নিজস্ব প্রতিবেদক

১৮ এপ্রিল, ২০১৭ ১৯:৩০

রাগীব আলীর রাহুমুক্ত তারাপুরে গণহত্যা দিবস পালন

রাগীব আলীর রাহু মুক্ত হওয়ার পর সিলেটের তারাপুর চা বাগানে প্রথমবারের মতো পালিত হয়েছে গণহত্যা দিবস। মঙ্গলবার সকালে তারাপুর বাগানে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ প্রাঙ্গণে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে এ দিবসটি পালিত হয়।

১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা বাগান মালিক রাজেন্দ্র কুমার গুপ্ত, তার পরিবারের আরও ৪ সদস্য, বাগানের কর্মকর্তা, কর্মচারি ও শ্রমিকসহ ৩৯ ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। ১৯৮৮ সালে বাবা রাজেন্দ্রলাল গুপ্তসহ সকল শহীদ স্মরণে তারাপুর চা বাগানের ভেতর একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন ডা. পঙ্কজ গুপ্ত।

দীর্ঘদিন সিলেটের বিতর্কিত শিল্পপতি রাগীব আলীর দখলে ছিলো দেবোত্তোর সম্পত্তি এই চা বাগান। উচ্চ আদালতে রায়ে গত সেপ্টেম্বরে শহীদ রাজেন্দ্র গুপ্তের ছেলে পঙ্কজ কুমার গুপ্তকে বাগান বুঝিয়ে দেওয়া হয়। বাগানের সেবায়েতের দায়িত্ব নেওয়ার পর এবারই প্রথম দিবসটি পালন করেন পঙ্কজ গুপ্ত।

মঙ্গলবার সকালে তারাপুর চা বাগানে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিলেটের জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার।

এর আগে স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধাঞ্জলিও নিবেদন করা হয়। আলোচনা সভা শেষে শহীদ পরিবারের সদস্যদের সম্মাননা ক্রেষ্ট তুলে দেন প্রধান অতিথি।

গণহত্যা দিবসের আলোচনায় পঙ্কজ কুমার গুপ্ত বলেন, সিলেটের চা বাগানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় গণহত্যা হয়েছে এই বাগানে। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও এখানকার শহীদরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি। আজ এই দিনে আবারও  প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিস্টদের কাছে শহীদদের স্বীকৃতির দাবি জানান তিনি।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক মো. রাহাত আনোয়ার বলেন, যে জাতি নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে, সে জাতি স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষায় যেকোন ত্যাগ স্বীকার করতে পারে।

তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির যতই ষড়যন্ত্র হোক মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা আমাদের সকলের দায়িত্ব। একাত্তরে গণহত্যা যেসমস্ত স্থানে সংঘটিত হয়েছে, সেই সমস্ত স্থান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি অংশ। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের সকল স্মৃতি সংরক্ষণ ও গণহত্যার স্থান সমূহ সংরক্ষণে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আশা ব্যক্ত করেন।

তারাপুর চা বাগানের শহীদদের স্বীকৃতি প্রদানে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
 
আলোচনা সভার আগে জেলা প্রশাসক ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, সিলেট মহানগর ইউনিট কমান্ড, ডা. পংকজ গুপ্ত ও শহীদ পরিবারের সদস্যবৃন্দ, মদনমোহন কলেজ অধ্যক্ষ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সিলেট, সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেট, বাংলাদেশ উদীচি শিল্পীগোষ্ঠী, সিলেট জেলা সংসদ, খেলাঘর সিলেট জেলা শাখা সহ বাগানের চা-শ্রমিক ও বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

শ্রদ্ধা নিবেদনের পরপরই স্মৃতি স্তম্ভ পার্শ্ববর্তী প্রাঙ্গণে আলোচনা সভা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন তারাপুর চা-বাগানের সেবায়েত ও শহীদ পরিবারের সদস্য ডা. পংকজ গুপ্ত। অনুষ্ঠানের শুরুতেই গণহত্যায় স্বীকার সকলের উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সাধারণ সম্পাদক রজত কান্তি গুপ্তের পরিচালনায় অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সিলেট মহানগর ইউনিট কমান্ডার ভবতোষ রায় বর্মণ রানা, ডেপুটি কমান্ডার আব্দুল খালিক, সিলেট মহানগর আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক বিজিত চৌধুরী, প্রবীণ রাজনীতিবিদ বাদল কর, প্রবীণ সাংবাদিক বশির আহমেদ, সাংবাদিক সুকেশ চন্দ্র দেব, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সিলেটের সভাপতি আমিরুল ইসলাম চৌধুরী, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর ইলিয়াছুর রহমান।

এছাড়াও অনুষ্ঠানমঞ্চে উপস্থিত ছিলেন  স্থানীয় সরকারের উপর পরিচালক দেবজিৎ সিনহা, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সিলেট জেলা ইউনিট কমান্ডার সুব্রত চক্রবর্তী জুয়েল, মদনমোহন কলেজের অধ্যক্ষ ড. আবুল ফতেহ ফাত্তাহ, সাংবাদিক ও ইমজা সিলেটের সভাপতি আল-আজাদ, সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের প্রধান পরিচালক অরিন্দম দত্ত চন্দন, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদর সিলেট মহানগর সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ কুমার দেব, বাংলাদেশ নারী মুক্তি সংসদ সিলেট জেলা শাখার সভাপতি ইন্দ্রানী সেন প্রমুখ।

অনুষ্ঠানে ১৮ এপ্রিল নির্মমভাবে নিহত শহীদ পরিবারের সদস্যদের মাঝে সম্মাননা স্মারক ম্যাডেল তুলে দেন সিলেটের জেলা প্রশাসক ও অন্যান্য অতিথিবৃন্দ।

সম্মাননা প্রদানের আয়োজনে অনুষ্ঠানস্থলে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পরিবারের আপনজন হারানো অনেকেই নীরবে নিভৃতে চোখে জল মুছতে দেখা যায়। অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত শহীদ পরিবারের গণহত্যায় শিকার বাগানের চিকিৎসক ক্ষিতীশ চন্দ্র দে এর সহধর্মিনী ৯৪ বৎসর বয়স্ক নিভা রানী দে চোখের জলে তাঁর স্বামীর পক্ষে সম্মাননা স্মারক গ্রহণ করেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত