সিলেটটুডে ইন্টারন্যাশনাল ডেস্ক

২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ২৩:৪৫

পাক-ভারত উত্তেজনা তুঙ্গে, কোন পক্ষে রাশিয়া?

ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের উরিতে সেনা ঘাঁটিতে সন্ত্রাসী হামলায় ১৭ ভারতীয় সেনা নিহতের পরে পাক-ভারত উত্তেজনা তুঙ্গে। সম্ভাব্য যুদ্ধের আশঙ্কায় একদিকে যেমন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ সতর্কতায়, অন্যদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নয়াদিল্লির ‘ওয়ার রুমে’ শীর্ষ পর্যায়ের নীতি নির্ধারকদের সাথে করেছেন রুদ্ধদ্বার বৈঠক।

চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশ দুটির মধ্যকার এ বিরোধ জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন পর্যন্ত গড়িয়েছে। এরকম উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে বিরল এক উদাহরণ সৃষ্টি করলো রাশিয়া। বিবদমান দেশ দুটির সাথে একই সময়ে পৃথকভাবে যৌথ সামরিক মহড়া দিচ্ছে বিশ্বের অন্যতম সামরিক এ পরাশক্তি। এটি শুধু একটি ঘটনা নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতির নির্দেশক। এ মহড়া দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের রাজনীতিতে বন্ধু পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ‘রাজনীতিতে স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু নেই’ কথাটি প্রমাণের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়া হয়ে উঠেছে উজ্জ্বল উদাহরণ।

রাশিয়ার ভ্লাদিভস্তক শহরে গত শুক্রবার (২৩ সেপ্টেম্বর) থেকে শুরু হয়েছে ভারত ও রাশিয়ার যৌথ সামরিক মহড়া। সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অভিযানের ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে এ মহড়ায়। ‘ইন্দ্র-২০১৬’ শীর্ষক এ মহড়ায় অংশ নিয়েছে উভয় দেশের পাঁচশ সেনা। ভারতীয় বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করছে ব্রিগেডিয়ার সুকৃত চাড্ডা কুমায়ন রেজিমেন্টের ২৫০ সেনা। অন্যদিকে রুশ বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করছে দেশটির মোটোরাইজড ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের ২৫০ সেনা। ১১ দিনের এই যৌথ সামরিক মহড়ায় দুই দেশের সামরিক বাহিনী পারস্পরিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পরিচিত হবে। উভয় দেশের সেনা সদস্যরা নিজেদের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করবে।

গত শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) থেকে পাকিস্তানের মাটিতে শুরু হয়েছে পাক-রুশ প্রথম যৌথ সামরিক মহড়া। পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় চেরাটে স্পেশাল ফোর্সেস ট্রেনিং সেন্টারে শুরু হওয়া এ মহড়ার নাম দেয়া হয়েছে ফ্রেন্ডশিপ-২০১৬। মহড়াটি চলবে ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত।

পাক-ভারত উত্তেজনার মধ্যে একদিকে ‘ইন্দ্র-২০১৬’ অন্যদিকে ‘ফ্রেন্ডশিপ-২০১৬’ মহড়া পুতিনের রাশিয়ার এক ব্যতিক্রমী কূটনৈতিক চাল বলেই মনে করা হচ্ছে। যখন সম্ভাব্য ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে রুশ-মার্কিন দুই পরাশক্তি কোন পক্ষে যাবে এ নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা ও বিশ্লেষণ।

পাকিস্তানের সাথে যৌথ সামরিক মহড়া নিয়ে তীব্র আপত্তি তুলেছিল নয়াদিল্লি। কিন্তু আপত্তি অগ্রাহ্য করেছে রাশিয়া। এ মহড়াকে পাকিস্তান ও রাশিয়ার মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কোন্নয়ন এবং দ্বিপক্ষীয় সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির একটি পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

এর মাঝে খবর ছড়িয়েছিল পাকিস্তান-রাশিয়ার এ যৌথ সামরিক মহড়ার একটি অংশ পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের গিলগিট বালটিস্তানের রাট্টু এলাকায় অনুষ্ঠিত হবে। এই খবরে নয়াদিল্লি তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। পরে ভারতে রুশ দূতাবাস এক বিবৃতিতে জানায়, এ খবর ভুল ও ক্ষতিকারক।

রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে ঐতিহাসিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় থেকেই তারা পরস্পরের পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে পরিচিত। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশ দুটি যৌথ নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করে। এতে কোনো পক্ষ বহিরাগত শক্তির আক্রমণের শিকার হলে অপরপক্ষ বন্ধুকে রক্ষায় এগিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দেয়।

সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেয়। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তান ও তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে কথা বলেছিল দেশটি। সোভিয়েত ইউনিয়নের কারণেই যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগর থেকে সপ্তম নৌবহর ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতেও বিভিন্ন সময় ভারতের সাথে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধুত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। দেশ দুটির মধ্যে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ভারত রাশিয়া থেকে বিভিন্ন সময় অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম কিনেছে। উভয় দেশের মধ্যে নিয়মিত যৌথ সামরিক মহড়া হয়ে থাকে।

অন্যদিকে পাকিস্তানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বের সম্পর্কও দীর্ঘদিনের। সত্তরের দশকে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে দেয়ার ক্ষেত্রে মধ্যস্থতা করার মাধ্যমে এ সম্পর্কের সূচনা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশটি পাকিস্তানকে সবধরনের সহায়তা দিয়েছিল। পরবর্তীতে দীর্ঘদিন ধরে আফগানিস্তান ও তৎসংলগ্ন সীমান্তে তালেবান দমনে পাক সরকারকে সর্বোচ্চ সামরিক সহায়তা দেয় মার্কিন প্রশাসন। মার্কিন অর্থ ও অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে ওঠে পাক সেনাবাহিনী।

কিন্তু একুশ শতকের প্রারম্ভে যুক্তরাষ্ট্র যখন দক্ষিণ এশিয়া ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে নজর দেয়া শুরু করে তখন উপমহাদেশের রাজনীতিতেও পরিবর্তন আসে। এ পর্যায়ে মূলত চীনকে সামলাতে ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফলে স্বভাবতই পাকিস্তানের সাথে দেশটির দূরত্ব তৈরি হয়।

যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভারতকে গড়ে তোলার মানসে দেশটির সাথে পারস্পরিক সামরিক, নিরাপত্তা ও পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নে বিলিয়ন ডলারের চুক্তি রয়েছে উভয় দেশের মধ্যে। এ বিশেষ সম্পর্ক রাশিয়া ভালোভাবে নিতে পারেনি। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে এসে দেশটির মধ্যে এ পরীক্ষিত বন্ধুর পরিবর্তে পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যার ধারাবাহিকতায় রাশিয়া প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের সাথে যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে।

তবে, পুরনো বন্ধু ভারতকেও সহসাই ত্যাগ করছে না রাশিয়া। তাই কৌশলগত কারণেই নিয়মিত মহড়ার অংশ হিসেবে ভারতের সাথে যৌথ মহড়া শুরু করেছে সোভিয়েত উত্তরসূরিরা। ভূ-রাজনৈতিক কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বরাবরই বিশ্ব রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই সবসময় বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর তীক্ষ্ণ নজর থাকে এ অঞ্চলের দিকে।

দ্বি-মেরু, এক-মেরু থেকে বিশ্ব এখন বহু মেরুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে রাজনীতিতে যেমন তেমন কূটনীতিতেও ‘স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু নেই’ এই নীতিবাক্যটি বারবার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। তাই একসময়ের পাক-মার্কিন ও ইঙ্গ-রুশ বিশেষ বন্ধুত্ব সময়ের পরিক্রমায় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রভাব বজায় রাখার স্বার্থে আজ অনেকটাই মুদ্রার উল্টো পিঠের মতোই বদলে গেছে।

বর্তমানে ভারত যেমন মার্কিন ছায়ায় নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তেমনি পাকিস্তানও সময়ের প্রয়োজনে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। বিশ্ব রাজনীতির হাওয়া বদলে যুক্তরাষ্ট্রের চির প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়াও এ সুযোগটি লুফে নিয়েছে। কাশ্মীর ইস্যুতে বিবদমান চির বৈরী ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধাবস্থা বিদ্যমান থাকা অবস্থায় উভয় দেশের সাথে যৌথ সামরিক মহড়ার মাধ্যমে এ অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে এ সামরিক পরাশক্তি। পাশাপাশি এ অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান মার্কিন প্রভাবের বিপরীতে নিজস্ব প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখার পুরনো বাসনাতো রয়েছেই। সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

আপনার মন্তব্য

আলোচিত