সিলেটটুডে ডেস্ক

১৬ ফেব্রুয়ারি , ২০২১ ০১:০১

অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার রায় আজ

ছয় বছর আগে বইমেলা থেকে ফেরার পথে বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যার যে ঘটনা বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলেছিল, সেই মামলার রায় জানা যাবে আজ মঙ্গলবার।

ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান বেলা ১২টার দিকে এ মামলার রায় ঘোষণা করবেন বলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী গোলাম ছারোয়ার খান জাকির জানিয়েছেন।

রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলার উগ্রপন্থি ছয় আসামির সবার সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়েছে। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলেছেন, রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়নি বলেই তাদের বিশ্বাস।

মামলার আসামিরা হলেন- সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হক ওরফে জিয়া, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন ওরফে শাহরিয়ার, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব, আরাফাত রহমান ওরফে সিয়াম ওরফে সাজ্জাদ ওরফে শামস্), আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব ওরফে আবির ওরফে আদনান ওরফে আবদুল্লাহ এবং উগ্রপন্থি ব্লগার শফিউর রহমান ফারাবী।

আসামিদের মধ্যে ফারাবী ছাড়া বাকি সবাই নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য বলে তদন্তকারীদের ভাষ্য। জিয়া ও আকরাম পলাতক আছেন, বাকি সবাই কারাগারে।

দুই পক্ষের যুক্ততর্ক শুনানি শেষে গত ৪ ফেব্রুয়ারি বিচারক মজিবুর রহমান এ মামলার রায়ের জন্য ১৬ ফেব্রুয়ারি তারিখ রাখেন।

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে নিয়ে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে জঙ্গি কায়দায় হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী অভিজিৎ রায়। চাপাতির আঘাতে আঙুল হারান তার স্ত্রী।
পদার্থবিদ অধ্যাপক অজয় রায়ের ছেলে অভিজিৎ থাকতেন যুক্তরাষ্ট্রে। বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে লেখালেখির পাশাপাশি মুক্তমনা ব্লগ সাইট পরিচালনা করতেন তিনি। জঙ্গিদের হুমকির মুখেও তিনি বইমেলায় অংশ নিতে দেশে এসেছিলেন।

ঘটনার পর শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন অধ্যাপক অজয় রায় (বর্তমানে প্রয়াত)। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) হাত ঘুরে মামলাটির তদন্তভার কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের হাতে যায়।

হত্যাকাণ্ডের চার বছর পর ২০১৯ সালের ১৩ মার্চ ছয়জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটিটিসি) পরিদর্শক মনিরুল ইসলাম। অভিযোগের পক্ষে ৩৪ জনকে সাক্ষী করা হয়।

ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধী ট্রাইবুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান ওই বছর ১ অগাস্ট অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলার ছয় আসামির বিচার শুরুর আদেশ দেন।

অভিযোগপত্রে নাম থাকা রাষ্ট্রপক্ষের ৩৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণের পর কারাগারে থাকা চার আসামি গত ২৭ জানুয়ারি আদালত নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন।

৩ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি গোলাম ছারোয়ার খান জাকির আসামিদের মৃত্যুদণ্ড চেয়ে যুক্তিতর্ক শেষ করেন। পরদিন আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসে।

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের উত্তাল আন্দোলনের মধ্যে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনার পর ধারাবাহিকভাবে জঙ্গি হামলার শিকার হতে থাকেন লেখক, ব্লগার, প্রকাশক, সমকামী অধিকারকর্মীরা।

মুক্তমনা ব্লগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা অভিজিত রায় নিয়মিত বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখিতে যুক্ত ছিলেন। উগ্রবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী অবস্থানের কারণে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এই প্রকৌশলীকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল জঙ্গিবাদীরা।

২০১৫ সালের একুশের বইমেলায় দুটি বই প্রকাশ হয় অভিজিতের, সে কারণেই স্ত্রী বন্যাকে সঙ্গে নিয়ে ওই বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি দেশে আসেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে বইমেলায় এক অনুষ্ঠান শেষে ফেরার পথে হামলার শিকার হন তারা।

অভিজিৎ হত্যা মামলার বাদী তার বাবা অধ্যাপক অজয় রায় বিচারের শেষ দেখে যেতে পারেননি। ছেলের মৃত্যুর ঘটনায় মন ভেঙে গিয়েছিল তার, সেই শোক সইতে না পেরে স্ত্রীও গত হয়েছিলেন বছরখানেক আগে।

এ মামলার বিচার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রয়াত হন ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক অজয় রায়।

মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে ২০১৯ সালের ২৮ অক্টোবর অসুস্থ অবস্থায় আদালতে হাজির হয়ে তিনি এ মামলায় বাদী হিসাবে সাক্ষ্য দেন।

অভিজিতের ছোট ভাই অনুজিত রায় সোমবার বলেন, “আমি রায়ের সময় আদালতে থাকার চেষ্টা করব।”

পেশায় স্কুল শিক্ষক অনুজিত বলেন, “অবশ্যই আমি দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। আর পুলিশ যেন পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে কোনো শৈথিল্য না দেখায়। পলাতক আসামিদের না ধরতে পারলে এ রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। আর ওরা ধরা না পড়া পর্যন্ত জনসাধারণ, বিশেষ করে প্রগতিশীল লেখকদের মধ্যে আতঙ্ক থেকে যাবে। অভিজিত হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ও তার সহযোগীদের আইনের আওতায় আনা জরুরি।”

যাকে এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী বলা হচ্ছে, সেই সৈয়দ জিয়াউল হকের বিরুদ্ধে আরও বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যার মামলার রায় হয়েছে এ মাসেই।
সেখানে যে আট জঙ্গির ফাঁসির রায় এসেছে, তার মধ্যে জিয়া, সায়মন ওরফে শাহরিয়ার, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব, আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ হত্যারও আসামি।

২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি সেনাবাহিনী এক সংবাদ সম্মেলনে সরকার উৎখাতে ধর্মান্ধ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার একটি অভ্যুত্থান পরিকল্পনা নস্যাৎ করার খবর দেয়। অভ্যুত্থানচেষ্টাকারীদের নেতা হিসেবে জানানো হয় মেজর জিয়ার নাম।

তখন সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়া জিয়া পালিয়ে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামে যুক্ত হন বলে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী গোলাম ছারোয়ার খান জাকির বলেছেন, এ মামলার আসামিদের সবার সর্বোচ্চ সাজা হবে বলেই তিনি আশা করছেন।

অন্যদিকে আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী খায়রুল ইসলাম লিটন ও মো. নজরুল ইসলামের দাবি, এ মামলার তদন্তে ‘ত্রুটি’ রয়েছে।

লিটন বলেন, “ত্রুটিযুক্ত অভিযাগপত্রে মামলার বিচার চলেছে। যে কারণে রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা আমাদের মোয়াক্কেলদের খালাসের রায় হোক বলে দাবি করছি।”

বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দেওয়া ওই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শেষে ২০১৯ সালে জমা দেওয়া সিটিটিসির অভিযোগপত্রে বলা হয়, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে ১২ জনের সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেলেও তাদের মধ্যে পাঁচজনের পূর্ণভঙ্গ নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়নি। একজন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যাওয়ায় অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়েছে মোট ছয়জনকে। আসামিরা জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য।

নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের (আগের নাম আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) নেতা জিয়ার ‘নির্দেশেই’ সেদিন অভিজিতের ওপর হামলা হয় বলে উল্লেখ করা হয় অভিযোগপত্রে।

সেখানে বলা হয়, আসামি মোজাম্মেল, আকরাম, হাসান ও আবু সিদ্দিক হত্যাকাণ্ডের দুই মাস আগে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের ১৯২/২ নম্বর বাসা ভাড়া নিয়ে অভিজিৎ রায়কে বিভিন্ন স্থানে অনুসরণসহ হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়ন করেন।

আসামি মোজাম্মেল রেকি টিমের নেতৃত্বে থেকে অপারেশন শাখার মুকুল রানা ওরফে শরিফুলকে অনুসরণসহ এ হত্যাকাণ্ডের সার্বিক সহযোগিতা এবং আসামিদের পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেন।

আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের অপারেশন শাখার সদস্য আসামি আরাফাত রহমান, আলী ওরফে খলিল, অনিক এবং অন্তু সাংগঠনিকভাবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন টার্গেট ব্যক্তিকে হত্যা করার।

অপারেশন শাখার চারজন আসামি যাতে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে নিরাপদে পালিয়ে যেতে পারে তার জন্য চারপাশে বেষ্টনি করে রাখে আসামি জিয়া, সেলিম, মুকুল রানা, মোজাম্মেল, আবু সিদ্দিক ও আকরাম।

আসামিদের মধ্যে মারা যাওয়ার কারণে মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন তিনজন। মান্না ইয়াহিয়া ওরফে মান্নান রাহি ও আবুল বাশার চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে মারা যান।

হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া দলটির নেতৃত্বে থাকা মুকুল রানা ওরফে শরিফুল ২০১৬ সালের ১৯ জুন ঢাকার খিলগাঁওয়ে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।

উগ্রপন্থি ব্লগার সরাসরি ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িত না থাকলেও ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে অভিজিৎ রায়কে ‘হত্যার প্ররোচনা দিয়েছিলেন’ বলে তাকেও এ মামলায় আসামি করা হয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত