কৃষ্ণ রাধারাণীকে নিয়ে গভীর বনমধ্যে হারিয়ে যান। কৃষ্ণকে একা পেয়ে রাধারও বড় অহংকার হল। তিনি ভাবলেন, আমি তাহলে অন্য গোপীদের চাইতেও সৌভাগ্যবতী যে শ্যামকে একা পেলাম! শ্রীরাধিকা শ্যামকে বললেন, ‘ওগো শ্যাম, আমার প্রাণাধিক, এতখানি হেঁটে এসে আমি বড় ক্লান্ত। আমার পা আর চলছে না। দয়া করে আমাকে তোমার কাঁধে তুলে নাও।’ শ্যাম মুচকি হাসলেন। ‘এসো রাধে’ বলে রাধাকে কোলে তুলে নিলেন। কিন্তু এভাবে কিছুদূর যাওয়ার পর শ্যাম আবার অন্তর্হিত হলেন। আর্তনাদ করে উঠলেন রাধারাণী, ‘শ্যাম, শ্যাম, তুমি আমায় ফেলে কোথায় গেলে?’ রাধারাণী এ শোক সইতে পারলেন না। তখনি জ্ঞান হারালেন। সেই মূহুর্তে গোপীরা খুঁজতে খুঁজতে রাধাকে একা অচৈতন্য অবস্থায় পেয়ে অবাক হয়ে গেল। রাধার জ্ঞান ফিরলে তারা সকলে মিলে রোদন করতে করতে ফিরে গেলেন যমুনার তীরে। কৃষ্ণের ধ্যান করতে করতে তারা গাইতে লাগলেন গোপিকা গীত।

স্থানীয় মণিপুরিদের সঙ্গে আলাপ করে জেনে নেয়ার চেষ্টা করি রাসলীলার আদ্যোপান্ত। তাঁরা জানান, কার্তিক পূর্ণিমার তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় রসিক কৃষ্ণের এ রাসলীলা। ‘রাস’ শব্দটি এসেছে ‘রস’ থেকে। ‘রস’ মানে আনন্দ, দিব্য অনুভূতি, দিব্য প্রেম। ‘লীলা’ অর্থ নৃত্য। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের সঙ্গে লীলা করবেন। ‘চীরহরণের’ পর গোপীদের সঙ্গে তাঁর এই লীলা। গোপীরা অধীর অপেক্ষা করছে কবে তাদের ডাক আসবে তাদের প্রাণপ্রিয় সখা শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে।

এবার অন্য মণ্ডপের দিকে এগোই। সেখানেও একইভাবে চলছে বাদ্যযোগে সঙ্গীত। মণ্ডপ ঘিরে নাচছে একদল মণিপুরি শিশু। ধীর লয়ের নাচে কখনো কখনো বাদ্যের তালে বেড়ে যাচ্ছে গতি। রাধিকার সাজে সজ্জিত শিশুরা একের পর এক করে যাচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ বন্দনা।

রাত বাড়ার সাথে সাথে যেনো লোকসমাগমও ক্রমেই বাড়তে থাকে। তীব্র শীত ও কুয়াশা উপেক্ষা করে শিশু থেকে বৃদ্ধ হাজারো মানুষের সমাগম ঘটে রাসলীলায়। দেশের আনাচ-কানাচ থেকে রাসলীলার টানে ছুটে এসেছিলেন অনেকে। কেবল মণিপুরি সম্প্রদায়ের নয়, সকল ধর্মের মানুষের আনাগোনায় মুখর হয়ে ওঠে অনুষ্ঠানস্থল ও চারপাশ। একসময় সেখানে উপস্থিত হন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। সবার মাঝে বসে রাসলীলা উপভোগ করেন মন্ত্রী।

ঢাকা থেকে আসা এক দর্শনার্থী বলেন, নাম শুনেছি অনেক। তবে এবারই প্রথম রাসলীলা দেখতে এলাম। কেবল মণিপুরি ভাষা জানা না থাকায় গানের অনেক কথা বুঝতে পারিনি।

প্রতিবছরের মতো রাসলীলাকে কেন্দ্র করে এবারও মাধবপুরে বসেছিলো বিশাল এলাকাজুড়ে মেলা। মেলায় মণিপুরিদের তৈরি পোশাক, গামছা, হস্তশিল্প যেমন ছিলো, তেমনি ছিলো ছোট-বড় অসংখ্য খাবারের দোকান। ছিলো সার্কাস দেখানোর আয়োজন। দর্শনার্থীদের প্রয়োজনে আয়োজকরা রেখেছিলেন ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প।

সারারাত ধরে চলে রাসলীলার এই ঐতিহ্যবাহী আয়োজন। চমৎকার উপভোগ্য আর বর্নাঢ্য এ আয়োজনের মুগ্ধতা চোখে নিয়ে ভোরের দিকে ফিরে আসি রেস্ট হাউজে। সারারাত জেগে থেকেও আমাদের চোখে তখন ঘুম নেই, বরং লেগে আছে মুগ্ধতা ছড়ানো এক মহা রাসলীলা।

যারা যেতে চানঃ

মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুর নামক স্থানে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় মহা রাসলীলা। দিনব্যাপী আয়োজনের মূল অংশটি শুরু হয় মূলত রাতে, চলে ভোর পর্যন্ত। ট্রেনে আসলে নেমে যেতে হবে ভানুগাছ স্টেশনে। আর বাসে আসলে নামতে হবে শ্রীমঙ্গল। তারপর সিএনজি অটোরিকশা বা ব্যাটারিচালিত ইজি বাইকে চড়ে সহজেই চলে যেতে পারবেন মাধবপুর ও আদমপুরে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত