জাহিদুর রহমান তারিক

১৯ ডিসেম্বর, ২০১৬ ২১:৩৬

সব বাধা পেরিয়ে আলো ছড়াচ্ছে টুটুলের ‘মাতৃভাষা গণগ্রন্থাগার’

শ্যামল ছায়ায় ঢাকা পাখির কল-কাকলিতে মুখর নিভৃত এক পল্লী গ্রামের কাঁচা রাস্তার পাশে ছোট্ট একটি টিনশেড ঘর। লোহার খুঁটিতে ঘরের সামনে টাঙানো সাইনবোর্ড। তাতে লেখা- 'মাতৃভাষা গণগ্রন্থাগার'। দূর থেকেই সেটি যে কারো দৃষ্টি কাড়বে। টিনশেড ও চারপাশে টিনের বেড়ায় ঘেরা ঘরটির ভেতর কোন জ্ঞানপিপাসু ঢুকলে তাঁর অবাক না হয়ে উপায় নেই। এ যে বইভর্তি একটি লাইব্রেরী!

লাইব্রেরী ঘরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়লো- বই দিয়ে ঠাসা ৭/৮টি আলমারি। আরও অনেক বই আলমারি/র‌্যাকের অভাবে গোছানো আছে টেবিলের ওপরে। লক্ষ্যনীয় বিয়য় হচ্ছে- ঘরভর্তি পাঠক, অথচ পিনপতন নিরবতা। লম্বা টেবিলে সারিবদ্ধভাবে বসে বই পড়ছেন বেশ কয়েকজন পাঠক। কেউবা চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন দৈনিক পত্রিকার পাতায়। এলাকার মানুষের বক্তব্য অনুযায়ী- এ হচ্ছে মাতৃভাষা গণগ্রন্থাগারের সুন্দরতম এক নৈমিত্তিক দৃশ্য।

উদ্যমী স্বপ্নবাজ এক তরুণের একক প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে এই লাইব্রেরী। অজপাড়া গাঁয়ের মানুষ এখন এই লাইব্রেরীর কল্যাণে বই পড়তে পারেন। চোখ বোলাতে পারেন অনেকগুলো দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায়।

উদ্যোক্তা তরুণের নাম এম কে টুটুল। তিনি জানালেন- বায়ান্ন তাঁর চেতনা, একাত্তর তাঁর প্রেরনা। মা, মাটি, মানুষ, মুক্তিযুদ্ধ তাঁর সমান প্রিয়। তাই তাঁর প্রতিষ্ঠিত লাইব্রেরীর নাম রেখেছেন 'মাতৃভাষা গণগ্রন্থাগার'। স্বল্প পরিসরে হলেও নিজ বিভায় ক্রমে ক্রমে বিকশিত হয়ে উঠছে লাইব্রেরীটি।

ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার অজপাড়াগাঁ কালুহুদায় ২০০১ সালে এম কে টুটুল নামের মুক্তমনের অধিকারী ও সমাজ সচেতন তরুণের নিরলস প্রচেষ্টায় আধুনিক সুযোগবঞ্চিত এমন এক অখ্যাত পল্লীতেই গড়ে ওঠে লাইব্রেরীটি। মাত্র ১৬ বছরের ব্যবধানে ছোট্ট পরিসরের সেই লাইব্রেরীর কার্যক্রম ধীরে ধীরে বিস্তৃতি লাভ করেছে, আশপাশের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতেও এর প্রভাব পড়েছে। টুটুল এখন শিক্ষার আলো দিয়ে আলোকিত করছেন পুরো অঞ্চলকে। 'মাতৃভাষা গণগ্রন্থগার' বদলে দিচ্ছে এসব এলাকার শিক্ষা, কৃষি ও সামাজিক পরিবেশ।

দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক ও ফরম পূরণের অর্থ সরবরাহ এবং জামানত কিংবা চাঁদা ছাড়া এ লাইব্রেরীতে বই ও পত্রিকা পড়ার সুযোগ সবার জন্য উন্মুক্ত। এলাকার সবার মধ্যে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার পাশাপাশি লাইব্রেরীর উদ্যোগে নিয়মিত গরীব মানুষের বসত বাড়িতে বৃক্ষরোপন, জাতীয় দিবস পালন, কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা সহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে হচ্ছে।

এছাড়াও গণসচেতনা সৃষ্টি করতে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর এর মাধ্যমে বাল্যবিবাহ, মাদক, যৌতুক, ইভটিজিং- এর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো, তরুণ প্রজন্মকে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরত্ব গাঁথা ইতিহাস জানানোর লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী করা হয় লাইব্রেরীর উদ্যোগে। আর এ কাজকে আরো গতিশীল করতে সম্প্রতি লাইব্রেরীর জন্য কেনা হয়েছে একটি হ্যান্ডমাইক।

এসব কারণে কালুহুদাসহ আশপাশের সব গ্রামের জ্ঞানপিপাসু মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ব্যতিক্রমী এ লাইব্রেরীর কার্যক্রম। স্থানীয় ডাঃ সাইফুল ইসলাম ডিগ্রী কলেজের শিক্ষার্থী আবু হাসান দৈনিক ৩ কিলোমিটার হেঁটে এ লাইব্রেরীতে পড়তে আসেন। লাইব্রেরীর কল্যাণে তিনি এসএসসিতে ভালো ফল করতে পেরেছেন। আলাপকালে আবু হাসান বলেন, আমার লেখাপড়ার জন্য প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তক এবং সহ-পাঠ্যবই কেনার সামর্থ ছিল না এ লাইব্রেরী আমার সেই অভাব মিটিয়েছে।

একই কথা জানান পাশের হাবাশপুর গ্রামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র মোঃ শিপন হোসেন, জোকা গ্রামের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র দেলোয়ার হোসেন, শংকরহুদা গ্রামের বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আব্দুল্লাহ আল মামুন ও কালুহুদা গ্রামের চৌগাছা ডিগ্রী কলেজের ছাত্র হাসানুর রহমান।

কালুহুদা গ্রামের ৬২ বছর বয়সী বৃদ্ধ মোঃ লুৎফর রহমান বলেন, দারিদ্রপীড়িত এ এলাকার মানুষ স্বাভাবিক কারণেই লেখাপড়া বিমুখ ছিল। স্কুলশিক্ষা শুধু বিত্তবানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন দিনমজুরের ছেলেমেয়েরাও স্কুলে যায়। লাইব্রেরীর কল্যাণেই এ পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে।

এসব এলাকার শিক্ষার্থী-কৃষক-যুবকসহ বেশিরভাগ মানুষ এখন লাইব্রেরীমুখী। লুৎফর রহমান খুব গর্ব অনুভব করেন এ জন্য যে, উপজেলা শহর থেকে জ্ঞানপিপাসু মানুষের স্রোত এখন উল্টে কালুহুদা গ্রামের দিকে। তিনি বলেন, মহেশপুর থেকে এখন কবি-সাহিত্যিক-গবেষকরা বই পড়তে আমাদের গ্রামে চলে আসে। এটি আমাদের খুব ভাল লাগে।

টুটুলের অক্লান্ত পরিশ্রম, তার মায়ের স্নেহ ছায়া আর হাজারও মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে 'মাতৃভাষা গণগ্রন্থাগার'। টুটুল যখন বই সংগ্রহ করতে ঢাকা বা অন্য কোথাও যান, পত্রিকা সংগ্রহ বা লাইব্রেরী সংক্রান্ত কাজে উপজেলা বা জেলা সদরে যান, তখন এই গ্রন্থাগারটি বুক দিয়ে আগলে রাখেন তাঁর মা। তাঁর অনুপস্থিতিতে পাঠককে বই সরবরাহ করেন মা। "মা-ই আমার সব। তার প্রশ্রয় ছাড়া আমি এমন একটি কাজে এগিয়ে আসতে পারতাম না।"- বিনয়ী হাসি দিয়ে বলেন টুটুল।

টুটুলের মা শুকতারা বেগম জানান, "টিউশনির আয়, বাড়ির গাছের ফল বিক্রি করা, এমনকি আমার সংসারের বাজার কিংবা ঔষধ কেনার টাকা থেকেও লাইব্রেরীর পেছনে ব্যয় করে টুটুল। টিনশেডের নড়বড়ে ঘর হওয়ায় ঝড়বৃষ্টি এলে তার অস্থিরতা দেখলে খুবই কষ্ট লাগে। আমারও সামর্থ্য নাই পাকা ঘর তৈরী করে দেয়ার। লেখাপড়া শেষ হবার পর পরিবার থেকে চাকরির জন্য চাপ দিয়েছি। কিন্তু সে তার প্রাণের লাইব্রেরী ছেড়ে যেতে নারাজ। এখন আমি সমাজ, দেশ ও জাতির কল্যাণে শহীদ রুমীর মতো টুটুলকেও...।" আর বলতে পারেন না তিনি। তাঁর কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে।

লাইব্রেরীর প্রতিষ্ঠাতা এম কে টুটুল বলেন, "১৯৯৫ সালে ৮ম শ্রেনীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় বড় অসময়ে বাবা মিজানুর রহমান মৃত্যুবরণ করেন। বিধবা মায়ের অসচ্ছল সংসার থেকে লেখাপড়া করতে অনেক কষ্ট হয়েছে। এছাড়াও ২০০০ সালের আকস্মিক বন্যায় এলাকায় ব্যাপক ফসলহানি ঘটে। দরিদ্র পিতামাতা তাদের সন্তানদের নতুন বইখাতা কিনে দিতে পারতেন না। এই অবস্থা থেকে আমার মাথায় লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠার ভাবনা আসে। এরপর নিজের বাড়ির এক কোণে টিন-বাঁশের ঘর তৈরি করি। মামা শহীদ সাংবাদিক শামছুর রহমান কেবলের লেখা ‘ধূসর সীমান্ত’ সহ মাত্র ৫০টি বই নিয়ে লাইব্রেরির যাত্রা শুরু করি। এখন বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। পাঠ্যপুস্তক, কৃষি, মুক্তিযুদ্ধ বিষযক বই, মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত চলচ্চিত্র ও প্রামান্য চিত্র, গল্প-উপন্যাস, কবিতা-প্রবন্ধ সহ সব ধরণের বই আছে এ লাইব্রেরীতে।"

তিনি বলেন, "অমর একুশে বইমেলা, প্রকাশক, লেখক ও খ্যাতিমান মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে এসব বই সংগ্রহ করেছি। এছাড়া প্রতিদিন ৮ কিলোমিটার বাইসাইকেল চালিয়ে উপজেলা সদর থেকে সংগ্রহ করে আনি বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা।"

টুটুলের সব স্বপ্ন এ এলাকার মানুষের বাতিঘর খ্যাত 'মাতৃভাষা গনগ্রন্থাগার'কে ঘিরে। তার ইচ্ছা সেখানে শিশুদের জন্য পৃথক কর্ণার ও তথ্যকেন্দ্র স্থাপনের। তথ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে প্রত্যন্ত এ অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীরা বিশ্বের সঙ্গে পরিচিত হতে পারবে। আর শিশুকর্ণারে অবুঝ শিশুরা নিজেদের মতো করে হেসে খেলে বেড়াবে। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভালো মানের ভবনসহ আধুনিক প্রযুক্তির অভাব। গ্রন্থাগারের জরার্জীণ টিনের চালা আজও বিদ্যমান।

গ্রন্থাগারের ভবিষ্যৎ ভেবে সুহৃদ প্রাক্তন ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক শফিকুল ইসলাম, বর্তমান জেলা প্রশাসক মাহবুব আলম তালুকদার, প্রাক্তন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাছিমা খাতুন, বর্তমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশাফুর রহমান ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ড.আব্দুল মালেক গাজী মহোদয়দের মহানুভবতায় ৩৭.২৯ বর্গফুট আয়তন বিশিষ্ট নতুন ভবনের কাজ বর্তমানে নির্মাণাধীন। ভবনটি নির্মাণে আনুমানিক খরচ হবে ১৫ লক্ষ টাকা। যদিও গ্রন্থাগারের নিজস্ব কোনো তহবিল নেই।

তারপরও আশাবাদী টুটুল। মানুষের ভালবাসাকে পুঁজি করে এগিয়ে যেতে চান আরো বহুদূর।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত