আন্তর্জাতিক ডেস্ক

১৯ জুলাই, ২০২২ ১৩:০৫

বাংলাদেশসহ এশিয়ার যেসব দেশের জন্য শ্রীলঙ্কা সতর্ক সংকেত

ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ এবং নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে রয়েছে শ্রীলঙ্কা। বছরের শুরু থেকে প্রকাশিত হওয়া এ অর্থনৈতিক সংকট এখন রূপ নিয়েছে রাজনৈতিক সংকটে। জনগণের আন্দোলনের মুখে দেশ থেকে পালিয়ে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন লঙ্কান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। শ্রীলঙ্কার মতো অর্থনৈতিক সংকট এখন ইউরোপ থেকে শুরু করে এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার বেশ কয়েকটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি তৈরির ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশসহ এশিয়ার আরও চারটি দেশ।

গতকাল সোমবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির সুরঞ্জনা তিওয়ারির এক প্রতিবেদনে শ্রীলঙ্কা সংকটের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা কয়েকটি দেশের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়েছেÑ শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশ, পাকিস্তান, লাওস ও মালদ্বীপের জন্য একটি সতর্ক সংকেত।

আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিভা বিবিসিকে বলেন, ‘যেসব দেশের উচ্চমাত্রার ঋণ আছে এবং নীতিমালার পরিসর সীমিত তাদেরকে বাড়তি চাপের মুখে পড়তে হবে। তাদের জন্য শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতি একটি সতর্কবার্তা।’ গত চার মাস ধরে উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের টেকসই মূলধনের বহিঃপ্রবাহ দেখছে, যা তাদের উন্নত অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার স্বপ্নকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।

বৈদেশিক মুদ্রা না থাকায় শ্রীলঙ্কা তদের ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের জন্য অতি প্রয়োজনীয় খাবার, জ্বালানি ও ওষুধ আমদানি করতে পারছে না। সেখানে মূল্যস্ফীতি ৫০ শতাংশে পৌঁছেছে। এক বছর আগের তুলনায় খাবারের দাম ৮০ শতাংশ বেড়ে গেছে। এ বছর মার্কিন ডলার এবং অন্যান্য প্রভাবশালী মুদ্রার বিপরীতে শ্রীলঙ্কার রুপির ব্যাপক অবমূল্যায়ন হয়েছে। এজন্য দেশটির বেশিরভাগ মানুষ সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছেন।

কভিড-১৯ মহামারী পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে গত ২০ বছরে এই প্রথম কোনো দেশ বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলো। বেলআউট সুবিধা পেতে শ্রীলঙ্কা কর্র্তৃপক্ষ আইএমএফের সঙ্গে দেনদরবার করছে। তারা আইএমএফ থেকে ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার বেলআউট সুবিধা চায়। কিন্তু দেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণে আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা থমকে আছে।

শুধু শ্রীলঙ্কা নয় বরং ওই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের অর্থনীতিকেও বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির, উচ্চ সুদের হার, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, উচ্চ ঋণ এবং দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বৈশ্বিক ঝড় মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এসব উন্নয়নশীল দেশের কয়েকটিতে ঋণদাতা দেশ হিসেবে চীনের আধিপত্য রয়েছে এবং চীন গুরুতর উপায়ে এসব দেশের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তবে চীনের ঋণের শর্তগুলো কী এবং কীভাবে তারা ঋণ পুনর্গঠন করবে, তা অনেকটাই অস্পষ্ট।

এই অঞ্চলের দেশগুলোর বর্তমান কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হওয়ার দায় চীনের ওপরও বর্তায় বলে মনে করেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক অ্যালান কিনান। তিনি বলেন, চীন ওইসব দেশকে এমন সব ব্যয়বহুল অবকাঠামো প্রকল্প করতে উদ্বুদ্ধ করছে, যার বদলে ওইসব প্রকল্প থেকে বড় ধরনের কোনো অর্থনৈতিক অর্জন আসছে না।

বাংলাদেশ
বাংলাদেশে গত মে মাসে মুদ্রাস্ফীতির হার ৭ দশমিক ৪২ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাওয়ায় জরুরি নয় এমন পণ্য আমদানি বন্ধ করতে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার।

প্রবাসীদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স পেতে বিভিন্ন বিধান শিথিল করা হয়েছে। কর্মকর্তাদের বিদেশে ভ্রমণও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল রেটিংসের বিশ্লেষক কিম আং তান বিবিসিকে বলেন, ‘আমদানি আয় ও রপ্তানি ব্যয়ের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ঘাটতিতে থাকা বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা সরকারকে ভর্তুকি বাড়ানো নিয়ে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হবে। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা এরই মধ্যে অর্থনৈতিক সহায়তার জন্য আইএমএফ ও অন্য দেশের সরকারের দ্বারস্থ হয়েছে।’

বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দিয়ে কিম আং আরও বলেন, ‘বাংলাদেশকে সরকারি ব্যয়ের বিষয়টিকে পুনরায় অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং ভোক্তা পর্যায়ে কেনাকাটার ওপরও বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে।’

পাকিস্তান
পাকিস্তান সরকার জ্বালানি তেলের ওপর ভর্তুকি দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় গত মে মাস থেকে দেশটিতে জ্বালানি তেলের দাম ৯০ শতাংশ বেড়ে গেছে। দেশটি এখন তাদের খরচের লাগাম টানতে চাইছে। একই সঙ্গে একটি বেলআউট কর্মসূচি শুরু করতে আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা করছে। দেশটিতে পণ্যের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। গত জুন মাসে বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার ২১ দশমিক ৩ শতাংশে পৌঁছেছে, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

শ্রীলঙ্কার মতো পাকিস্তানেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে। গত বছরের আগস্টের তুলনায় তা প্রায় অর্ধেকে নেমে গেছে। দেশটির সরকার এক বছরের জন্য বড় আকারের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ১০ শতাংশ কর আরোপ করেছে। যাতে তারা ১৯৩ কোটি মার্কিন ডলার পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করতে পারে। তারা সরকারের রাজস্ব ও খরচের মধ্যকার ব্যবধান কমানোরও চেষ্টা করছে। দেশটির কাছে আইএমএফের বেঁধে দেওয়া শর্তগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম।

এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল রেটিংসের বিশ্লেষক অ্যান্ড্রু উড বিবিসিকে বলেন, পাকিস্তান সরকার যদি এসব তহবিল সংগ্রহ করতে পারে, তবে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলো ঋণসীমা বাড়াতে আগ্রহী হতে পারে।

মালদ্বীপ
মালদ্বীপে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারি ঋণের পরিমাণ বাড়তে দেখা গেছে এবং এটি এখন তাদের জিডিপির তুলনায় ১০০ শতাংশের ওপরে। শ্রীলঙ্কার মতো পর্যটন খাতের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল এ দেশটির অর্থনীতিতেও করোনা মহামারীর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। সাধারণত পর্যটননির্ভর অর্থনীতির দেশগুলোতে উচ্চমাত্রায় সরকারি ঋণের অনুপাত দেখা যায়। যদিও বিশ্বব্যাংক বলছে, মালদ্বীপ সুনির্দিষ্টভাবে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিজনিত কারণে ঝুঁকিতে আছে। কারণ দেশটির অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মর্গান বলছে, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ মালদ্বীপ বৈদেশিক ঋণের কিস্তি প্রদানে ব্যর্থ হতে পারে।

লাওস
পূর্ব এশিয়ার ভূমিবেষ্টিত দেশ লাওসে ৭৫ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করে। দেশটি গত কয়েক মাস ধরেই বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর পুরো বিশ্বের মতো সেখানেও জ্বালানি তেল এবং নিত্যপ্যণ্যের দাম বেড়েছে। লাওসের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, লাওসে জ্বালানি সংগ্রহের জন্য মানুষকে দীর্ঘ সারিতে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। কোনো কোনো পরিবার তাদের ইউটিলিটি বিল চুকাতে পারছে না।

চলতি বছর লাওসের মুদ্রা কিপের মান মার্কিন ডলারের তুলনায় ১ শতাংশের বেশি অবমূল্যায়িত হয়েছে। দেশটির সরকারকে আমদানি খরচ মেটাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, গত বছরের ডিসেম্বরে লাওসের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার। তবে ২০২৫ সাল পর্যন্ত দেশটিকে একই পরিমাণে ঋণ শোধ করে যেতে হবে, যা দেশটির মোট দেশজ রাজস্বের প্রায় অর্ধেক। জলবিদ্যুৎকেন্দ্র ও রেলওয়ের মতো বড় প্রকল্পগুলোর জন্য গত কয়েক বছরে লাওসকে প্রচুর পরিমাণে ঋণ দিয়েছে চীন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত