সিলেটটুডে ডেস্ক

০৯ মে, ২০১৬ ২৩:১০

‘দোষ স্বীকার করেছেন নিজামী’

‘মানবতাবিরোধী গণহত্যার মতো অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অপরাধে নিজামী দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। তার আইনজীবী শুধু গলা বাঁচাতে দণ্ড কমানোর আবেদন করেছিলেন। এতে প্রমাণিত হয়, নিজামী নিজের দোষ স্বীকার করেছেন।’ একাত্তরে যুদ্ধাপরাধী আলবদর বাহিনী প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ডে রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে সর্বোচ্চ আদালত এ কথা বলেন। সোমবার ২২ পৃষ্ঠার এই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।

গত ৫ মে আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে করা পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে নিজামীর ফাঁসি বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের বেঞ্চ এ রায় দেন। বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। মুক্তিযুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা, নিজ এলাকায় গণহত্যা এবং ধর্ষণের দায়ে নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

সোমবার আপিল বিভাগে রিভিউ খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়েছে, ‘আলবদর প্রধান হিসেবে ওই বাহিনীর সঙ্গে মতিউর রহমান নিজামী নিজেই শুধু অংশগ্রহণ করেননি, বরং দলের নেতাকর্মীদের উৎসাহিত করেছেন। আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে রিভিউর নথি পর্যালোচনা করেছি। কিন্তু রিভিউ গ্রহণ করার মতো কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি।’

মতিউর রহমান নিজামী যে তিনটি অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পান, সেই তিনটি অভিযোগেই শুধু রিভিউ করেছেন এবং দণ্ড কমানোর আবেদন করেছেন। কিন্তু রিভিউ গ্রহণ করার মতো ব্যতিক্রমী কোনো যুক্তি পাওয়া যায়নি; বরং বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে তার সরাসরি অংশগ্রহণের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ কারণে তাকে পূর্ণাঙ্গ রায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।

এর আগে চলতি বছরের ১৫ মার্চ আপিল বিভাগের দেওয়া নিজামীর রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কোনো ব্যক্তির সামান্যতম অংশগ্রহণ প্রমাণিত হলেও তার প্রতি আদালতের ‘চুলপরিমাণ করুণা’ দেখানোর সুযোগ নেই।

মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমানোরও যুক্তি নেই। তাই একাত্তরে মতিউর রহমান নিজামীর অমানবিক ও নৃশংস আচরণের কারণে তার প্রতি অনুকম্পা দেখানোর কোনো অবকাশ নেই।

আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছিলেন, অপরাধের মাত্রা বিবেচনা করে যথাযথ শাস্তি দেওয়া সর্বোচ্চ আদালতের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। কোনো অভিযুক্তকে ত্রুটিপূর্ণ দণ্ড দিলে ভুক্তভোগী, এমনকি সমগ্র সমাজের ওপর তার বিরূপ প্রভাব পড়ে। নিজামীকে তিন ধরনের অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। নিজামীর নেতৃত্বাধীন ও পরিকল্পিত এ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড কেবল ভুক্তভোগীর নিকটাত্মীয়ের হৃদয় বিদীর্ণ করে না, পুরো সমাজ প্রকম্পিত ও ব্যথিত হয়।

আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের পর বহু বছর ধরে দেশ-জাতি প্রকৃত অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। তাই একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে কোনো অভিযুক্তের সামান্যতম অংশগ্রহণ থাকলেও তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

ওই পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, ৪০ বছরেরও পরে নিজামীর বিচার হয়েছে। এত পুরনো মামলায় তথ্য-উপাত্ত, সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা রাষ্ট্রপক্ষের জন্য কঠিন কাজ। এরই মধ্যে অনেক তথ্য-উপাত্ত নষ্ট হয়ে যায়। প্রকৃত সাক্ষীরাও মারা গেছেন। অনেক সাক্ষী বয়সের ভারে যথাযথ সাক্ষ্য দিতে পারেননি। বহু অসুবিধা থাকার পরও রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা নিজামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন। নিজামীর মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য-প্রমাণে আংশিক বৈপরীত্য আছে। সেই বৈপরীত্য আপিল বিভাগ বিচক্ষণতার চোখে বিশ্লেষণ করেছেন। বিশ্লেষণে ‘বড় ভুল’ ধরা পড়েনি। তাই নিজামী যে আলবদর বাহিনীর নেতা ছিলেন এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল পরিকল্পনা করেছিলেন, তাতে সামান্যতম সন্দেহ দেখা দেয়নি। সাক্ষ্য-প্রমাণে দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে, নিজামীর নির্দেশে আলবদর সদস্যরা চিকিৎসক আবদুল আলীম চৌধুরীকে হত্যা করেছিল।

‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দালাল আইনে কিছু মামলা হয়েছিল, সেখানে নিজামীর নাম ছিল না। এমনকি আলবদর বাহিনীর সদস্যদের যে পরিচয়পত্র ছিল, তাতে নিজামীর স্বাক্ষর ছিল না’- আসামিপক্ষের এই যুক্তি একেবারে খোঁড়া। এটা বিবেচনার অযোগ্য যুক্তি বলে পর্যবেক্ষণ দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত