২৫ অক্টোবর, ২০১৯ ১৫:১৬
হিন্দু, মুসলিম, ওরাঁও, সাওতাল, পলিয়া, কোচ ও রাজবংশীয় ধর্ম-বর্ণের জনবসতির পঞ্চগড়। ১৩১৮টি গ্রাম নিয়ে গঠিত পঞ্চগড়ের মোট আয়তন ১৪৯৫.৬৯৭ বর্গ কিলোমিটার। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের হিসাব অনুযায়ী জেলার মোট জনসংখ্যা ১,০৫০,০১৪ জন। বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী যার সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। পঞ্চগড়ের প্রশাসনিক দপ্তর পাঁচটি। এর মধ্যে পঞ্চগড় সদর, বোদা, তেঁতুলিয়া, আটোয়ারী এবং দেবীগঞ্জ। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত পঞ্চগড়ের প্রাকৃতিক দৃশ্য প্রকৃতিপ্রেমিদের আকৃষ্ট করবেই।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের ৩০১টি (প্রায় বিলুপ্ত) নদীর মধ্যে ৩৩টি নদীই পঞ্চগড়ের ঐতিহ্য বহন করে আসছে। সবুজ শ্যামলে ঘেরা পঞ্চগড়ের তিন দিকেই ভারতের সীমানা। দক্ষিণ দিকে অবারিত বাংলার বিশাল রাজ্য। ‘চোঙ্গা’ আকৃতি, নদ-নদীর সমাহার, সবুজ শ্যামল ঘেরা পঞ্চগড় যে বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ অতিথিশালা এতে কোন সন্দেহ নেই। এই ভূ-খণ্ডের জন-মানুষরা শান্ত-নিরীহ এবং মার্জিত স্বভাবের। এখানকার কৃষ্টি কালচার দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে ভিন্ন। আজ থেকে প্রায় আড়াইশ বছর আগে অঞ্চলটি বেলুয়াভূমি নামে পরিচিত ছিল। কালের আবর্তে, সময়ের ব্যবধানে এই জনপদ ‘পঁচাগড়’ থেকে পঞ্চগড়ে রূপ নেয়।
কাশ্মির যেমন পৃথিবীর ভূ-স্বর্গ তেমনি পঞ্চগড় বাংলাদেশের ভূ-স্বর্গ। এই স্বর্গে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে প্রায় ১০ হাজার। তবে সরকারি হিসাব অনুযায়ী যার সংখ্যা ৬৯৪০ জন। প্রায় ১৪ লাখ জন আবাসনের বাসস্থানের কৃষ্টি-কালচারেও রয়েছে অফুরন্ত ব্যঞ্জনা। কারণ, আজ থেকে ১৫শ বছর আগে অঞ্চলটি শাসন করতো মহারাজ বংশীয় শাসকরা। পরবর্তীতে এই জনপদে সম্ভবত কোন এক সময় ভূমিকম্প ঘটায় প্রকৃতির আদল, আচার-আচরণ, কৃষ্টি-কালচার, নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের কয়েক ধাপ পরিবর্তন ঘটেছে। সময়ের ঘূর্ণায়নে এই অঞ্চলে তৎকালীন উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকার মানব সম্পদ আপদে-বিপদে জীবন জীবিকা রক্ষায় পঞ্চগড়ের শান্ত প্রকৃতিতে আবাসন গড়ায় আস্তে আস্তে মিশ্র সংস্কৃতির অপূর্ব পঞ্চগড়ের বিনির্মাণ ঘটে। যে কারণে হিমালয় কন্যা পঞ্চগড়ের সংস্কৃতি অন্য দশটি অঞ্চলের চেয়ে ব্যতিক্রম ও সমৃদ্ধ। হিন্দু -মুসলিমসহ ৭টি ধর্মের মানব সভ্যতায় সৃষ্ট সংস্কৃতির মধ্যে মাছ ধরা, জার বুনন, মাটির হাঁড়িপাতিল তৈরি, হাঁস মুরগি পালন, বাঁশ-বেতের কাজই ছিল এ অঞ্চলের জীবন জীবিকা অর্জনের অন্যতম সংস্কৃতি।
পরবর্তীতে কৃষি সংস্কৃতি শুরু হয়, চীনা কাউন, ভুট্টা এবং পয়রা চাষের মধ্য দিয়ে। কৃষি সংস্কৃতি কয়েক ধাপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে হচ্ছে ধান, গম, আখ, ভুট্টা, ডাল, চিনাবাদাম, তরমুজ, কমলালেবু, স্ট্রবেরিসহ উন্নত ফল ও ফসল। কর্মে যুক্ত হয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদ, পাথর-বালি আহরণ। গড়ে ওঠেছে মিল ও ফ্যাক্টরি। সবুজ ঘেরা সমতল পঞ্চগড়ের উর্বর মাটিতে চা-চাষের মহোৎসব এখানকার মানুষের কৃষি কালচারে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। পঞ্চগড়ের চিনিকল, জুটমিল, ডিস্ট্রিলারিজ, খাম্বা, জেমকন ফ্যাক্টরিতে উৎপাদন পর্যাপ্ত হলেও শিল্প কালচারে এ অঞ্চলের জনমানুষের মাঝে তা ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি।
এখানকার ধর্মীয় সংস্কৃতিতে বিভিন্ন ধর্মের জনমানুষরা আলাদা আলাদা সার্বজনীন অনুষ্ঠানাদি পালন করায় সম্প্রীতির স্বাক্ষর বহন করছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আধুনিক যুগের নিরানন্দ, বিউটি পার্লার নির্ভর পারিবারিক বিয়ে বাড়ির সংস্কৃতি যখন অন্ধকারে ওই সময় পঞ্চগড়ের হিন্দু সমাজের সাতপাকের বিয়েবাড়িতে এখনও ঢাক-ঢোলে উত্তাল হয়ে ওঠে। মুসলিমদের বিয়ে, অনুষ্ঠানে এখনো গ্রামের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষরা দাদা-দাদী, নানা-নানী চাচা-চাচীদের সমন্বয়ে বর-কনের গায়ে হলুদের সংস্কৃতি টিকে রয়েছে। বিয়ে বাড়িতে প্রতিবেশী মহিলাদের গলায় হাত রেখে দল বেঁধে বরের আগমনে হেরুয়ার সুরে কনের বাড়িতে ‘বর ধোলাই’, একইভাবে বরের বাড়ি কনের আগমনে প্রতিপক্ষ প্রতিবেশীদের কনের ‘জাত ধোয়া’ হেরুয়ার সুর সত্যিই এক আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি করে। ফলে বিয়ে বাড়িতে দাওয়াতি-বিনাদাওয়াতি উৎসুক জনতার ভিড় পঞ্চগড়ের মান সভ্যতায় ইতিহাস পরিমার্জন করে চলছে। কন্যা কূলে বদ্ধ ধারণা, নতুন বিবাহিত কনে ভাদ্র মাসের প্রথম তিন দিন মেয়ে বাপের বাড়িতেই থাকতে হবে। কারণ স্বামীর দেখা মিললে কনে অন্ধ হয়ে যাবে। নতুন বিবাহিত এই তিন দিন কনের বাপের বাড়ি থাকাকে পঞ্চগড়ে ‘ভাদর-কাটানি’ উৎসব হিসেবে উদযাপিত হয়। এই উৎসব ঘিরে নতুন বিবাহিত মেয়ের বাপের বাড়ি তিনদিনের উৎসবের কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এরপরও এলাকার জনমানুষরা এই উৎসবকে আদি সংস্কৃতি হিসেবে গ্রহণ করেছে।