নিউজ ডেস্ক

২৮ জানুয়ারি, ২০১৫ ১৯:১৮

খালাস চেয়ে যুদ্ধাপরাধি আজহারের আপীল

রাজাকার আজহারের নেতৃত্বেই বৃহত্তর রংপুরে গণহত্যা চালিয়ে ১৪ শ’র বেশি মানুষকে হত্যা, বহু নারীকে ধর্ষণ ও অপহরণ, নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল বলে ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত হয়েছে

মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার দায়ে প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধি জামায়াতের সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর দেওয়া ফাঁসির দণ্ডের বিরুদ্ধে আপীল করেছেন তার পক্ষের আইনজীবিরা। বুধবার (২৮ জানুয়ারি) তারা উচ্চ আদালতে এই আপীল আবেদন দাখিল করেন। 

যুদ্ধাপরাধি আজহারের  পক্ষে অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড জয়নুল আবেদীন তুহিন বুধবার আপিলের নথিপত্র সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় জমা দেন।

প্রসিকিউশনের আনা ছয় অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ তাকে এই দণ্ড দেয়।জামায়াতের আজকের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহার একাত্তরে ছিলেন ইসলামী ছাত্র সংঘের রংপুর জেলা কমিটির সভাপতি।

সে সময় তার নেতৃত্বেই বৃহত্তর রংপুরে গণহত্যা চালিয়ে ১৪শ’র বেশি মানুষকে হত্যা, বহু নারীকে ধর্ষণ ও অপহরণ, নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল বলে ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত হয়েছে।     

এটিএম আজহারুল ইসলামের সর্বোচ্চ সাজার রায় এসেছে রংপুর অঞ্চলে গণহত্যা চালিয়ে অন্তত ১৪০০ লোককে হত্যা এবং ১৪ জনকে খুনের অপরাধে। প্রসিকিউশনের ভাষ্য, সংখ্যার দিক থেকে এত বড় গণহত্যার বিচার এ ট্রাইব্যুনালে আর হয়নি।

১৯৬৮ সালে রংপুর জিলা স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করে পরের বছর আজহারুল ইসলাম ভর্তি হন রংপুর কারামাইকেল কলেজে। একত্তরে বাঙালি যখন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, আজহার তখন জামায়াতের সেই সময়ের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের জেলা কমিটির সভাপতি হিসাবে আলবদর বাহিনীর রংপুর শাখার কমান্ডার।

বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম দমনে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা দিতে শীর্ষ জামায়াত নেতাদের তত্ত্বাবধানে এই সশস্ত্র দলটি গড়ে তোলা হয়। পাকিস্তানি বাহিনী সে সময় রংপুর টাউন হলকে  নির্যাতন কেন্দ্রে পরিণত করে এবং বৃহত্তর রংপুরের বিভিন্ন জায়গা থেকে স্বাধীনতার পক্ষের লোকজনকে ধরে এনে সেখানে নির্যাতন করা হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশে জিয়াউর রহমানের আমলে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হওয়ার পর দলের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন আজহার। ১৯৯১ সালে তিনি ঢাকা মহানগর জামায়াতের আমিরের দায়িত্ব পান এবং ২০০৫ সালে কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হন।


যুদ্ধাপরাধি আজহারের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ:

১২ নভেম্বর ২০১৩ এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল -১। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইন ১৯৭৩ এর ৩২/এ, ৩২/সি, ৩২/ডি, ৩২/জি ও ৩২/এইচ এবং ৪/১ ও ৪/২ ধারা সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি মোতাবেক ৬টি অভিযোগ আনা হয়েছিল আজহারুলের বিরুদ্ধে। অপরাধ সংঘটনের সময়সীমা ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত। 

অভিযোগে বলা হয়, রংপুরের কারমাইকেল কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে আজহার জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামি ছাত্রসংঘের রংপুর শাখার সভাপতি ও ওই জেলার আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। রংপুর ক্যান্টনমেন্টে যাতায়াতের মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন। আজহার মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের স্বজন, মুক্তিকামী বাঙালি এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে দিতেন এবং তাদের হত্যা, গণহত্যা, আটক ও নির্যাতনে পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র করে তা বাস্তবায়নে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকতেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র ও তা বাস্তবায়নে সক্রিয়ভাবে জড়িত থেকে এসব অপরাধ সংঘটন করেন এটিএম আজহারুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় আলবদরের নেতৃত্বে থাকায় তার বিরুদ্ধে উর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায় আনা হয়।

প্রসিকিউশনের আনা ছয় অভিযোগের মধ্যে ২, ৩, ৪ ও ৫ নম্বর অভিযোগ আদালতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগে ঝাড়ুয়ার বিল ও দমদম ব্রিজে গণহত্যা এবং ৫ নম্বর অভিযোগে ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে।

৬ নম্বর অভিযোগে অপহরণ ও আটকে রেখে নির্যাতনের ঘটনায় আসামির জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে।

আর ১ নম্বর অভিযোগ প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে না পারায় আজহারকে খালাস দিয়েছে আদালত।

রায়ের পর প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বলেন- “ট্রাইব্যুনালে যতগুলো বড় গণহত্যার ঘটনার বিচার হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে ঝাড়ুয়ার বিলের গণহত্যা। সংখ্যার দিক থেকে এত বড় গণহত্যার বিচার ট্রাইব্যুনালে হয়নি।”

অভিযোগ-১
১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ থেকে ২৭ মার্চের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ভাসানী ন্যাপ নেতা ও রংপুর শহরের বিশিষ্ট আয়কর আইনজীবী এ ওয়াই মাহফুজ আলীসহ ১১ জনকে অপহরণ, আটক শারিরীক নির্যাতন করা হয়। এরপর তাদের ৩ এপ্রিল রংপুর শহরের দখিগঞ্জ শ্মশানে নিয়ে ব্রাশফায়ার করে গণহত্যা চালানো হয়।


অভিযোগ- ২
আজহারুল ইসলাম একাত্তরের ১৬ এপ্রিল তার নিজ এলাকা রংপুরের বদরগঞ্জ থানার ধাপপাড়ায় ১৫ জন নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালিকে গুলি করে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করেন।

অভিযোগ- ৩
আজহারুল ইসলাম একাত্তরের ১৭ এপ্রিল নিজ এলাকা রংপুরের বদরগঞ্জের ঝাড়ুয়ারবিল এলাকায় এক হাজার ২০০ বেশি নিরীহ লোক ধরে নিয়ে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করেন।

অভিযোগ- ৪
আজহারুল ইসলাম একাত্তরের ১৭ এপ্রিল কারমাইকেল কলেজের চারজন অধ্যাপক ও একজন অধ্যাপকের স্ত্রীকে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে অপহরণ করে দমদম ব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেন।

অভিযোগ- ৫
আজহারুল ইসলাম একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে রংপুর শহর ও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মহিলাদের ধরে এনে টাউন হলে আটকে রেখে ধর্ষণসহ শারীরীক নির্যাতন চালান। একই সঙ্গে মহিলাসহ নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিদের অপহরণ, আটক, নির্যাতন, গুরুতর জখম, হত্যা ও গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন আজহারুল ইসলাম।

অভিযোগ- ৬
একাত্তরের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে রংপুর শহরের গুপ্তপাড়ায় একজনকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। একই বছরের ১ ডিসেম্বর রংপুর শহরের বেতপট্টি থেকে এজনকে অপহরণ করে রংপুর কলেজের মুসলিম ছাত্রাবাসে নিয়ে আটক রেখে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন ও গুরুতর জখম করেন আজহারুল ইসলাম।





আপনার মন্তব্য

আলোচিত