৩০ ডিসেম্বর, ২০১৯ ১৫:০৬
বরফের চাদরে ঢেকে গেছে বসবাসের জায়গা। খাবারের সংকট তীব্র। তাই জীবন বাঁচাতে দুই-তিন হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কোনো এক নতুন গন্তব্যে আসে। বাসস্থান আর খাবারের সন্ধানে সমতলের খোঁজে পৌঁছাতেই প্রাণশক্তি নেমে আসে শূন্যের কোটায়। যে শরীরের স্বাভাবিক ওজন ৯-১৩ কেজি, তা নেমে আসে ৫-৭ কেজিতে। রুগ্ন এবং মৃতপ্রায় শরীর নিয়ে উড়ে এসে যখন সমতলের কোনো মাটিতে পড়ে। তখনই শুরু হয় অন্যরকম অত্যাচার। কেউ ঢিল ছোড়ে, কেউ দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখে, কেউ পা ভেঙে দেয়, কেউ বা পিটিয়ে হত্যা করে।
অসহায় এ প্রাণীর নাম ‘হিমালয়ী গৃধিনী’। ইংরেজি নাম Himalayan Vulture। বৈজ্ঞানিক নাম Gyps himalayensis। সবাই সোজা বাংলায় চেনে শকুন বলে।
প্রতিবছর নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের দেশগুলো থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তারা চলে আসে বাংলাদেশ ও ভারতের কিছু অংশে।
মৃতদেহ থেকে মাংস খেয়ে অন্তত ৪০টি রোগের ঝুঁকি থেকে মানুষকে রক্ষা করে শকুন। একমাত্র শকুনই অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত মৃত গরুর মাংস খেয়ে হজম করতে পারে। এছাড়া যক্ষ্মা ও খুরা রোগের জীবাণু শকুনের পেটে গিয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। মৃতদেহ থেকে ক্ষতিকর জীবাণু ছড়ানোর আগেই তা শেষ করতে পারে শকুন।
বাংলাদেশ শকুন গবেষণা প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, পৃথিবীতে ২৩ প্রজাতির শকুনের বাস। তার মধ্যে ৭ প্রজাতির শকুন ছিল বাংলাদেশে। ৭ প্রজাতির শকুনের মধ্যে রাজ শকুন প্রজাতিটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাকি ৬ প্রজাতি অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে লড়াই করে যাচ্ছে। জীবন বাঁচাতে প্রতি বছর গড়ে ১০০টি শকুন শীত মৌসুমে বাংলাদেশে আসে। চলতি বছর এ পর্যন্ত দুটি দল এসেছে। তার প্রথমটি আসে নভেম্বরের ২৪ তারিখে। সে দলে শকুনের সংখ্যা ছিল ২২-২৫টি। আরেকটি দল আসে ডিসেম্বরের ২৩-২৪ তারিখে। যার সংখ্যা ৪০-৪৫টি।
চলতি সপ্তাহে আসা শকুনের শেষ দল থেকে ৬টি শকুন ক্লান্ত হয়ে গাইবান্ধা সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অসুস্থ হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। সেগুলোকে আহত করেছেন স্থানীয়রা। 'প্রকৃতির ঝাড়ুদার' এই শকুন দেখা মাত্রই আক্রমণ করে অসচেতন মানুষ। নির্যাতনের পাশাপাশি মানুষ এদের হত্যা করতেও পিছপা হয় না।
এর আগে পঞ্চগড় থেকে ২টি, নীলফামারী থেকে ১টি, কুড়িগ্রাম থেকে ১টি, বগুড়া থেকে ১টি, নারায়ণগঞ্জ থেকে ১টি, কুমিল্লা থেকে ১টি এবং শেরপুর থেকে ২টিসহ মোট ১৪টি শকুন আহত অবস্থায় উদ্ধার করে নেওয়া হয় দিনাজপুরের শকুন রেসকিউ সেন্টারে। বন বিভাগ ও আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের এ সেন্টারে শকুনগুলোকে পরিচর্যা শেষে অবমুক্ত করা হবে।
আহত অবস্থায় প্রতি বছর গড়ে ২০টি শকুন উদ্ধার করা হয়। গত ৫ বছরে যার সংখ্যা ১০০টি। যার বেশিরভাগ মানুষের আঘাতে গুরুতর আহত হয়। মাঝে মাঝে এরা মানুষের হাতে প্রাণও হারায়।
বাংলাদেশ শকুন সংরক্ষণ প্রকল্পের প্রধান গবেষক সীমান্ত দীপু বলেন, বাংলাদেশ থেকে রাজ শকুন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অন্য প্রজাতি টিকিয়ে রাখতে এখনই সচেতন হতে হবে। হাজার হাজার মাইল দূর থেকে উড়ে আসা শকুনগুলোকে রক্ষা করতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা যখনই আহত কোনো শকুনের খবর পাই। সাথে সাথে উদ্ধার করে নিয়ে আসি। মানুষ যদি একটু সচেতন হয়। তাহলে কোনো শকুন মারা যাবে না। দেশের যে প্রান্তেই শকুন থাকুক, বন বিভাগ বা আইইউসিএনকে খবর দেওয়ার অনুরোধ করছি। প্রকৃতির জন্য উপকারী এ প্রাণিকে বাঁচাতে এ সচেতনতাটুকু প্রয়োজন।
সীমান্ত দীপু আরও জানান, গত পাঁচ-ছয় বছরে আমরা প্রায় শতাধিক শকুন সুস্থ করে ছেড়েছি। এর মধ্যে গত দুই বছর ধরে আমরা এদের পায়ে রিং পড়িয়ে দিচ্ছি এদের গতিবিধি ট্যাগ করার জন্য। এরা নভেম্বরে এসে আবার মার্চ বা মধ্য এপ্রিলে ফিরে যায়।
আপনার মন্তব্য