সিলেটটুডে ডেস্ক

২৪ আগস্ট, ২০২০ ০১:৫৭

করোনার চার মাসে দেশে ফিরছেন ৭৮ হাজার প্রবাসী

করোনা সংক্রমণের পর গত সাড়ে চার মাসে ৭৮ হাজার প্রবাসী বিশ্বের ২৬টি দেশ থেকে ফিরেছেন। করোনা এবং জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় প্রবাসীরা বাংলাদেশে ফিরে আসছেন। বিভিন্ন দেশে প্রায় ৭০ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ১৩৭৭ জন।

ফেরত আসা শ্রমিকরা কবে নাগাদ কর্মস্থলে ফিরতে পারবেন, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। একই সময়ে প্রায় ২ লাখ মানুষ বিদেশে যাওয়ার কথা থাকলেও তারা করোনার কারণে যেতে পারেননি। সব মিলিয়ে করোনায় প্রবাসী ও বিদেশ যাওয়ার লাইনে থাকা ৩ লাখ বাংলাদেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বলছে, প্রবাসে ১ কোটিরও বেশি বাংলাদেশির মধ্যে ৭৫ লাখই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে থাকেন। সাম্প্রতিক সময়ে এসব দেশের অর্থনীতি অত্যন্ত খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা বাংলাদেশি শ্রমিকদের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। তবে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় বলছে, দক্ষ কর্মী পাঠাতে তারা প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশি প্রবাসীদের অধিকাংশই মধ্যপ্রাচ্যে থাকেন। বর্তমানে করোনা এবং জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় এসব দেশে কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়ে আসছে, যা প্রবাসীদের ওপর প্রভাব ফেলছে।

তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতি কতদিন থাকবে, তার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করবে। তার মতে, ফিরে আসা প্রবাসীদের কাজের জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে তাদের পুঁজির জোগান দিতে পারলে তারা কোনো কাজকর্ম করে আপাতত টিকে থাকতে পারবেন। পরবর্তী সময়ে করোনা কেটে গেলে কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে তাদের ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। তবে অবৈধ প্রবাসীদের আবারও ওই দেশে পাঠানো কঠিন বলে জানান তিনি।

এদিকে রোববার এক অনুষ্ঠানে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, করোনায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৭৮ হাজার প্রবাসী ফেরত এসেছেন। এদের যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের চেষ্টা করছে সরকার। তিনি বলেন, সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে বৈদেশিক কর্মসংস্থান সংক্রান্ত লক্ষ্য পূরণে মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েছে।

করোনা-উত্তর পরিস্থিতিতে শ্রমবাজারের পরিবর্তিত চাহিদার ভিত্তিতে কর্মী পাঠানোর প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। বিদেশ থেকে ফেরত আসা অভিজ্ঞ কর্মীদের দেশেই কর্মসংস্থানের সুযোগ দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ১ এপ্রিল থেকে ২২ আগস্ট পর্যন্ত ২৬টি দেশ থেকে ফিরেছেন ৭৮ হাজার ৪৩ জন প্রবাসী। এর মধ্যে পুরুষ ৭৩ হাজার ৩১১ এবং নারী ৪ হাজার ৭৩২ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। দেশটি থেকে ফিরেছেন ২৫ হাজার ৬৫৩ জন কর্মী।

দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সৌদি আরব থেকে এসেছেন ১৫ হাজার ৩৮৯ জন। সৌদিফেরত কর্মীদের মধ্যে বেশিরভাগই বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করে আউটপাস নিয়ে ফিরেছেন। এ ছাড়া মালদ্বীপ থেকে ৭ হাজার ৯০৯, কুয়েত থেকে ৭ হাজার ৩২৯, কাতার থেকে ৬ হাজার ৬০১, ওমান থেকে ৩ হাজার ৮৮৪, মালয়েশিয়া থেকে ২ হাজার ২২৬, ইরাক থেকে ২ হাজার ১৩৬, তুরস্ক থেকে ১ হাজার ৯৪৮, সিঙ্গাপুর থেকে ১ হাজার ৩৮২, জর্ডান থেকে ১ হাজার ২৬, লেবানন থেকে ৯৭৬, বাহরাইন থেকে ৭৪৬, ইতালি থেকে ১৫১, ভিয়েতনাম থেকে ১২২, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১০০, রাশিয়া থেকে ১০০, শ্রীলংকা থেকে ৮০, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ৭১, নেপাল থেকে ৫৫, কম্বোডিয়া থেকে ৪০, মিয়ানমার থেকে ৩৯, মরিশাস থেকে ৩৬, থাইল্যান্ড থেকে ২০, হংকং থেকে ১৬ ও জাপান থেকে ৮ জন প্রবাসী ফেরত এসেছেন।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্যানুযায়ী, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ ১০ দেশের একটি। বর্তমানে এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন। এদের ৭৫ শতাংশই আছেন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। এককভাবে সৌদি আরবেই আছেন ২০ লাখ বাংলাদেশি। আরব আমিরাতে ১৫ লাখ।

এ ছাড়া কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরাইনে গড়ে ৩-৪ লাখ বাংলাদেশি আছেন। তবে মোট প্রবাসীর মধ্যে চিকিৎসক, প্রকৌশলীর মতো পেশাদার মাত্র ২ শতাংশ। বাকিরা সবাই অদক্ষ বা আধা দক্ষ। এদের অধিকাংশই নির্মাণ শ্রমিক। প্রতিবছর প্রবাসীরা প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স পাঠান। কিন্তু করোনায় এ খাতটি সংকটে পড়েছে।

বিশ্বব্যাংক বলছে, চলতি বছর বাংলাদেশের প্রবাসী আয় ২২ শতাংশ কমে যাবে। সৌদি আরবের ইংরেজি দৈনিক সৌদি গেজেটে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলছে, মহামারীর কারণে এ বছরই দেশটিতে ১২ লাখ বিদেশি কর্মী চাকরি হারাবে। সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস ঢাকায় পাঠানো এক চিঠিতে বলেছে, আগামী তিন বছর ১০ লাখ বাংলাদেশি চাকরি হারাতে পারেন।

সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রথমত, করোনায় বিশ্বের সব দেশের অর্থনীতি স্থবির। নতুন কোনো বিনিয়োগ নেই। দ্বিতীয়ত, মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতির মূলশক্তি জ্বালানি তেল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি তেলের দাম তলানিতে নেমে এসেছে। এসব তেল কোম্পানিতে ছাঁটাই চলছে। সৌদির বিখ্যাত তেল কোম্পানি আরামকোর আয় অস্বাভাবিকভাবে কমেছে।

ফলে সৌদিসহ অনেক দেশ তেল উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। তেলের দাম কমে যাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যসহ সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় সংকট তৈরি হয়েছে। এর প্রভাব পড়ছে প্রবাসীদের ওপর। এ ছাড়া যাদের বৈধ কাগজপত্র নেই, এরা সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে।

বাংলাদেশের প্রবাসী আয় আহরণের শীর্ষ ১৫টি উৎস দেশ হল: সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), যুক্তরাষ্ট্র, কুয়েত, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, ওমান, কাতার, ইতালি, বাহরাইন, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া ও জর্ডান। কিন্তু এসব দেশ করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত। ফলে প্রবাসী শ্রমিক দূরের কথা, নিজের দেশের নাগরিকদেরও কাজ দিতে পারছে না।

ব্র্যাকের তথ্যানুযায়ী, করোনায় বিদেশের মাটিতে মোট ১৯টি দেশে অন্তত ১ হাজার ৩৭৭ জন বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন। বিভিন্ন দেশে আক্রান্ত হয়েছেন ৭০ হাজার। জুনে প্রবাসী আয় বাড়লেও বৈদেশিক কর্মসংস্থান কিন্তু গত ৪ মাস ধরেই বন্ধ।

গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭ লাখ লোক বিদেশে কাজ করতে যাচ্ছিলেন, সেই হিসাবে প্রতিমাসে যান ৫০-৬০ হাজার কর্মী। কিন্তু করোনার কারণে বিদেশে লোক পাঠানো পুরোপুরি বন্ধ। গত চার মাসে অন্তত ২ লাখ লোক বিদেশে যেতে পারেননি। এর মধ্যে প্রায় এক লাখ লোকের পাসপোর্ট-ভিসা সব প্রস্তুত ছিল।

জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা)-এর মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী বলেন, ৮৬ হাজার কর্মীর বিদেশ যাওয়ার সবকিছু চূড়ান্ত। করোনার কারণে তারা যেতে পারেননি, এখন তাড়া দিচ্ছে। অন্যদিকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা লগ্নি আটকা পড়েছে এজেন্সিগুলোর।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে এই খাতের সবার বিপদ। তাই সরকারের কাছে আমরা সহজ শর্তে ঋণের দাবি করছি।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, করোনায় বিদেশফেরত কর্মীদের সহজ শর্তে ঋণের জন্য প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংককে ৫শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্পসুদে ও সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার জন্য ওয়েজ অনার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে ২শ’ কোটি টাকার তহবিল দেয়া হয়েছে।

তবে এই ঋণ নিয়ে প্রবাসীরা আসলেই ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন কি না, তা নিয়েও শঙ্কা আছে। প্রবাসী কর্মীরা বিদেশে কাজ হারিয়ে দেশে ফিরে আসার পর ব্যবসা করার জন্য সরকার থেকে ৫-৭ লাখ টাকা ঋণ সহায়তা পাচ্ছেন। আর বিমানবন্দরে ফিরেই পাচ্ছেন ৫ হাজার টাকা। কোনো প্রবাসী করোনায় আক্রান্ত হয়ে বিদেশে মারা গেলে, তার পরিবারকে ৩ লাখ টাকা দিচ্ছে সরকার।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত