জুয়েল রাজ

১২ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:৫৫

নোরা শরীফ : বিলেতে বাঙালির প্রাণের স্বজন

২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনের সময় গণজাগরণ মঞ্চের ঢেউ এসে লাগে ব্রিটেনে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় বাস্তবায়নের দাবিতে উত্তাল লন্ডনের আলতাব আলী পার্ক, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাস ভবন ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের ফুটপাত কিংবা ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কিংবা টাফেলগার স্কয়ার, সেখানে বাঙালিদের সাথে প্রায় সবগুলো বিক্ষোভেই ভিনদেশি একজন নারী শরিক থাকতেন, হাতে প্ল্যাকার্ড চুপচাপ। আমি ও তাঁকে দেখেছি, কিন্তু কখনো কথা হয়নি।

যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মঈনউদ্দিনকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর দাবিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন চলছে, টেলিভিশনের নিউজের জন্য  মন্তব্য নেয়ার জন্য এদিক সেদিক খুঁজছি, প্ল্যাকার্ড হাতে দীর্ঘদেহী এক নারীকে গিয়ে ইংরেজিতেই প্রশ্ন করলাম, তুমি এখানে কি জন্য দাঁড়িয়েছ? আর তখনই ধাক্কাটা খাই। উনি আমার প্রশ্ন শুনে, মুচকী হেসে বাংলায় উত্তর দেয়া শুরু করলেন। এবং স্পষ্ট উচ্চারণে। আমি কোন রকম নিজেকে সামলে নিলাম।

নতুন প্রজন্মের যারা তাঁরা অনেকেই তাঁকে চিনতেন, অনেকে আবার চিনতেন না। অনেকেই চিনলেও জানতেন না বাঙালির প্রাণের মানুষটিকে। শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে সোচ্চার নয়, বাংলাদেশের জন্মের সমান ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে ছিলেন তিনি, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্যে ‘ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ পদকে ভূষিত ব্যারিস্টার নোরা শরীফ বঙ্গবন্ধুর ৬দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভুত্থান, স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনসহ শাহবাগ গণজাগরণ আন্দোলন পর্যন্ত প্রতিটি সংগ্রামেই ছিলেন বাঙালির সহযোদ্ধা। বাংলাদেশকে ভালবেসে, বাংলাদেশের মানুষকে ভালোবেসে যিনি বাংলাদেশকেই নিজের দেশ করেছিলেন।

জন্মসূত্রে নোরা ছিলেন একজন আইরিশ, জন্ম আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিনে। সম্ভ্রান্ত পরিবারেই তার জন্ম হয়েছিল। বাবা শ্যন এফ মারে (Sean F. Murray) আইরিশ কারেন্সি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। ৬ বোন, ৩ ভাইয়ের মধ্যে নোরা দ্বিতীয় ছিলেন। নোরা লিংগুইস্টিক্স-এ গ্র্যাজুয়েশন করেন ডাবলিন, তারপর কৃষি বিষয়ে কিছু একটা পড়তে গেলেন ফ্রান্সে। সেখান থেকে আসেন লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়তে। সেখানে পরিচয় ছাত্রনেতা সুলতান শরীফের সাথে। যিনি এখন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।  

নোরা শরীফের উপর নির্মিত একটি ডকুমেন্টারীতে নোরা শরীফ বাংলায় খুব চমৎকার ভাবে বলেছিলেন, কিভাবে সুলতান শরীফের সাথে তাঁর পরিচয় হল, বাংলাদেশী ছাত্রদের সাহায্যে তিনিও জড়িয়ে পড়েন। তাঁর গাড়িতে করে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত বা আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে তিনি নিয়ে যেতেন। স্মারক লিপি বা আবেদন ইত্যাদি তিনি বাংলা থেকে ইংরেজি করে দিতেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আইনজীবি পাঠাতেও পালন করেন অগ্রণী ভুমিকা।

১৯৬৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বিয়ে করেন সুলতান শরীফকে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ্বে যে কয়জন ভিনদেশী বাংলাদেশের পক্ষে জোরালো ভাবে কাজ করেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন নোরা শরীফ। বাঙালিদের আন্দোলন সংগ্রামের যত প্লাকার্ড, ফেস্টুন একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় বহনের দায়িত্ব সব তিনি পালন করেন, পাশাপাশি  কাগজ পত্র ইংরেজি করার কাজ তো ছিলই। এখানেই থেমে থাকেন নি ব্যারিষ্টার নোরা শরীফ। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পরে পরিচর্যার দায়িত্বও নিতে চেয়েছিলেন তিনি। তাইতো ৭২-৭৪-এ,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের একজন শিক্ষক হিসেবে; একেবারে পুরোপুরি একজন বাঙালি নারী হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশে নোরা তিন বছর কাটিয়েছেন। সেই সময়ের নানা অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষের আতিথেয়তা, দেশকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা তাঁর ভাল লেগেছিল। নিজে ঘুরে ঘুরে তিনি  খরচাপাতি করতেন, বিদেশী দেখে দোকানদাররা নাকী বেশী দাম চাইত, আবার বাংলা কথা শুনে অবাকও  হতো। শেষের  দিকে দামের ঝামেলা থেকে বাঁচতে তিনি ঘুরেফিরে জিনিস পছন্দ করে আসতেন। তাঁর দেবরকে দিয়ে পরে কিনিয়ে নিতেন।
 
ভাল না লাগার শুধু একটা বিষয় উল্লেখ করেছিলেন নোরা শরীফ, কেউ তাঁকে নাম ধরে ডাকত না, কেউ রেজিয়ার আম্মা , কেউ ভাবি, কেউ সুলতানের বউ হিসাবে সম্বোধন করত তাঁকে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশে আর ফিরে যাননি নোরা।

নোরা শরীফ শুধু বাংলা ভাষা নয় কথা বলতে পারতেন, ল্যাটিন, আইরিশ, ইংরেজি ইটালীয়ান  ফ্রেঞ্চ ভাষায়ও। বাঙালিদের সাথে সবসময় তিনি বাংলাতেই কথা বলতেন। বাসায় রান্না করতেন বাঙালি খাবার। আন্দোলন সংগ্রামে, বা বাংলাদেশ থেকে কেউ আসলে আশ্রয় দিতেন নিজের বাসায়। মুক্তিযুদ্ধ পরে ও বিলেতের আন্দোলন সংগ্রামে যারা তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তাঁর বাসা থেকে না খেয়ে আসতে পারেন নি। মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত তিনি কাজ করে গেছেন বাংলাদেশের জন্য। স্বামী সুলতান শরীফ ছিলেন ফুলটাইম রাজনীতিবিদ এবং এখনো আছেন । আর সেটা সম্ভব হয়েছে নোরা শরীফের জন্য।

বাংলাদেশের জন্য স্বামীকে তিনি এক ধরণের উৎসর্গ করেছিলেন বলা যায়। দুই সন্তান  রাজিয়া, ফওজিয়া- দুজনকেই মানুষ করেছেন তিনি। নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে তাঁরা প্রতিষ্ঠিত।
২০১২-এর ২৭ মার্চ, ‘ফ্রেন্ডস অব লিবারেশন ওয়ার অনার’ নিতে তিনি সর্বশেষ ঢাকায় গিয়েছিলেন। ২০১৩ সালের ২৯ নভেম্বর না ফেরার দেশে চলে যান নোরা শরীফ। 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত