হাসান মোরশেদ

০৭ মে, ২০১৫ ২০:৪১

দাসপার্টির খোঁজে: খসড়া পর্ব-২

সর্ব্বোচ্চ সম্মানের ঘোষণা দিয়ে ও রাষ্ট্র তাকে ভূষিত করেছে তৃতীয় খেতাবে , অথচ সহযোদ্ধাদের কাছে আজও তিনি শ্রেষ্ঠ বীর। বিশাল ভাটি অঞ্চলের বীরশ্রেষ্ঠ। হত্যা আর মরদেহ প্রদর্শনের ধরণে তাকে একাত্তরের যীশুও বলেন অনেকে। চুয়াল্লিশ বছর পর লেখক হাসান মোরশেদ বেরিয়েছেন শহীদ জগৎজ্যোতি দাস আর তাঁর দাস পার্টির খোঁজে।। তাঁর সেই অনুসন্ধান ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে সিলেটটুড২৪ডটকম-এ। আজ প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় কি

আমি জামালগঞ্জ পুলিশ স্টেশন ও হাইস্কুলের সামনে কিছুক্ষন হাঁটি। এখানেই ছিলো বাংকার এবং জগতজ্যোতি’র নেতৃত্বে তার দাসপার্টির গেরিলারা এখানেই যুদ্ধ করছিলেন সেদিন। আজ একদিনে দাসপার্টির দুটো অপারেশনের জায়গা দেখার সুযোগ পেলাম।  

বন্ধু আকবরের কথামতো এবার আমি ছোট্ট নৌকায় সুরমা নদী পাড়ি দেই, ঐটা সাচনা বাজার। খেয়া পাড়েই অপেক্ষায় ছিলেন আকবর। আমরা বাজারের ভেতরে তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বসি। নদী পাড়ি দেয়ার সময় নৌকায় আমার সাথে উঠেছিলেন একজন বৃদ্ধ, লুঙ্গী ও বাদামী একটি শার্ট গায়ে।  সেই বৃদ্ধ ও আসেন আমার সাথে। আকবর পরিচয় করিয়ে দেন ইনি মুক্তিযোদ্ধা সিকন্দর আলী।

প্রচন্ড গরম, আকবর ঠান্ডা পানীয়ের ব্যবস্থা করেন সবার জন্য। সিকন্দর আলী জামালগঞ্জের নোয়াহালট গ্রামের হলে ও যুদ্ধ করেছেন শেলা সাব-সেক্টরে ছাতক  এলাকায়। ছাতক সিলেট সড়কের ঝাওয়া রেল সেতু ও সড়ক সেতু ধ্বংস এবং সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের ডাবর ফেরি ধ্বংসের  গুরুত্বপুর্ণ অপারেশনে তিনি ছিলেন। আনসার বাহিনীর সদস্য হিসেবে ১৯৬৫ এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ছিলো তার। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে ‘সেন্ট্রি সাইলেন্স’ এর গুরুদায়িত্ব পালন করতেন তিনি। সেন্ট্রি-সাইলেন্স হলো অগ্রবর্তী হিসেবে শত্রুর টার্গেট এরিয়ায় ঢুকে পাহারাদারকে নিস্ক্রিয় করা/ হত্যা করা, তারপর বাকী সহযোদ্ধাদের সিগন্যাল দেয়া অপারেশন শুরু করার জন্য। সিকন্দর আলী এটাকে বলেন- খালি হাতে জাতি সাপের ফনায় ধরা । আমি সিকন্দর আলীকে উস্কে দেই- এই যে সাপের ফনায় হাত দিতেন- যুদ্ধ শেষে কোন পদক টদক তো পেলেন না।

সিকন্দর আলী স্পষ্টভাষী। তার সাব-সেক্টর থেকে বীর প্রতীক উপাধি পেয়েছেন লেঃ রউফ, তারই সহযোদ্ধা। এই সাব-সেক্টরে দু চারজন সেনা কর্মকর্তা, কয়েক জন তরুন ছাত্র এবং বাকী সবাই তার মতো অর্ধ-শিক্ষিত বা নিরক্ষর মানুষেরা ছিলো। তিনি বলেন যুদ্ধ শেষে ছাত্ররা চলে গেছে পড়ালেখা করতে আমরা চলে আসছি হালচাষে আর আর্মির স্যারেরা পদক টদক সব নিয়ে গেছেন নিজেরাই, আমাদের খবর কেউ রাখে নাই কিন্তু যুদ্ধের সময় সবথেকে বিপদের কাজগুলো আমরাই করছি। 

মুক্তিযোদ্ধা সিকন্দর আলী

নদী ভাংগনে সিকন্দর আলীর পৈতৃক ভিটা-জায়গা জমি শেষ হয়ে গেছে। এখন জামালগঞ্জ বাজারে নদীর পাড়ে এক টুকরো খাসজমিতে একটা চালাঘর তুলে কোনমতে থাকেন স্ত্রী সন্তান সহ।  বয়স হয়েছে, কাজ করতে পারেন না। সরকারী ভাতাটুকুই সম্বল।
আমার আরো অনেক জায়গায় যেতে হবে। সিকন্দর আলীর কাছ থেকে বিদায় নিতে চাই, হাত জড়িয়ে অনুরোধ করেন যেনো ফেরার বেলা তার ছাপড়া ঘরে একতু বসে যাই।

এবার আমার আর আকবরের গন্তব্য সাচনা বাজার থেকে দু মাইল পশ্চিমের গ্রাম লম্বাবাঁক। মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন। যাওয়ার আগে আকবর নিশ্চিত হতে চান আলাউদ্দিন বাড়ি আছেন কিনা। আলাউদ্দীন অন্যের বাড়িতে কামলা খাটেন, তাও অনেক দূরের জগন্নাথ উপজেলার কোন এক গ্রামে। অসুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছেন বলে আকবর শুনেছেন। নিশ্চিত হবার জন্য একই গ্রামের একজন দোকানদারকে মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দীনের কথা জিজ্ঞেস করলে উত্তর – ‘ ও বেশী মাতে যে আলাই, হে আছে বিছনাত পড়া’ । বেশী মাতে আলাই অথবা গেরিলা যোদ্ধা আলাউদ্দিনের সন্ধানে আমরা লম্বাবাঁক গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই রিক্সা নিয়ে। সুরমা নদী চলে গেছে পশ্চিমে, তার পাড় ঘেঁষে সমান্তরালে কিছু বাড়িঘর – তারপর ইট ও ব্লক ফেলে তৈরী করা রাস্তা এর পর উত্তর দিকে আদিগন্ত হাওর। হাওর চলে গেছে একেবারে টেকেরঘাট, পশ্চিম খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে। আর কয়দিন পর  পুরোটা থই থই পানি, নৌকা ট্রলার  চলবে, ঢেউ উঠবে বিপদ্দজনক। এখন সোনালী ধানের উচ্ছ্বাস। বাতাসে ঢেউ খেলছে।

লম্বা বাঁক গ্রামে পৌঁছাই। ছাপড়া মতো ঘর সব। দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট। স্যানিট্রেশন, বিশুদ্ধ পানির উৎসের কোন চিহ্ন দেখিনা। দারিদ্র ছাপিয়ে উঁকি মারে সুদৃশ্য দোতলা পাকা মসজিদ। জুমা’র নামাজের আজান পড়ে গেছে, মুসল্লীদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। আকবর পরিচিত মুখ, আমার প্রতি উৎসুক দৃষ্টি।  আকবরকে আগেই বলা আছে, উৎসুক দৃষ্টি এড়িয়ে আমরা কথা বলবো।

আকবর আলগোছে এগিয়ে যান ছাপড়াঘরগুলোর ভেতর দিয়ে। আমি তাকে অনুসরন করি, বুঝতে চেষ্টা করি কয়দিন পর বর্ষায় কী অবস্থা দাঁড়াবে এই ঘরগুলোর। আকবর তার দীর্ঘ দেহ নীচু করে একটা ছাপড়ায় ঢুকেন, আমি ও।  প্রথমেই অন্ধকার চোখে লাগে এই মধ্য দুপুরে। কয়েক মুহুর্তের অন্ধকার চোখ সয়ে গেলে খাটের উপর চাটাই, তার উপর একটা শরীরের কাঠামো- শীর্ণ, হাড়গুলো স্পষ্ট, বুকের পাঁজর উঠা নামা করছে হাপরের মতো। এটা আমার চেনা, সিরিয়াস রকম হাঁপানি।

উঠে বসেন আমাদের দেখে, সালাম দেই। আকবরের সাথে আগের পরিচয় আছে। চোখে ইশারায় বসতে বলেন। তার পাশেই বসি আমি ও আকবর।  আকবর সংক্ষেপে বলেন আমার আসার উদ্দেশ্যে। গেরিলা যোদ্ধা আলাউদ্দিন, শ্বাসকষ্টে বুক ঠেলে বেরিয়ে আসা আলাউদ্দীন ঠিক বুঝতে পারেন না কেনো আমি তার কাছে গিয়েছি, যুদ্ধের কাহিনী শুনে কী হবে? তার সবথেকে বড় সংশয় আমি আসলে কে?

মাঝেমধ্যেই এক লাইন ইংরেজি বলেন ‘ নাথিং ইজ এভরিথিং’ । ঘুরে ঘুরে এই কথাটাই উচ্চারন করেন কিছুক্ষন পর পর একেবারেই নিরক্ষর এই গেরিলা, যুদ্ধের আগে  ভূমিহীন কৃষক ছিলেন, এখনো তাই। বয়স সত্তুর বছর- মানুষের জমিতে কামলা দেন।

মানুষটার কথা বলতে কষ্ট হয়। আমি সিদ্ধান্ত নেই তাকে কিছুই জিজ্ঞেস করবোনা- শুধু তার পাশে বসে থাকবো কিছুক্ষন। নিজ থেকেই আবার কথা বলেন- ‘বাইরা’ মাসে যুদ্ধে গেছেন- ইকো ওয়ান ট্রেনিং ক্যাম্প,  টেকেরঘাটের ঘাঁটি, আলী আমজদ কমান্ডার, তাহিরপুরের যুদ্ধ, তিনদিন ভরা যুদ্ধ এইসব মনে আছে তার। আমি ভিডিও করতে চাই। তিনি বুঝতে চান এটা কী জিনিস? আমি আসলে কে? তার ছবি তুলে আমি কী করবো? আবার নিজ থেকেই বলেন- যা খুশী করেন, আমি কী ডরাই নাকি? দালালের ফুয়া ( লাল মিয়ার ছেলে বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান) পতাকা তোলার অনুষ্ঠান করে ( ১৬ ডিসেম্বর)। আমি তার অনুষ্ঠানে মুতি। আমরা মুক্তিরা আলাদা অনুষ্ঠান করছি, ডরাইছি নাকি কোন ব্যাটারে?
জিজ্ঞেস করি- ভাতা কী পান?

এজমা আক্রান্ত ফুসফুস থেকে বাতাস বের হয়ে আসে তার। উত্তর দেন ‘পাই’। গরীব দেশ বাবা, আমগোরে কী দিবো বলেন? দেশের মানুষ খাইতে পারেনা, তাও শেখের ফুরি আমগোরে ভাতা দেয়। আমরা খুশী আছি।  

‘এই যে দালালদের বিচার হচ্ছে এখন...’

‘দলাল কী বাবা কম ছিলো? লাল মিয়া- আহারে কতো মুক্তি মারছে। হের বিচার নাই। বিচার কী বাবা আছে নাকি দেশে? ক্ষেমতা তো সব তারারই। কিন্তুক আমরা ডরাইনা, যেটা কওনের কই।  এই যে আপনে, আপনারে কী আমি ডরাই? লেখেন আমি যা কইছি সব লেখেন, কোন দলালরে আমি চুকিনা’

আহ তার ভাঙ্গা বুক ভেতরে ঢুকতে থাকে, অনেক ভেতর থেকে নিঃশ্বাসের সুগভীর কষ্ট নিয়ে তার পাঁজর জেগে উঠতে সময় নেয়।

যেনো একা এক গেরিলা যোদ্ধা আলাউদ্দিন তার সমগ্র অহং নিয়ে আমার সামনে দন্ডায়মান আর ষোল কোটি নপুংসক এর অকৃতজ্ঞতার গুরুভার আমি আমার কাঁধে নিয়ে নতজানু তাঁর কাছে।

কোন বাক্য নাই, কোন শব্দ নাই- কেবল ইশারায় আমি ও আকবর দৃষ্টি বিনিময় করি। এতোক্ষন আড়ালে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী। এবার তিনি আমাদের বলেন- বাজানরা কিছু মনে কইরেন না, মাথা বিগড়াই গেছে। আপনারা কিছু খেয়ে যান।


গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন


গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন এর বাড়ি

বের হয়ে আসি। সুদৃশ্য দোতলা মসজিদ বিল্ডিং এখন মুসল্লীদের ভীড়, উত্তরের হাওর জুড়ে সোনালী সমৃদ্ধি, কিন্তু বাতাস নেই একফোঁটা। আমার নিঃশ্বাসে কষ্ট হয়। আমরা সাচনা বাজারের দিকে ফিরে চলি।

এবার সাচনা বাজার থেকে উত্তরে সাচনা গ্রাম। এই রাস্তা চলে গেছে বেহেলীর দিকে। বিখ্যাত কমিউনিষ্ট নেতা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বরুন রায়ের বাড়ি। আমরা বেহেলী যাইনা। সাচনার বিখ্যাত ঘোষ চৌধুরীদের বাড়ি এসে ঢুকি। সাচনা বাজার সহ বিশাল এলাকার জমিদারী ছিলো এদের। আগের সেই অবস্থা নেই কিন্তু এখনো বাড়ী দেখলে সমীহ জাগে, পুরনো ঐতিহ্যের রেশটুকু পাওয়া যায়।  এই বাড়ির ছেলে বাপ্পা ঘোষ চৌধুরী সিলেটের সুপরিচিত সাংবাদিক, এ ছাড়া এই বাড়ি আমার ছোটবেলার বন্ধু মান্না’র নানাবাড়ি। বাড়িতে ঢুকার আগে বাপ্পাকে ফোন দেই, বাপ্পা জোর করে যেনো তার মাকে দেখে আসি অবশ্যই।

চৌধুরি বাড়িতে যার খোঁজে যাওয়া তিনি বাপ্পার কাকা, শ্রী পরিমল ঘোষ চৌধুরী। একাত্তুরে উনি সুনামগঞ্জ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছেন। জগতজ্যোতি, তালেবদের সাথে আড্ডার ঘনিষ্ঠতা। ছাত্র ইউনিয়ন করলেও সাতই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষনের পর থেকে আওয়ামী লীগ কর্মী হয়ে যান। ২৮ মার্চ সুনামগঞ্জের প্রতিরোধ যুদ্ধে তারা লঞ্চ বোঝাই দেশীয় অস্ত্র সহ যোগ দিয়েছিলেন। ফিরে আসার পর জানতে পারেন তার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। দ্রুত তাকে পাঠিয়ে দেয়া সীমান্তে। সেখান থেকে লাভা ইয়থ ক্যাম্প। ইয়ুথ ক্যাম্পে  তাকে সহ বাছাই করা হয় ৩৭ জন তরুনকে যারা অন্ততঃ ইন্টারমিডিয়েট পাশ।  এদেরকে  আসামের তেজপুরে  আটাশ দিনের এডভান্স ট্রেনিং এ পাঠান হয়। ট্রেনিং শেষে গারো পাহাড়ের তুরা, মহেন্দ্রগঞ্জ হয়ে সংযুক্ত হন কর্ণেল তাহেরের এগারো নম্বর সেক্টরে। কামালপুর যুদ্ধে কর্ণেল তাহেরের সাথে ছিলেন তিনি।

দশদিনের এই যুদ্ধে  কর্ণেল তাহের পা হারান, শহীদ হন ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দীন মমতাজ। পা হারানোর পর ও তাহের কিভাবে ঠান্ডা মাথায় কমান্ড করছিলেন সেই বর্ণনা পরিমল চৌধুরী দিচ্ছিলেন আমাদের। পরিমল চৌধুরীর কাছেই পেয়ে যাই তাহিরপুর থানার সেই সময়ের ওসি শফিকুর রহমানের কন্টাক্ট। শফিকুর রহমান ২৫ মার্চের পরই পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়ান পুলিশ স্টেশন। তার সাথের পুলিশদের নিয়ে প্রতিরোধ গতে তুলেন এবং স্থানীয়দের প্রশিক্ষন দিতে থাকেন। তিনি নিজে কয়েকটা অপারেশন করে অবাঙ্গালীদের নিয়ন্ত্রাধীন ইপিআর ঘাঁটি দখল করেন। এই ওসি সাহেব এখন থাকেন চট্টগ্রামে।


পরিমল ঘোষ চৌধুরী 

শহীদ মিনার

চৌধুরী বাড়ির আপ্যায়ন শেষে সাচনা বাজারে ফিরে আসি। ফেরী ঘাটের ঠিক আগেই অযত্নে পড়ে থাকা একটি স্মৃতিসৌধ, ঠিক এই জায়গাতেই শহীদ হয়েছিলেন সিরাজ, কিশোরগঞ্জের সিরাজউদ্দীন এই জামালগঞ্জে এসে জীবন দিয়ে স্বাধীন করে দিয়েছিলেন। স্মৃতিসৌধের চত্বরে সবজি  বিক্রী হচ্ছে, কেউ একটা লুঙ্গী শুকাতে দিয়েছে। দালাল লাল মিয়া ও তার সন্তানেরা যেখানে ক্ষমতাসীন থাকে যুগের পর যুগ সেখানে একজন শহীদ সিরাজের স্মৃতিসৌধ এমন অবহেলায় পড়ে থাকাই বোধহয় স্বাভাবিক।

এবার নদী পাড় হয়ে আমরা আবার চলে আসি জামালগঞ্জ বাজারে। একটু হেঁটে একটা ফার্মেসীর সামনে দাঁড়াই। আকবর সামনে, আমি পেছনে। ফার্মেসীর ভেতরে ঢুকে একটা পর্দা সরিয়ে আকবর আমাকে ইশারা করেন, আমি ও এগোই। পর্দার আড়ালে একটা চিলেকোঠার মতো। একটা খাট, মশারী অর্ধেক গোটানো। প্রায় অন্ধকার, ইলেক্ট্রিসিটি নেই। প্লাস্টিকের একটা চেয়ারে বসে আছেন নিবারস সরকার। হঠাৎ আধো অন্ধকারে সিরাজুল আলম খান বলে ভ্রম হতে পারে।

সিরাজুল আলম খানরা গড়ে তুলেছিলেন মুজিব বাহিনী/ বিএলএফ  আর নিবারস সরকার সেই বিএলএফ এর এলএমজি ম্যান। জামালগঞ্জের বিনাজুড়া গ্রামের নিবারস মেট্রিক পরীক্ষার্থী ছিলেন দিরাই’র ভাটিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। ২৮ মার্চের সুনামগঞ্জ যুদ্ধের পর লুট করা অস্ত্র নিয়ে ফেনারবাকের মুজিবুর রহমান, মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক তালেব এবং কালাশফিক ( জগতজ্যোতি শহিদ হবার পর ইনিই দাসপার্টি কমান্ড করতেন) তাদের গ্রামে আসেন এবং এদের উৎসাহেই বালাট যান। বালাট থেকে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় হাফলং এ বিএলএফ এর পয়তাল্লিশ দিনের স্পেশাল ট্রেনিং এ। ট্রেনিং শেষে বিএলএফের ৭৫ জনকে পাঠানো হয় তুরায়।

সেখানে ভারতীয় বাহিনী তাদেরকে সম্মুখ যুদ্ধে পাঠাতে চাইলে তারা সম্মুখ যুদ্ধে অস্বীকৃতি জানান কারন তারা ছিলেন গেরিলা যোদ্ধা। পরে  এডভোকেট আব্দুল হামিদের মধ্যস্ততায় ভারতীয় বাহিনী তাদেরকে গেরিলা অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র সরবরাহ করে এবং দেশের ভেতরে ঢুকে তারা একদিকে অপারেশন, অপরদিকে প্রশিক্ষন দিতে শুরু করেন।, তাদের উপর নির্দেশ ছিলো একএকজন বিএলএফ কে দশজন করে গেরিলা তৈরী করতে হবে।

নিবারস সরকার অকৃতদার। পরিবারের লোকজন বেশিরভাগ ভারতে চলে গেছেন। পরিচিত একজনের ফার্মেসীর পেছনের একটা খাটে একা একা শুয়ে থাকেন এলএমজি ম্যান নিবারস সরকার।


নিবারস সরকার

তখন বিকেল প্রায় চারটা। উত্তরের নদী ও হাওরের দিক থেকে ঠান্ডা বাতাস এসে গায়ে লাগে। আকবর বলেন- বৃষ্টি আসতে পারে। এখন আমাদের গন্তব্য দক্ষিনে মাইল দুয়েক দূরে লালবাজার। সেখান থেকে আরেকটা গ্রাম মামুদপুর। উপজেলা সদরের সরু রাস্তা ধরে আমরা লালবাজার পৌঁছাই। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন এই গ্রামের একজন ছাত্রলীগ কর্মী। লালবাজার থেকে এবার মাটির রাস্তা, গাড়ি যাবেনা। আমরা পায়ে হাঁটা শুরু করি। আকবর এবং নূর নামের সেই ছাত্রলীগ কর্মীর কাছ থেকে জানতে পারি- একাত্তুরে এই এলাকা ছিলো রাজাকারদের মুল শক্তি। এখানকার আটটা গ্রামে পাকিস্তানের পতাকা উড়তো। তালিকাভুক্ত রাজাকার ছিলো একশো বিশজন। আর আটটা গ্রাম মিলে একজন মাত্র মুক্তিযোদ্ধা। এই এলাকার প্রচলিত একটা কথা ‘ছয় কুড়ি দলালে এক মুক্তি’ ।

সেই এক মুক্তি মদরিছ আলীর খোঁজে যাচ্ছি। নূর আমাকে  ইশারা দিয়ে দেখান একটা মাদ্রাসা , পাকিস্তান আমলের। এই মাদ্রাসাই ছিলো রাজাকার বানানোর মুল সূত্র। কথা বলতে বলতে আমরা গ্রামের প্রায় শেষ প্রান্তে চলে আসছি। এদিকে বাতাস বাড়ছে, শো শো আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে হাওরের উত্তাল বাতাসের। মদ্রিছ আলীর বাড়ি গ্রামের সীমানা পেরিয়ে পতিত একটা জায়গায়। হাকম পেরোতে হয়। মদরিছ আলী মাছ ধরে বিক্রী করতে যান সেই দূরের সাচনা বাজারে। এই বাজারে কেউ তার মাছ কেনেনা। ছয় কুড়ি দলালের গ্রামে এখনো অচ্ছ্যুত একমাত্র মুক্তি  মদরিছ আলী।

হাকম পেরোতে পেরোতেই ভয়ংকর শব্দে বজ্রপাত আর তুমুল বৃষ্টি, সেই সাথে উত্তাল হাওয়া- চারদিকে খোলা প্রান্তর, কোথাও মাথা বাঁচানোর সুযোগ নাই। এরকম খোলা জায়গায় বজ্রপাত মারাত্বক। আমরা তিনজন দৌড়াই। দৌড়ে একটা চালাঘর। ওটাই মদরিছ আলীর বাড়ি।

একটা কুকুর, মদরিছ আলী, তার স্ত্রী ও আরেকজন বয়স্ক লোক উঠোনে দাঁড়ানো। চালাঘরের দরজা খুলে ধরেন। কাছেই কোথাও আবার বজ্রপাত। হুড়মুড় করে আমরা ঘরের ভেতরে ঢুকি এবং একরাশ অন্ধকার। গাঢ় অন্ধকার। অনভ্যস্ত চোখে এই অন্ধকার আরো বেশী ঘনীভূত হয় এছাড়া সোজা হয়ে দাঁড়ানোর মতো উচ্চতাও নেই চালাঘরে। কয়েক মুহুর্ত পরে একটা কেরোসিন এর প্রদীপ জ্বলে উঠে। প্রদীপ ঘিরে আমরা গোল হয়ে বসি। এবার আস্তে আস্তে চোখে দৃশ্যমান হয় মানুষগুলো। মাটির দেয়ালে ঝুলানো বঙ্গবন্ধুর ছবি, একটা দোতারা। মদরিছ আলী জানান তিনদিন আগে সিলেটের হাসপাতাল থেকে ফিরে এসেছেন। আকবর তাদের ঘনিষ্ঠজন, এইসব প্রয়োজনে আকবর তাদের আশ্রয়।

মদরিছ আলী নাটকীয় ভঙ্গিমায় শুরু করেন তার যুদ্ধবয়ান। জৈষ্ঠ্যমাস। পাক আর্মি এসে ঘাঁটি গেড়েছে সাচনায়। তারি এক চাচাতো ভাই, মসজিদের ইমাম রাজাকার হয়েছে। তাকে ও এসে বলেছে রাজাকার হতে, না হলে ধরিয়ে দেবে। নিজে হাতে শেখ মুজিবরে ভোট দিয়েছেন , জয়বাংলার জন্য গান বেঁধে গেয়ে গেয়ে বেড়িয়েছেন গ্রামে , কেমনে বেইমানী করেন মদরিছ আলী? এইদিকে আশেপাশের গ্রামে সবাই রাজাকার। এক কুটুম আসেন তাহিরপুর থেকে। তার নৌকার ছইয়ের নীচে লুকিয়ে চলে যান গ্রাম ছেড়ে। গর্ব করে বলেন একেবারে প্রথম ব্যাচের মুক্তি আমি। কমান্ডার মুজাহিদের নেতৃত্বে সুরমা নদীতে পাক বাহিনীর রসদ বোঝাই কার্গো দখল করে এক্সপ্লোসিভ দিয়ে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সাথের সহযোদ্ধা প্রফুল্ল’র লাশ উড়ে গিয়েছিলো কার্গোর সাথে, আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুড়ে গিয়েছিলো তার মুখ আর গলা। কর্ণেল ওসমানী এসে টেকেরঘাটে তাদের দেখে গিয়েছিলেন।

তাহিরপুরের যুদ্ধে তার পিঠের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে গুলি আর তার ছেড়ে আসা পজিশনেই গুলীবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা কাশেম। এইসব কাহিনী শুনি আমরা কুপির আলোয়, বাইরে তখন শো শো ঝড়ো হাওয়া আর বজ্রপাত চলছে। আকবরের মোবাইলে ফোন আসে, পাশের কোন গ্রামে কেউ মারা গেছে সেই বজ্রপাতে। মদরিছ আলী গেরিলা যুদ্ধের বর্ণনা দিতে দিতে তার খাটের উপর পজিশনের ভঙ্গী করেন আর স্ত্রীকে তাড়া দেন কিছু একটা নাস্তা দেয়ার জন্য। নিসন্তান মদরিছ দম্পত্তির চালাঘরের অচ্ছ্যুত সংসার। সেই ঘোর অন্ধকারের সন্ধায় আমরা লবন দেয়া সেমাই আর চা খাই।

মুক্তিযোদ্ধা মদরিছ আলীর বাড়ি



মুক্তিযোদ্ধা মদরিছ আলী

বৃষ্টি কিছুটা থামলে পর আমরা তিনজন বের হয়ে আসি, মদরিছ দম্পত্তি আমাদের এগিয়ে দিতে চান। ঘন্টা খানেক যে মাটির রাস্তা শক্ত ছিলো, সেই রাস্তায় এখন পা রাখা যাচ্ছেনা। পিচ্ছিল কাদা। আমরা একজন আরেকজন ধরে পা টিপে টিপে এগোতে থাকি। মাইলখানেক কাদাময় রাস্তা পেরোতে যেনো অনন্তকাল। লালবাজারে যখন গাড়ির কাছে চলে আসছি তখন মসজিদে মাগরিবের আজান, তখন ঘন অন্ধকার। হাওর থেকে হুহু হাওয়া আসছে তখনো, বৃষ্টি ও শুরু হয়েছে আবার।

আকবর ও নূরের কাছ থেকে বিদায় নেই। গাড়ী চলতে শুরু করেছে অন্ধকারের বুক চিরে। অন্য কোন দিন হয়তো অন্য কোথাও- সুনামগঞ্জ শহর কিংবা দিরাই শাল্লা অথবা আজমিরীগঞ্জ ছুটে যাবো দাসপার্টির খোঁজে। হয়তো দাসপার্টির কারো সাথে দেখা হবে কিংবা অন্য কোন গেরিলার সাথে অথবা দেখা হবে কোন মুক্তিযোদ্ধার  শহিদ হবার স্থান।  

বাতাস আর বৃষ্টি প্রবল হচ্ছে। আপাততঃ ভীষন ক্লান্ত আমি। গাড়ির পেছনের সীটে গা এলিয়ে দেই। মাথার ভেতর অনুরনন করতে থাকে ‘বেশী মাতা আলাই’ এর বলা একটা লাইন ‘ nothing is everything…nothing is everything…nothing’

 

লিংক : দাসপার্টির খোঁজে:খসড়া পর্ব-১

আপনার মন্তব্য

আলোচিত