শাকিলা ববি

১২ জুন, ২০১৭ ০০:২৩

শিশুশ্রম বন্ধ না হলে শিশু নির্যাতনও বন্ধ হবে না

আজ বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস

পৃথিবী শুরুর পর সভ্যতার অনেক বিকাশ হয়েছে। মানব সভ্যতার ইতিহাস আদিম যুগ থেকে বর্তমানে আধুনিক যুগে রূপান্তর হয়েছে। আধুনিক যুগে বাস করেও সভ্যতা আজ এমন পর্যায়ে উপনিত হয়েছে যে এর নতুনভাবে ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়েছে। বেশ কয়েক বছর যাবত বাংলাদেশে যে নৃশংস শিশু হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছে, তার প্রেক্ষিতে সভ্যতা শব্দটি প্রশ্নের সম্মুখিন হচ্ছে। আমাদের এই আধুনিক সভ্য সমাজে শিক্ষিত সভ্য মানুষগুলোর কিছু কার্যক্রম, ব্যবহার আদিম যুগকেও হার মানাচ্ছে।

২০১৫ সালে সিলেটের রাজন হত্যা, খুলনার রাকিব আর রাজধানীর হাজারীবাগের রাজাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। দিন পনেরোর ব্যবধানে এই ৩ শিশুকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে আমাদের মতই সভ্য কিছু মানুষ। এই ৩টি হত্যাকাণ্ড সাধারণভাবে বিশ্লেষন করলেই কে সভ্য আর কে সভ্য নয়, সভ্যতার কি মাপকাঠি তা বিচার্য হয়ে উঠবে। হত্যাকাণ্ড ছাড়াও প্রতিনিয়ত শিশুরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তাদের কর্মক্ষেত্রে।

আজ ১২ জুন। বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। দারিদ্রতা, পথ শিশু, শিশুশ্রম, শিশু নির্যাতন, শিশু হত্যা- এই সবগুলো বিষয়ই শিশুদের উপর যে কোন নির্যাতনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। হতদরিদ্র পরিবারের একটি শিশু অভাবের তাড়নায় রাস্তায় বের হয়। জীবন-জীবিকার তাগিদে সেই শিশুটিই বিভিন্ন ধরণের পেশায় অর্ন্তভূক্ত হয়। কাজের সব ধরণ বুঝতে না পারায় শিশুটি কর্মস্থলে নির্যাতনের শিকার হয়। নির্যাতন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালে সেই শিশুটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এই হল আমাদের সমাজের সাধারণ চিত্র।



শিশু নির্যাতন ও হত্যার অন্যতম কারণ হচ্ছে শিশু শ্রম। অর্থনৈতিক কারণে ও পরিবারের প্রয়োজনে বেশ কিছু সংখ্যক শিশু অল্প বয়সে নানা ধরণের শ্রমে নিয়েজিত হতে বাধ্য হয়। শহর-গ্রাম উভয় অঞ্চলেই শিশু শ্রমিক নিয়োগ করা হয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারো ও ইউনিসেফের এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সের সত্যিকারের শিশু শ্রমিক আছে ৬.০%, যার মধ্যে ছেলে শিশু ৯.১% ও মেয়ে শিশু ২.৬%। গ্রামীন শিশু শ্রমিক আছে ৫.১%, যার মধ্যে ছেলে শিশু ৮.৫% ও মেয়ে শিশু ১.৫%। শহরের শিশু শ্রমিক আছে ৯.০%, ছেলে শিশু ১১.৩% ও মেয়ে শিশু ৬.৬%। বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সের শিশু কৃষি কাজে কর্মরত আছে ৩৮.৯%, যার মধ্যে ছেলে শিশু ৪৫.০% ও মেয়ে শিশু ১৫.৬%। শিল্প কারখানায় কর্মরত আছে ২০.৪% শিশু, যার মধ্যে ছেলে শিশু আছে ১৮.২% ও মেয়ে শিশু ২৯.১%। বিভিন্ন ধরণের চাকুরিতে কর্মরত আছে ৪০.৭% শিশু, যার মধ্যে ছেলে শিশু ৩৬.৮% ও মেয়ে শিশু ৫৫.৩%।

শিশুশ্রমে বাংলাদেশের ৭টি বিভাগের মধ্যে ১০ থেকে ১৪ বছরের ৮.০% শিশু শ্রমিক নিয়ে ১ম স্থানে আছে রাজধানী ঢাকা, ২য় স্থানে সিলেট (৭.৫%) আর ৩য় স্থানে আছে চট্টগ্রাম (৫.৩%)।

জেলা ভিত্তিক সবচেয়ে বেশি শিশু শ্রমিক আছে ঢাকায় ১৪.৬%। এরপর নারায়নগঞ্জে আছে ১৩.২%, বান্দরবনে ১১.৮%, কক্সবাজার ও সুনামগঞ্জে ৯.৪% এবং গাজীপুরে ৮.৯%। সবচেয়ে কম শিশু শ্রমিক আছে ঝালকাঠিতে ২.২%, বাগেরহাট ও চাদঁপুরে ৩.০%, মানিকগঞ্জে ৩.১%, বরগুনা ও পিরোজপুরে ৩.২% এবং জয়পুরহাট ও সাতক্ষিরায় ৩.৩%।

এমআইসিএইচের ২০১২-২০১৩ সালের এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী দেখা গেছে, বাংলাদেশে ১ থেকে ১৪ বছর বয়সের ৮২.৩% শিশু নির্যতিত হয়।

যে বয়সে শিশুর স্কুলে যাওয়ার কথা, খেলাধুলা, হাসি, আনন্দে বেড়ে ওঠার কথা, সে বয়সে শিশুকে সংসারের হাল ধরতে হচ্ছে। রিকশা, অটো রিকশা চালানো ও নির্মাণ, মেক্সি, টেম্পু, মাইক্রোবাসের হেলপার, চা স্টল, ইট ভাটা, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, বিদ্যুৎ, রাজমিস্ত্রির সাহায্যকারী, গার্মেন্টস, জুটমিল, ওয়েলডিং কারখানা, কৃষিসহ বিভিন্ন কাজ করে শিশুরা জীবিকা নির্বাহ করে। অভাবের তাড়নায় এসব ঝুকিঁপূর্ন কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে শিশুরা।

শিশুশ্রম রোধে আছে আইন। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও প্রকাশ্যেই চলে এর কার্যক্রম। উপরের যে কাজগুলো শিশুরা করে, তার প্রায় সবই সাধারণ জনগন, পুলিশ, প্রশাসন, আইন প্রনয়নকারী ও আইন রক্ষকারীদের সামনেই চলে।

শিশুশ্রম আইন ২০১৩ সনের ২৪ নং ধারায় বলা হয়েছে, 'বিদ্যমান অন্য কোন আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের উদ্দেশ্যপূরণকল্পে, অনুর্ধ্ব ১৮ (আঠার) বৎসর বয়স পর্যন্ত সকল ব্যক্তি শিশু হিসাবে গণ্য হইবে।'

কোন প্রতিষ্ঠানে শিশু-কিশোর শ্রমিক নিয়োগ সংক্রান্ত কতিপয় চুক্তির বাধা-নিষেধ বিষয়ে বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ সনের ৪২ নং আইনে বলা হয়েছে, 'এই অধ্যায়ের বিধান সাপেক্ষে, কোন শিশুর মাতা-পিতা বা অভিভাবক শিশুকে কোন কাজে নিয়োগের অনুমতি প্রদান করিয়া কাহারও সহিত কোন চুক্তি করিতে পারিবেন না।'

শিশু ও কিশোর নিয়োগে বাধা-নিষেধ বিষয়ে আইনে বলা হয়েছে, '৩৪ (১) এই অধ্যায়ের বিধান সাপেক্ষে কোন পেশায় বা প্রতিষ্ঠানে কোন শিশু বা কিশোরকে নিয়োগ করা যাইবে না বা কাজ করিতে দেওয়া যাইবে না।'

এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার আইনজীবি রুহুল হাসান শরীফ বলেন, "জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুসমর্থনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। উক্ত সনদের ৩২ (১) ধারায় বলা হয়েছে, শিশুকে যাতে বিপদশংকাপূর্ণ ও শিশুর শিক্ষার ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী কিংবা তার স্বাস্থ্য অথবা শারীরিক, মানসিক, আত্মিক, নৈতিক বা সামাজিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর কাজ করানো না হয়, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে সরকার। বিগত ১৯৯১ সালের ২ সেপ্টেম্বর থেকে ঐ সনদের বাস্তবায়ন বাংলাদেশের জন্য আবশ্যকীয় হয়েছে। আমাদের দেশে শিশু অধিকার রক্ষায় বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা প্রণীত হয়েছে। কিন্তু এ আইন ও নীতিমালাগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। যার ফলে শিশুদের ঝুকিঁপূর্ণ কাজে নিয়োগ করা হচ্ছে এবং বিভিন্ন স্থানে শিশু নির্যাতন বৃদ্ধি পাচ্ছে ও আশংকাজনক ভাবে শিশু হত্যা বেড়ে চলছে। শিশুশ্রম বন্ধসহ শিশু সুরক্ষার জন্য আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন প্রয়োজন।"

আপনার মন্তব্য

আলোচিত