উজ্জ্বল মেহেদী

২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ১৬:৫৪

হাসন রাজা একাডেমি : নামকরণ, নামহরণ!

বর্ষায় অবারিত জলরাশি, আর শুষ্ককালে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ—এই হচ্ছে হাওর। বাংলাদেশের প্রান্তিক জনপদ সুনামগঞ্জ হাওর, নদী আর সীমান্তের ওপারে পাহাড়বেষ্টিত। যাতায়াতে সড়কপথ একটিই। সিলেট থেকে সড়কপথে সুনামগঞ্জ যেতে দেখার মধ্যে যে হাওর, নাম তার দেখার হাওর।

সুনামগঞ্জ শহর থেকে দেখা যায় বলেই হয়তো এমন সহজিয়া নামকরণ। দেখার হাওর নাম হলেও এ হাওরে এখনো চোখ মুদলে দেখা যায় একটি নাম। মরমি কবি হাসন রাজা, তাঁর বজরা আর গানবিলাস হাওরের ঢেউয়ের সঙ্গে মিশে আছে। যেন হাসন রাজার সেই গানের মতোই, ‘আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে...’।

‘আঁখি মুঞ্জিয়া’ হোক, আর খুলেই হোক, সড়কপথে দেখার হাওর দেখতে দেখতেই শহর সুনামগঞ্জ পৌঁছাতে হয়। প্রবেশমুখে সড়কের দুই ধারে একটি স্থাপনা, নাম ‘হাসন তোরণ’। হাসন রাজার নামে এ যেন নীরব এক স্বাগত জানানোর আয়োজন। ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে হাসন রাজার প্রপৌত্র জোছনাবাদী কবি হিসেবে পরিচিত মমিনুল মউজদীন (২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী ও এক ছেলেসহ নিহত) সুনামগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান থাকাকালে এটি নির্মাণ করেছিলেন। সেখানে চোখ ফেললে নিদারুণ এক হতাশা ভর করে এখন। নির্মাণের পর আর একবারের জন্যও হাসন তোরণের সংস্কার হয়নি। এক পাশে ময়লার বর্জ্য ফেলে নিঃশেষ করার অপচেষ্টা চলছে নীরবে।

দেওয়ান হাসন রাজা (১৮৫৪-১৯২২) জমিদার ছিলেন। কিন্তু তিনি জমিদার নন, গানের রাজা হয়ে বেঁচে আছেন। হাসন তোরণ উন্মোচনে সাদামাটা এক আয়োজন হয়েছিল। মনে পড়ে, এক বিকেলে কবি মমিনুল মউজদীন ভাটি অঞ্চলের গণমানুষের নেতা বাম রাজনীতিবিদ প্রয়াত কমরেড বরুণ রায়কে সঙ্গে করে নিয়ে হাসন তোরণ উন্মোচন করেছিলেন। বরুণ রায় হাসন তোরণ উন্মোচন করে কিছু বলতে গিয়ে একটি কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। গণমানুষের কবি দিলওয়ারের কবিতা ‘সূর্য অস্ত যায় না কখনো...’। কবিতার সেই ‘সূর্য’ কি তবে হাসন রাজা ছিলেন? এমন প্রশ্ন উঁকি দিলেও সেদিন সবারই বোঝা হয়ে গিয়েছিল কবিতার পঙক্তি দিয়ে বরুণ রায় কী বলতে চেয়েছিলেন।

আসলে সূর্যের মতো যাঁরা সত্য, তাঁদের আর নামকরণ করে জিইয়ে রাখার দরকার পড়ে না। তবু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নতুন প্রজন্মের কাছে চির জাগরূক করে রাখতে নামকরণ প্রয়োজন ছিল। হাসন রাজার নামে সেই তোরণখানিই এখন সুনামগঞ্জে যাত্রাপথে নামের সুবাস মাত্র। সুনামগঞ্জকে হাওরের জনপদ আর ভাটির জেলা বা অন্য হাজারো উপমায় ডাকি না কেন, হাসন রাজার দেশ নামটি কিন্তু আনমনেই সবার মনে গাঁথা।

জনমনে গাঁথা থেকে অতীতে নানা জায়গার নামকরণও হয়েছে। শহরের মধ্যে আছে একটি মহল্লার নাম হাসননগর। আছে ‘হাসন বসত’ আর ‘হাসন বাহার’ নামে আরও দুটো গ্রাম। হাসন রাজার বংশের কথা মনে পড়ে যায় বলে অতিসম্প্রতি সুনামগঞ্জের একটি ঐতিহ্যবাহী ইউনিয়নের পুরোনো নাম ‘কোরবানি’ দিয়ে রাখা হয়েছে ‘কোরবাননগর’। হাসন রাজাপ্রেমীদের অনুযোগ, ক্ষমতার দাপট খাটানো একটি মহল এতে সফল হওয়ায় নবনির্মিত হাসন রাজা একাডেমির নামকরণ এবারের কোরবানির ঈদের আগেই ‘কোরবানি’ দেওয়ার অপচেষ্টা শুরু করেছে। তাই তো প্রতিবাদে এককাট্টা সুনামগঞ্জ শহরের হাসন-সংস্কৃতি অনুরাগীরা।

কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের দাবি নয়, ‘হাসন রাজা একাডেমি’ নামে একটি বাউল-সংস্কৃতির কেন্দ্র নির্মাণ প্রায় তিন দশক কাল আগের দাবি। ১৯৭৩ সালে সুনামগঞ্জ শহরে প্রথম হাসন রাজার নামে লোক-উৎসব হয়েছিল। হাসন রাজার নামে একটি একাডেমি স্থাপনের জন্য ১৯৭৫ সালের শুরুর দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ হাজার টাকার সরকারি অনুদান দিয়েছিলেন। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের প্রচেষ্টায় এ অনুদান এসেছিল। ১৯৭৫ থেকে ২০০৪ সাল, দীর্ঘ অপেক্ষার পর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে একটি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাসন রাজা একাডেমি নামে প্রকল্প অনুমোদন হয়।
২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তৎকালীন উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরীর প্রচেষ্টায় একনেকের বৈঠকে হাসন রাজা একাডেমির নামে অর্থ বরাদ্দ হয়। দুই বছর পর প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হাসন রাজা লোক উৎসবে হাসন রাজা একাডেমি প্রকল্পের কাজ শুরুর ঘোষণা দিয়েছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক। ২০১৪ সালের ৩০ মার্চ শিল্পকলা একাডেমীর তত্ত্বাবধানে ‘হাসন রাজা একাডেমি স্থাপন প্রকল্প’ হিসেবে সব কাগজপত্র, দলিলাদি এখনো সুরক্ষিত আছে।

সাত বছর পর যখন নির্মাণকাজ শেষ, উদ্বোধনের অপেক্ষা, ঠিক তখনই প্রকল্পে থাকা সত্ত্বেও নামকরণ উধাও হয়ে যায়। হাসন রাজা একাডেমি এখন শিল্পকলা একাডেমী নামে উদ্বোধনের তোড়জোড় চলছে। স্বাভাবিকভাবে সবার আগে সংস্কৃতিকর্মীরা মর্মাহত হওয়ার কথা। কিন্তু সুনামগঞ্জের দিকে চোখ রাখলেই বোঝা যায়, সংস্কৃতিকর্মীর চেয়ে সাধারণ মানুষ আরও বেশি মর্মাহত। কারণ, হাসন রাজা এবং তাঁর সৃষ্টি গান।

হাসন রাজাকে নিয়ে নানা কেচ্ছা-কাহিনি সুনামগঞ্জে প্রচলিত। বলা হয়ে থাকে, লক্ষণছিরি (সুনামগঞ্জ শহর) থেকে রামপাশা (সিলেটের বিশ্বনাথ, হাসন রাজার পৈতৃক বাড়ি) পর্যন্ত যে মাটিতে পা ফেলবেন, দলিল–দস্তাবেজ ঘেঁটে সেই সব জায়গার মালিকানায় পাওয়া যাবে হাসন রাজার নাম। চাইলে সুনামগঞ্জের নাম পাল্টে হাসন রাজা নিজের নামে করে যেতে পারতেন!

এমনটি করলে অবশ্য জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নাম মুছে যেত। কিন্তু হাসন রাজা জমির রাজা না হয়ে হয়েছিলেন গানের রাজা। যে গান সর্বসাধারণের মন কাড়ছে জমিদারি বিলুপ্তির এতকাল পরও। নামকরণ করে আবার নামহরণ করলে আপাতদৃষ্টিতে মিইয়ে যায় নামখানি। ক্ষমতার দাপটে হাসন রাজা একাডেমি থেকে হাসন রাজা নাম নিয়ে এমন ‘খেইড়’ (খেলার আঞ্চলিক শব্দ, হাসন রাজার একটি জনপ্রিয় গানে এ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে) হলেও তাঁর গানের মধ্য থেকে কি নাম হরণ করা যাবে? যাবে না কখনো।

উজ্জ্বল মেহেদী: সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য

আলোচিত