সিলেটটুডে ডেস্ক

২৬ জুন, ২০১৭ ১৬:০৬

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

ছবি: সংগ্রহ

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ছেলে শফি ইমাম রুমী শহীদ হন। এছাড়া তার স্বামী শরীফ ইমামও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মৃত্যুবরণ করেন। নিজের ছেলেকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন তিনি, অমর এ তাগের জন্যে তিনি 'শহীদ জননী' হিসেবে সমধিক পরিচিত।

তাঁর একাত্তরের দিনলিপি নিয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি’-তে একজন মুক্তিযোদ্ধার মায়ের দৃঢ়তা, ত্যাগ ফুটে উঠেছে। যা তাঁকে দেশের মানুষের কাছে চির সম্মানের আসনে পৌঁছে দেয়।

১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের সর্বশেষ সাংবিধানিক পেরেক ঠুকে দেন জেনারেল এরশাদ। কলমের খোঁচায় দেশের ওপর লেগে যায় ধর্মীয় লেবাস। গড়ে ওঠে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী জোট। নেতৃত্বে ছিলেন- আহমদ শরীফ, শাহরিয়ার কবির, সিরাজুল ইসলাম, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। কিন্তু তারা নির্বিঘ্নে তাদের প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে পারেন নি।

সামরিক শাসকের রক্তচক্ষু আর সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন। রাজাকার মান্নানের ইনকিলাব পত্রিকা তাদের বিপক্ষে নেমে পড়ে সম্মুখ সমরে। ফলে হেন কোন অভিধা বাকি থাকেনি তাদের জন্যে। তবু তারা প্রতিবাদে মুখর ছিলেন এবং লৌকিক কোন অর্জন ঘরে তুলতে না পারলেও চেতনার বীজকে প্রোথিত করেছিলেন সবার মাঝে। যা এক দাবানল হিসেবে পরিগণিত হয়।

১৯৯২ সালে যখন জামায়াতে ইসলামি তাদের ভারপ্রাপ্ত আমীরের পদ থেকে রাজাকার আব্বাস আলী খানকে সরিয়ে দিয়ে গোলাম আজমকে "আমীর" ঘোষণা করলো তখন চেতনার স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে। সামনে চলে আসে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত হয় গণআদালত।

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর যখন পাকিস্তানি নাগরিক ও যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের আমীর ঘোষণা করে। একটা দলের প্রধান কে হবে সেটা তাদের নিজস্ব বিষয় থাকলেও যখনই একজন পাকিস্তানি নাগরিক এবং শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীকে বাংলাদেশের একটা রাজনৈতিক দলের প্রধান করা হয় তখনই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সুধী সমাজ।

জাহানারা ইমামকে আহ্বায়ক করে ১৯ জানুয়ারি ১৯৯২, ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী প্রতিরোধ মঞ্চ, ১৪টি ছাত্র সংগঠন, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক জোট, শ্রমিক-কৃষক-নারী এবং সাংস্কৃতিক জোটসহ ৭০টি সংগঠনের সমন্বয়ে ১৯৯২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি' গঠিত হয়।

কমিটি ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ 'গণআদালত' এর মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাত্তরের নরঘাতক গোলাম আযমের ঐতিহাসিক প্রতীকী বিচার অনুষ্ঠান করে। গণআদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে দশটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হয়।

এডভোকেট গাজিউল হক, ড. আহমদ শরীফ, স্থপতি মাজহারুল ইসলাম, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, সুফিয়া কামাল, কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফী, শওকত ওসমান, লে. কর্নেল (অব.) কাজী নুরুজ্জামান, লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী ব্যারিস্টার শওকত আলী খান এবং জাহানারা ইমাম নিয়ে ১২ জন বিচারক সমন্বয়ে গঠিত গণআদালতের রায়ে গোলাম আযমের ১০টি অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বলে ঘোষণা করেন।

গণআদালতের চেয়ারম্যান হিসেবে রায় ঘোষণা করে শহীদ জননি জাহানারা ইমাম এবং একই সাথে তিনি গণআদালতের রায় কার্যকর করার জন্য সরকারের কাছে দাবিও জানান।

গণআদালতে যখন গোলাম আযমের মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষিত হলো তখনই জামায়াতবান্ধব বিএনপি সরকার গণআদালতের সাথে সংশ্লিষ্ট ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে অজামিনযোগ্য মামলা দায়ের করে। পরবর্তী সময়ে হাইকোর্ট ২৪ বিশিষ্ট ব্যক্তির জামিন মঞ্জুর করেন।

এরপর লাখো জনতার পদযাত্রার মাধ্যমে জাহানারা ইমাম ১৯৯২ সালের ১২ এপ্রিল গণআদালতের রায় কার্যকর করার দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি নিয়ে জাতীয় সংসদের স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার কাছে পেশ করেন। ১০০ জন সংসদ সদস্য গণআদালতের রায়ের পক্ষে সমর্থন ঘোষণা করেন। রায় বাস্তবায়নের দাবি জানানো ১০০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ৮৮জনই ছিলেন আওয়ামীলীগ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য।

গণআদালতে রায় ঘোষণা, স্মারকলিপি দিয়েই তিনি থেমে থাকেন নি, আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দেশব্যাপী গণস্বাক্ষর, গণসমাবেশ, মানববন্ধন, সংসদ যাত্রা, অবস্থান ধর্মঘট, মহাসমাবেশ ইত্যাদি কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে আন্দোলন আরও বেগবান হয়।

তৎকালীন বিএনপি সরকার ১৯৯৩ সালের ২৮ মার্চ নির্মূল কমিটির সমাবেশে পুলিশ হামলা চালায় । পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন জাহানারা ইমাম। সারাদেশ থেকে এই আন্দোলন দেশের বাইরেও ছড়িয়ে যায়। বিশ্বের দেশে দেশে বাংলাভাষী বাংলাদেশি আছেন সেখানেও গঠিত হয় কমিটি।

২৬ মার্চ ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা দিবসে গণআদালত বার্ষিকীতে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণতদন্ত কমিটি ঘোষিত হয় এবং আরও আট শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর নাম ঘোষণা করা হয়। যার মধ্যে রয়েছে আব্বাস আলী খান, মতিউর রহমান নিজামী, মোঃ কামারুজ্জামান, আবদুল আলীম, দেলাওয়ার হোসেইন সাইদি, মওলানা আবদুল মান্নান, আনোয়ার জাহিদ এবং আবদুল কাদের মোল্লা।

গণতদন্ত কমিটি ঘোষিত হওয়ার ঠিক এক বছর পর ১৯৯৪ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে গণআদালতের দ্বিতীয় বার্ষিকীতে গণতদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান কবি বেগম সুফিয়া কামাল ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটের সামনে জনসমাবেশে জাহানারা ইমামের হাতে জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্ট হস্তান্তর করেন যেখানে সন্নিবেশিত ছিল রাজাকারদের আখ্যান এবং অপরাধের পূর্বাপর।

গণতদন্ত কমিশনের সদস্যরা ছিলেন শওকত ওসমান, কে এম সোবহান, সালাহ উদ্দিন ইউসুফ, অনুপম সেন, দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, খান সারওয়ার মুরশিদ, কবি শামসুর রাহমান, শফিক আহমেদ, আবদুল খালেক এবং সদরুদ্দিন।

একই সমাবেশে আরও আট যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে তদন্ত কার্যক্রম চালানোর ঘোষণা দেয়া হয়। এ সময়ে খুব দ্রুত শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকলে ১৯৯৪ সালের ২ এপ্রিল চিকিৎসার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে হয় জাহানারা ইমামকে। সে সময়ে তিনি কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। ২৬ জুন সবাইকে ছেড়ে চলে যান জাহানারা ইমাম।

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম মারা যাওয়ার আগে দেশবাসীর উদ্দেশে এক আবেগঘন এবং দিকনির্দেশনাপূর্ণ চিঠি লিখে গেছেন। যে চিঠিতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের ভার দেশবাসীর ওপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে চেয়েছিলেন।

তাঁর অসুস্থতা এবং মৃত্যুর মাত্র দিন তিনেক আগে বাংলাদেশে গোলাম আযম নাগরিকত্ব লাভ করে। দীর্ঘ তিন বছরের আন্দোলনের পরিসমাপ্তি হয় দুঃখজনকভাবে। মারা যাওয়ার আগে জাহানারা ইমাম এই আন্দোলনের দায়িত্ব জনসাধারণের ওপর ন্যস্ত করে দিয়ে এক আবেগঘন ও দিকিনির্দেশনামূলক চিঠি লিখেন। চিঠিতে তিনি লিখেন-

সহযোদ্ধা দেশবাসীগণ,
আপনারা গত তিন বছর একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমসহ স্বাধীনতাবিরোধী সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছেন। এই লড়াইয়ে আপনারা দেশবাসী অভূতপূর্ব ঐক্যবদ্ধতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আন্দোলনের শুরুতে আমি আপনাদের সঙ্গে ছিলাম। আমাদের অঙ্গীকার ছিল লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত কেউ রাজপথ ছেড়ে যাবো না।

মরণব্যাধি ক্যান্সার আমাকে শেষ মরণ কামড় দিয়েছে। আমি আমার অঙ্গীকার রেখেছি। রাজপথ ছেড়ে যাই নি। মৃত্যুর পথে বাধা দেবার ক্ষমতা কারো নেই। তাই আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি এবং অঙ্গীকার পালনের কথা আরেকবার আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। আপনারা আপনাদের অঙ্গীকার ও ওয়াদা পূরণ করবেন। আন্দোলনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে থাকবেন। আমি না থাকলেও আপনারা আমার সন্তান-সন্ততিরা - আপনাদের উত্তরসূরিরা সোনার বাংলায় থাকবেন।

এই আন্দোলনকে এখনো অনেক দুস্তর পথ পাড়ি দিতে হবে। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মুক্তিযোদ্ধা, নারী, ছাত্র ও যুবশক্তি, নারীসমাজসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই লড়াইয়ে আছে। তবু আমি জানি জনগণের মতো বিশ্বস্ত আর কেউ নয়। জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। তাই গোলাম আযম ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের দায়িত্বভার আমি আপনাদের, বাংলাদেশের জনগণের হাতে অর্পণ করলাম। অবশ্যই, জয় আমাদের হবেই।
- জাহানারা ইমাম

আপনার মন্তব্য

আলোচিত