জৈন্তাপুর প্রতিনিধি

১৭ এপ্রিল, ২০২৪ ২২:০৫

এইদিনে জৈন্তাপুরে হত্যা করা হয় ১৭ চা শ্রমিককে

আজ ১৭ এপ্রিল (বুধবার) সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার হেমু গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে ১৭ জন নিরীহ চা শ্রমিককে একসঙ্গে হত্যা করেছিল পাকহানাদার বাহিনী। এত লাশ একসঙ্গে দাফন কিংবা সৎকারের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় হেমু ভাটপাড়া গ্রামের করিচ নদীর পাশের একটি গর্তে ফেলে দেয়া হয় চা শ্রমিকদের লাশ।

সেই বিভীষিকা দিনের কথা স্মরণ হলে আজো কেঁপে ওঠেন অনেকেই। অথচ প্রতি বছর নীরবেই কেটে যায় দিনটি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার চুয়ান্ন বছর হলেও এখনও গণহত্যার স্থানগুলো চিহিৃত করে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা যায়নি। এই গণহত্যার স্বীকৃতিও মেলেনি।

স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ১৭ নয়, এখানে ১৬২ জন চা শ্রমিককে হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকজনের পরিচয় মিললেও সরকারি তালিকায় নাম ওঠেনি কারও। ৫৪ বছরেও মেলেনি শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি।

এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানা যায়, হেমু ভাটপাড়া গ্রামের পাশেই চালানো হয় এক পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ। পুকুর,খাল, বিলের কচুরিপানায় লুকিয়েও রেহাই পায়নি অনেকেই। সে দিন ১৬২ জন চা শ্রমিক সহ সাধারণ মানুষকে হত্যা করে উল্লাসে মেতে উঠেছিলো পাকহানাদার বাহিনী।

হেমুর করিচ নদী থেকে অন্তত পাঁচ কিলোমিটার দূরে সবুজ ছায়া ঘেরা চিকনাগুল খান চা বাগান। এই বাগানের মালিক ছিলেন আতাহার আলী খাঁন। তিনি ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের বাসিন্দা। সেই চা বাগানের সবুজ চা পাতায় টকটকে লাল একটি ইতিহাস অনেকটা বিস্মৃতির আড়ালেই রয়ে গেলো যুগ যুগ ধরে।

 সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার হেমু করিচ নদীর পাশের একটি গর্তে সমাহিত আছেন পাকিস্তানী সেনাদের হাতে নিহত ১৭ জন শহীদ চা শ্রমিক। কিন্তু, স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও এই গণহত্যার স্বীকৃতি মেলেনি।
৫ নম্বর সেক্টরের সিলেট-জৈন্তাপুর সড়কটি ধরেই ভারতের মুক্তাপুর সীমান্ত। ১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল যুদ্ধের সময় হেমু গ্রামটি বেশ কিছু কারণে পাকিস্তানীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে তারা ভারী অস্ত্র নিয়ে হেমু অঞ্চলের আশপাশে অবস্থান নেয়।

১৭ এপ্রিল এই অঞ্চলের হেমু, হরিপুর সহ বিভিন্নস্থানে দেশিয় দোসরদের সহযোগিতায় হত্যাযজ্ঞ নির্বিচারে হত্যাসহ নানা রকম পৈশাবিক নির্যাতনে মেতে ওঠে পাকহানাদার বাহিনী। যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে নিরীহ চা শ্রমিকদের জীবনের প্রতি মায়া বাড়ায়। এক পর্যায়ে তারা ভারতে পালিয়ে যাবার সংকল্প করে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী চা শ্রমিকরা ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে রওয়ানা করে জৈন্তাপুর অভিমুখে। স্থানীয় রাজাকাররা সেই খবর পৌঁছে দেয় পাকিস্তানীদের কাছে। করিছ নদীর উপর বেইলী ব্রীজের কাছে আসা মাত্র স্থানীয় শ্রমিকদের ঘেরাও করে ফেলে পাকিস্তানীরা। বহু শ্রমিকের মধ্যে যুবক দেখে ১৭ জনকে আটকরে বাকিদের বাগানে ফিরে যেতে বলে। তারপর ঘটে সেই নির্মমতা। সবাইকে গুলি করে হত্যা করা হয় এক সাথে।

সেদিনের সেই হত্যার সাক্ষী হয়ে আজো বয়ে যাচ্ছে খরশ্রুতা করিচ নদী। আরো সাক্ষী হয়ে আছেন মুক্তিযোদ্ধাসহ আশপাশের অনেক মানুষ। যারা এখনো সেই ঘটনার জন্য আফসোস করেন।

তৃণমূল পর্যায়ে তথ্যনুসন্ধান চালিয়ে এই গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু সরকারি ভাবে আজও এই গনহত্যায় শহীদ হয়েছেন তা এখনো জানাযায়নি।

প্রত্যক্ষদর্শী হেমু নমঃশুদ্র পাড়ার পুলিন সরকার (৬৫) বলেন, ৫ নম্বর সেক্টরের সিলেট-জৈন্তাপুর সড়কটি বেইলী ব্রীজের পাশে পাক বাহিনি আস্থানা তৈরী করে। আমরা তখন ভয়ে আড়াল থেকে দেখতাম। অনেকের মতো আমরাও আশ্রয় নেই। ১৭ এপ্রিল দুপুরে শুরুহয় গুলির শব্দ। বিকেলের মধ্যে পাক বাহিনি গুলি চালিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে সাধারন মানুষকে। পরে চা বাগানের কয়েকজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেছি।

তিনি বলেন, যেদিন শ্রমিকদের গুলি করে হত্যা করা হয় তখন আমি কিশোর। বর্তমান সরকারের আমলেও এখানকার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কিংবা ১৬২ জনের মধ্যে পরিচয় পাওয়া ব্যক্তি আজো শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি মেলেনি। এতে আমরা হতাশ।

লেখক, কবি মোহাম্মদ জোয়াহিদ তিনি গণকবর দেখিয়ে বলছিলেন- ‘আমরা গণকবরের পাশ দিয়ে গেলে এখনো মনে করি কে যেনো কান্না করছে। সেই কান্নার পাশে কেউ দাঁড়ালো না ৫৪ বছরেও। কয়েক বছর আগেও ভারি বৃষ্টিপাত হলে মাথার খুলি, হাঁড় ভেসে উঠতো বিশাল সেই গর্ত থেকে। এখনো খনন করলে পাওয়া যাবে’।

হেমু গ্রামে চা শ্রমিকদের নির্মমভাবে হত্যার কথা আজো ভুলেননি ফতেহপুর ইউনিয়নের বাগরখাল গ্রামের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ছলিম উল্লাহ। তিনি বলেন, ‘৫৪ বছর হয়ে গেছে। অথচ আজ পর্যন্ত সেই হেমুর গণহত্যার জায়গাটি রক্ষার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘যারা শহীদ হয়েছেন তাদের আত্মা শান্তি পেতো, এই স্মৃতি রক্ষা করা হলে। বৃহত্তর জৈন্তাপুরের মধ্যে বড় গণহত্যা এটি। অথচ আজ পর্যন্ত কেন কেউ এগিয়ে আসছেনা, বিষয়টা আমাদের আহত করে।

হেমুর করিছ নদীর পাশের এই গণহত্যার ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই কারো কাছে। এমনকি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছেও পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় তরুণ গবেষক আব্দুল হাই আল হাদি’র তথ্যের উপর ভর করেই এই গণহত্যার কিছু অজানা তথ্যের সন্ধান পাওয়া।

তরুণ গবেষক আব্দুল হাই আল হাদি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের দলিলাদি ঘেঁটে গণহত্যার জায়গাটি আবিষ্কার করি। এটি কেন সংরক্ষণ করা গেল না, তা ৫৪ বছর ধরে অজানাই রয়ে গেলো।’

এ প্রসঙ্গে ৫ নম্বর সেক্টরের আরেক মুক্তিযোদ্ধা, সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সিলেট জেলার আহবায়ক মো. লুৎফুর রহমান লেবু জানান, এ ঘটনা সম্পর্কে আমিও অবগত। কিন্তু সংরক্ষণ না করায় নতুন প্রজন্ম একটি ইতিহাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জার।

খান চা বাগানের শ্রমিকদের হত্যাটি উঠে আসে লেখক গবেষক তাজুল মোহাম্মদ এর ‘সিলেটে গণহত্যা’ গ্রন্থে। সেই গ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠায় তিনি ১৭ জন তরুণ চা শ্রমিককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার বর্ণনা দিয়েছেন। একইদিন হেমু গ্রামে পাক বোমারু বিমানের সেলিংয়ে নিহত আরো ১১ জনের নামও উল্লেখ করেন সেখানে।
সেই হত্যার শিকার ১৭ জনের মধ্যে ১৩ জনের নাম পাওয়া যায় তাজুল মোহাম্মদের গ্রন্থে। তারা হলেন-বংশী মাঝি, নন্দলাল বাড়াই, অগ্ন করুয়া, ছিকরা করুয়া, মিকরা করুয়া, বুধু সাওতাল, আকালী ভুইয়া, পুযুয়া করুয়া, ছম্না করুয়া, রামচান্দ করুয়া, হীরালাল করুয়া, মংরু কর্মকার ও ভীম করুয়া। এছাড়া ওইদিন হেমু গ্রামে পাক বোমারু বিমানের সেলিংয়ে আরো ১১ জন মানুষের মৃত্যুর বর্ণনাও রয়েছে সেই সিলেটে গণহত্যায়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত