নিজস্ব প্রতিবেদক

১১ মে, ২০১৬ ০০:১০

কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী নিজামীর ফাঁসি কার্যকর

ইতিহাসের দায়মুক্তি

কলংকমোচনের পথে আরেক ধাপ এগোলো বাংলাদেশ। ফাঁসিতে ঝুলানো হলো কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীকে। একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাবনা এলাকায় যে 'মইত্যা রাজাকার' নামে আতংক  ছিল।

বুধবার প্রথম প্রহরে (মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২ টা ১o মিনিটে) ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত ইসলামের  আমীর দেশের মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করে।

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬ টি অভিযোগ এনে প্রসিকিউশন। এরমধ্যে ৩ অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। যা রিভিউ আপিলেও বহাল থাকে।

সকল আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই ফাঁসিতে ঝুলানো হয় এই বদরপ্রধানকে। নানা ষড়যন্ত্র, ছলচাতুরী আর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করেও ফাঁসির দড়ি এড়াতে পারেননি নিজামী।

এর আগে এই কারাগারেই একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে। এরপর ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল রাতে দলটির আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে কারা কর্তৃপক্ষ।

এরপর ২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের করা রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন খারিজ হয়। এরপর ২১ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দণ্ড কার্যকর হয়।

এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, নিজামী প্রাণভিক্ষা চাননি। এরপর আইন অনুযায়ী যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।

এর আগে জামায়াতও বিবৃতি দিয়ে জানায়, দলের আমির নিজামী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন না। শুক্রবার গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে স্ত্রীসহ তার পরিবারের ১০ সদস্য সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এ সিদ্ধান্তের কথা জানান।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে প্রথমে কৃষিমন্ত্রী হন মতিউর রহমান নিজামী। এরপর তাকে শিল্পমন্ত্রী করা হয়। চট্টগ্রামে আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার বিচারের রায়ে ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। ওই মামলাটি বর্তমানে হাইকোর্টে বিচারাধীন।

সর্বোচ্চ আদালতে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে নিজামীর ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ হয় গত বৃহস্পতিবার (৫ মে)। বিচারকদের সইয়ের পর ওই রায়ের প্রত্যায়িত কপি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে সোমবার রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে।

পরে কারা কর্তৃপক্ষ নিজামীকে আদেশ পড়ে শোনান। সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার বিষয়ে নিজামীর কাছে জানতে চাওয়া হয়। মঙ্গলবারও একাধিকবার কারা কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা করা না করার বিষয়টি জানতে চাইলেও নিজামী তাতে সাড়া দেননি।

এরপরই জামায়াতের আমির নিজামীর দণ্ড কার্যকরের চূড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু হয়। দণ্ড কার্যকরের নির্বাহী আদেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর স্বাক্ষরের পর তা মঙ্গলবার রাতে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত নিজামীকে ফাঁসির রশিতে ঝুলতে হয়েছে মঙ্গলবার মধ্যরাতে। পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্মিত স্থায়ী ফাঁসির মঞ্চে দণ্ড কার্যকর করে তাকে ২০ মিনিট ঝুলিয়ে রাখা হয়। ফাঁসির মঞ্চ থেকে নামানোর পর চিকিৎসক নিজামীর মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এরপর ময়নাতদন্ত ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষে মরদেহ অ্যাম্বুলেন্সে পুলিশি পাহারায় তার গ্রামের বাড়ি পাবনার সাঁথিয়ায় পাঠানো হবে।

কারা কর্মকর্তারা জানায়, সন্ধ্যার পর থেকে একে একে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশ করেন অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল ইকবাল হাসান, ঢাকার জেলা প্রশাসক মো. সালাউদ্দিন, গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ডিসি শেখ নাজমুল আলম, সিভিল সার্জন ডা. আবদুল মালেক মৃধা, কারা চিকিৎসক, দুই ম্যাজিস্ট্রেট এবং ইমাম মনির হোসেন।

কারা কর্তৃপক্ষের ফোন পেয়ে রাত ৮টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যান নিজামীর স্ত্রী, ছেলে-মেয়েসহ ২৬ স্বজন। এসময় তাদের অনেকে বিজয়সূচক 'ভি চিহ্ন' দেখান। 'শেষ সাক্ষাৎ' শেষে তারা রাত সাড়ে ৯টার দিকে বেরিয়ে আসেন। তবে নিজামীর স্বজনরা কারা ফটকে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের কাছে কোনো মন্তব্য করেননি।

কারাগার থেকে বের হওয়ার পর নিজামীর স্বজনদের বহনকারী গাড়ি কেউ কেউ ধাওয়া করে 'ভুয়া ভুয়া' বলে স্লোগান দেয়। তবে কারা ফটকে নিজামীর আইনজীবী প্যানেলের সদস্য মোস্তফা শাকের উল্লাহ বলেন, 'দণ্ড কার্যকর ঘিরে নিজামীর পরিবারের সদস্যদের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।'

এরপর রাত ১১টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের রজনীগন্ধার ৭ নম্বর সেলে বন্দি নিজামীকে গোসল করানো হয়। এরপর তিনি নামাজ আদায় করেন। পৌনে ১২ দিকে কেন্দ্রীয় কারা মসজিদের ইমাম মনির হোসেন তাকে তওবা পড়ান। এরপর তাকে ফাঁসির মঞ্চে নেওয়া হয়। প্রথা অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীর কবীর তার হাতে রাখা একটি সাদা রুমাল মাটিতে ফেললে প্রধান জল্লাদ তানভীর হাসান রাজু ফাঁসির মঞ্চের লিভার (লোহার তৈরি বিশেষ হাতল) টান দেন। এতে নিজামীর পায়ের নিচ থেকে কাঠের পাটাতন সরে ফাঁসি কার্যকর হয়। ২০ মিনিট ঝুলে থাকার পর তাকে ফাঁসির মঞ্চ থেকে নামানো হয়। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে একাধিকবার চিকিৎসক নিজামীর শারীরিক পরীক্ষা করেন।

জামায়াতের শীর্ষ নেতার ফাঁসির রায় কার্যকরের ঐতিহাসিক মুহূর্তের খবর জানতে দেশ-বিদেশের কোটি কোটি বাঙালি সরাসরি টেলিভিশেনের পর্দায় চোখ রাখেন।

সন্ধ্যার পর থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারের আশপাশের সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারাগারের বাইরে বিজিবি-র‌্যাব-পুলিশের সদস্যরা নিরাপত্তাব্যুহ তৈরি করেন। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়ও সতর্ক অবস্থায় রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

রায় কার্যকরের খবর ছড়িয়ে পড়লে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা উল্লাসে ফেটে পড়েন। আনন্দ মিছিল হয়েছে পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়।

২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ একাত্তরে বদরপ্রধান ও জামায়াতের সহযোগী সংগঠন তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি নিজামীকে চারটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। এছাড়া আরও চারটি অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে গত ৬ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ একাত্তরে মহান স্বাধীনতার ঊষালগ্নে বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা ও সহযোগিতার দায়ে জামায়াতের আমির নিজামীকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সাজা বহাল রাখেন। এছাড়া পাবনার বাউসগাড়ী ও ডেমরা গ্রামে নির্বিচারে হত্যা ও ধর্ষণ এবং সাঁথিয়া থানার ধুলাউড়ি গ্রামে ৫২ জনকে হত্যার দায়েও নিজামীর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।

একইসঙ্গে পাবনার সোহরাব আলীকে হত্যা ও নাখালপাড়া এমপি হোস্টেলে রুমি, বদি, আজাদ ও সুরকার আলতাফ মাহমুদকে হত্যার উস্কানি দেওয়ার দায়ে নিজামীকে দেওয়া যাবজ্জীবন সাজাও বহাল রাখা হয়।

তাছাড়া নিজামীর আপিল আংশিক মঞ্জুর করে বাকি তিনটি অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ওই তিনটি অভিযোগের মধ্যে রয়েছে—পাবনার বাউশগাড়ি, ডেমরা ও রূপসী গ্রামের সাড়ে ৪০০ মানুষকে হত্যা ও ৩০/৪০ জন নারীকে ধর্ষণ, পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা এবং পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী গণহত্যা।

প্রসঙ্গত, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে ২০১০ সালের ২৯ জুন নিজামীকে গ্রেফতার করা হয়। একই বছরের ২১ জুলাই তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু হয়। পরে ২০১২ সালের ২৮ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিজামীর বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ ১৬টি অভিযোগ আমলে নিয়ে অভিযোগ গঠন করেন। তার বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, উস্কানি ও সহায়তা, পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ আনা হয়। এরপর প্রসিকিউশনের সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্যে দিয়ে ২০১২ সালের ২৬ আগস্ট এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেন ২৬ জন। নিজামীর পক্ষে তার ছেলেসহ চারজন সাফাই সাক্ষ্য দেন।

শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী প্রয়াত গোলাম আযমের উত্তরসূরি হিসেবে ২০০০ সালে জামায়াতের নেতৃত্বে আসেন মতিউর রহমান নিজামী। ১৯৪৩ সালের ৩১ মার্চ পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার মনমথপুর গ্রামে জন্ম নেন তিনি। 

যে তিন অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড
অভিযোগ-২: একাত্তরের ১০ মে বেলা ১১টার দিকে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ি গ্রামের রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি সভা হয়। স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের উপস্থিতিতে ওই সভায় নিজামী বলেন, শিগগিরই পাকিস্তানি সেনারা শান্তি রক্ষার জন্য আসবে। ওই সভার পরিকল্পনা অনুসারে পরে ১৪ মে ভোর সাড়ে ৬টার দিকে বাউশগাড়ি, ডেমরা ও রূপসী গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। প্রায় ৩০-৪০ জন নারীকে সেদিন ধর্ষণ করে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা।

অভিযোগ-৬: নিজামীর নির্দেশে ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে যায় পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা। তারা গ্রামের ডা. আব্দুল আউয়াল ও তার আশেপাশের বাড়িতে হামলা চালিয়ে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা করে।

অভিযোগ-১৬: মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের ঊষালগ্নে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে আলবদর বাহিনী। দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পিতভাবে আলবদর সদস্যরা ওই গণহত্যা ঘটায়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত