মিহিরকান্তি চৌধুরী

০৩ মে, ২০২৪ ২০:৩৬

মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি : বিদ্যায়তনিক উৎকর্ষের দুই দশক পার

প্রত্যেক শিক্ষিত ব্যক্তির সামাজিক দায়িত্ব থাকে এবং এই দায়িত্ববোধ থেকে ড. তৌফিক রহমান চৌধুরী তাঁর কয়েকজন সহযোগীর সাথে ২০০৩ সালে মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, সিলেট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ইতোমধ্যে দুই দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে।

আজ ৩ মে ২০২৪ এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ২১তম বর্ষপূর্তি। সিলেট ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা মানচিত্রে আজ মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি একটি উজ্জ্বল স্থান দখল করে আছে। এই শুভ মুহূর্তে সকল স্টেকহোল্ডারকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। বিশেষ শ্রদ্ধা, শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই প্রতিষ্ঠাতা ও বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান ড. তৌফিক রহমান চৌধুরীকে। স্যার, আদাব।   

২০০৩ সালে মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি মাত্র ১৭ জন ছাত্র ও ৭ জন শিক্ষক নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। এই সত্যটি লক্ষ্য করা আনন্দদায়ক যে, বিশ্ববিদ্যালয়টি দুই দশকেরও বেশি সময়ের ব্যবধানে প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থী, শতাধিক পূর্ণকালীন শিক্ষক ও কিছুসংখ্যক অতিথি শিক্ষক নিয়ে উচ্চশিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মেধাবী ও অভিজ্ঞ শিক্ষকদের প্রসারিত প্রচেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয়টির অন্যতম একটি শক্তির জায়গা। বর্তমানে আমাদের চারটি অনুষদের অধীন সাতটি বিভাগ রয়েছে।

আধুনিক শিক্ষার ন্যূনতম পরিপূর্ণতা এবং তা থেকে অর্জিত সন্তুষ্টি একজন ছাত্রকে সমাজ ও মানুষের সার্বিক কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করতে উৎসাহিত করে। ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রসারিত মানসম্পন্ন শিক্ষা বিগত একুশ  বছরে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে একটি ফ্রন্টলাইন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আবির্ভূত হতে সাহায্য করেছে। এটি শুধু শিক্ষার গুণগতমানে নয়, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও গবেষণার ক্ষেত্রেও অনেক অবদান রেখেছে। এই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রায় ছাত্রসমাজ এবং তাদের পরিবারের পাশাপাশি সুশীল সমাজ এবং সরকারের একাডেমিক প্রশাসনের বিভিন্ন স্তর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সংশ্লিষ্ট সকলের অব্যাহত সমর্থন ও সহযোগিতা আমাদের ভবিষ্যৎকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে সাহায্য করেছে।

দারুণ সাফল্যের সঙ্গে মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি তিনটি সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম সমাবর্তনে ৪৮২ জন, ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সমাবর্তনে ১৩৮২ জন এবং ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সমাবর্তনে ১৮৭০ জন শিক্ষার্থী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০২৪ সালের ২ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য চতুর্থ সমাবর্তনে প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের জন্য অপেক্ষমান।

দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট পণ্ডিতগণ এবং শিক্ষায় আগ্রহী সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল, উপদেষ্টা বোর্ড এবং সিন্ডিকেটে পদ পেয়েছেন। ট্রাস্টি বোর্ড শিক্ষিত ব্যক্তিত্ব এবং বিবেকবান সামাজিক কর্মীদের নিয়ে গঠিত। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন দ্বারা পর্যবেক্ষণ করা উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়ন প্রকল্প (HEQEP) এর অধীনে প্রাতিষ্ঠানিক গুণমান নিশ্চিতকরণ সেল (IQAC) উপলব্ধ প্রোগ্রাম এবং সুবিধাগুলোর গুণগত দিক দেখাশোনা করে।
যদিও এটি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, এই প্ল্যাটফর্মটি ব্যক্তিগত পছন্দ এবং নির্দেশিকা দ্বারা পরিচালিত নয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রশাসনের বিভিন্ন স্তর থেকে নির্দেশনা ও নির্দেশিকা প্রদান করা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় এই নির্দেশিকাগুলি অনুসরণ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক শিক্ষা এবং ছাত্র ও শিক্ষক উভয়ের গবেষণার ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট জায়গা রয়েছে। ছাত্র এবং শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে এবং দেশ ও বিদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনার এবং কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন। বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে ইচ্ছুক শিক্ষকদের ছুটি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়।

ইউনিভার্সিটির শিক্ষাদান কার্যক্রমের একটি উপাদান হল অভিজ্ঞ এবং তরুণ কিন্তু মেধাবী শিক্ষকদের দল। তাঁরা ক্লাসরুমের বাইরে এবং পরীক্ষাগারে শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভা জাগিয়ে তুলতে অত্যন্ত আন্তরিক এবং সফল। দেশ ও বিদেশে বিভিন্ন সেক্টরে মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা নিয়োগ পাচ্ছেন। বিগত কয়েক বছরে আমাজন, গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানেও অনেক মেধাবী গ্র্যাজুয়েট নিযুক্ত হয়েছেন, আরও অনেকে অপেক্ষমান। এসব সাফল্যের পেছনে প্রধান কারণ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের নিয়োগ স্বচ্ছ ও প্রেরণাদায়ক। ইউনিভার্সিটির রয়েছে উন্নত সিলেবাস, দক্ষ ও মেধাবী শিক্ষক, আধুনিক পরিবেশ। ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস সংগঠনমুক্ত,  সেশন-জ্যাম মুক্ত, রাজনীতি মুক্ত, সন্ত্রাস মুক্ত, ধূমপান মুক্ত এবং র‌্যাগিং মুক্ত।

ইউনিভার্সিটির দুটি জার্নাল আছে, নিয়মিত বিরতিতে প্রকাশিত হয়। ওয়াইফাই সুবিধাসহ উন্নত কম্পিউটার এবং বৈদ্যুতিক ল্যাব (৮টি), নেতৃত্বের প্ল্যাটফর্ম, স্পোর্টস ক্লাব, টেলিভিশন কর্নার, ক্যান্টিন, ওয়াল ম্যাগাজিন, বই প্রদর্শনী, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, সেমিনার, পিকনিক, ইনডোর এবং আউটডোর গেমস, রোভার স্কাউটস, রক্তদান কর্মসূচি, ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, সাংস্কৃতিক ক্লাবসহ । গ্রন্থাগারে বইপুস্তক বৃদ্ধির ও  পুরো কাঠমোর গুণগত মান বাড়ানোরও কাজ চলছে।  

বিভিন্ন জাতীয় দিবস নিয়মিতভাবে পালিত হয় যখন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ, কবি, সাহিত্য বিশেষজ্ঞ, সমালোচক, মন্ত্রী, আমলা ও টেকনোক্র্যাটরা নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন।

মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি নিয়ম-কানুন মেনে চলার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রক্টোরিয়াল বডি প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক শৃঙ্খলা পরিচালনা করে।প্রায় সাড়ে চার বছর আগে মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি বটেশ্বরে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার স্থানান্তরিত হয়েছে। সিলেট শহরের উপকণ্ঠে বটেশ্বরে অবস্থিত স্থায়ী ক্যাম্পাসে প্রায় নয় একর জমির একটি অসাধারণ অবস্থান একটি আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদান করার জন্য উপযুক্ত এবং প্রশস্ত।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ব্যাকরণভিত্তিক বিদ্যায়তনিক উৎকর্ষ বা অ্যাকাডেমিক এক্সেলেন্স অর্জনে প্রতিষ্ঠাতা ও বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান ড. তৌফিক রহমান চৌধুরীর দিক নির্দেশনায় ইউনিভার্সিটির যাত্রা এগিয়ে চলছে। তাঁর দূরদৃষ্টি, নৈর্বক্তিক বিচারবোধ ও ভাবনা, কর্পোরেট জ্ঞান, বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় দক্ষতা, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগাযোগে ভাষা ও আবেগের সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, সমাজের সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্যতা এবং শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি দায়িত্ববোধ তাঁর প্রোফাইলের উল্লেখযোগ্য দিক। করোনাকালীন সারা পৃথিবীতে, বাংলাদেশে অনেক প্রতিষ্ঠানে কর্মী ছাটাই করা হয়েছিল সেখানে মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির কেউ চাকরিচ্যূত হননি। মহাদুর্দিনেও তিনি শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিয়ে গেছেন। আমদানি কম ছিল। আয় দিয়ে ব্যয় চলত না। অনেক ক্ষেত্রে নিজের ও পরিবারের অন্য সদস্যদের ভাণ্ড ভেঙ্গে অর্থের যোগান দিয়েছেন। সুবিধাভোগী শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ তাঁর এই বদান্যতার কথা কৃতজ্ঞচিত্তে নিরন্তর মনে রেখেছেন। আশার কথা, চেয়ারম্যান স্যারের ছেলে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের ভাইস চেয়ারম্যান জনাব তানভীর চৌধুরী পিতার বোধ ও ভাবনা ধারণ করেন, অনুরূপ চিন্তা করেন, করেন কাজ। পিতাপুত্র সম্বন্ধে আমার একটি ধারণা  ইউনিভার্সিটিতে অনেকের সাথে শেয়ার করেছি। সেটা হল, ‘টু বডি, ওয়ান মাইন্ড’। এবিষয়ে সবাই একমত।

 ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মোহাম্মদ জহিরুল হক একজন পণ্ডিত ব্যক্তি, দুইবারের কমনওয়েলথ স্কলার। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় শিক্ষকতা করার পর চার বছরের জন্য ভাইস চ্যান্সেলর নিযুক্ত হয়েছেন। তিনি চেষ্টা করছেন তাঁর জায়গা থেকে ইউনিভার্সিটির মান বৃদ্ধি করার।

প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. সুরেশ রঞ্জন বসাকও একজন পণ্ডিত ব্যক্তি, বাংলাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত। তিনিও যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন ইউনিভার্সিটির প্রোফাইলকে সমৃদ্ধ করার। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর পাণ্ডিত্য জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃত। ট্রেজারার প্রফেসর ড. মো. তাহের বিল্লাল খলিফা ইউনিভার্সিটিতে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত। অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন- বিভাগীয় প্রধান, ডিন, আইকিউএসির পরিচালক, বর্তমানে ট্রেজারার। ইউনিভার্সিটির মানবৃদ্ধিতে তাঁর ব্যাপক অবদান আছে এবং তিনি নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন।

প্রশাসনে রেজিস্ট্রার জনাব তারেক ইসলামের নেতৃত্বে কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করছেন। রেজিস্ট্রার মহোদয় অভিজ্ঞ লোক, একসময় ছিলেন ব্রিটিশ কাউন্সিলের হেড অব এক্সাম। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জনাব মকসুদ আহমেদ একজন আইটি বিশেষজ্ঞ যার জন্য তাঁর পদে তিনি সেইরকম মানানসই। অর্থ পরিচালক জনাব মো. ইনামুল হক ইউনিভার্সিটির একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মকর্তা। ইউনিভার্সিটির শুরু থেকেই তিনি আছেন। ইউনিভার্সিটির একটি পয়সাও যাতে অপচয় না হয় সে ব্যাপারে তিনি তৎপর। তাঁর নিবেদন প্রশংসার দাবী রাখে। সবচেয়ে বড়ো কথা হল, এখানকার শিক্ষার্থীরা আধুনিকতামনষ্ক অনিসন্ধিৎসু শিক্ষার্থী। ইউনিভার্সিটির অ্যালাইনাই খুব শক্তিশালী প্লাটফর্ম। সকল স্টেকহোল্ডারের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে পারলে মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি উচ্চশিক্ষার জাতীয় মানচিত্রে বিশেষ জায়গা দখল করে নেবে।

মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটিতে আমার দশ বছরের পেশাগত জীবনে অনেক ইতিবাচক ঘটনা, বোধ ও ভাবনার সাথে সম্পৃক্ত হয়েছি, হয়েছি অ্যাকাডেমিক বহুমাত্রিকতার এক নীরব সাক্ষী। ধারণা বেড়েছে, অভিজ্ঞতা বেড়েছে, বেড়েছে জীবনবোধ। এই দশ বছর জীবনের অন্যতম সেরা এক দশক। অনেক কিছু শিখেছি, প্রস্তুতি নিয়েছি নতুন আরও শেখার। আগামীতে “মাই মেট্রো ডেজ” গ্রন্থে মধুর দিনসদৃশ মিষ্টি বিস্কুটগুলোর কথা সবিস্তারে লিখব, নোনতা বিস্কুট খুব একটা নেই, দুচারটা।  

লেখক পরিচিতি: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, সিলেট এবং লেখক, অনুবাদক ও নির্বাহী প্রধান, টেগোর সেন্টার, সিলেট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত